শেষের পাতা
কোনো ধরনের বিচ্যুতিকে প্রশ্রয় দেয়া হবে না
স্টাফ রিপোর্টার
১৩ আগস্ট ২০২৪, মঙ্গলবারকোনো প্রকারের বিচ্যুতিকে প্রশ্রয় দেয়া হবে না বলে মন্তব্য করেছেন নবনিযুক্ত প্রধান বিচারপতি সৈয়দ
রেফাত আহমেদ। তিনি বলেছেন, শিক্ষার্থীরা বৈষম্যের বিরুদ্ধে মহাজাগরণের উন্মেষ ঘটিয়েছেন। ছাত্র-জনতার বিপ্লবের ফলে আমার কাঁধে যে দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে তা আমি পালন করে যাবো। ধ্বংসস্তূপে দাঁড়িয়ে নতুন করে শুরু করতে হবে বলে জানান তিনি। গতকাল আপিল বিভাগে অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয় ও সুপ্রিম কোর্ট বারের পক্ষ থেকে সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে প্রধান বিচারপতি এসব কথা বলেন।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে নিহত শহীদদের স্মরণ করে প্রধান বিচারপতি বলেন, সারা দেশের ছাত্র-জনতা ও শিক্ষার্থীদের অভিনন্দন জানাচ্ছি। যারা এই আন্দোলনে সমর্থন জানিয়েছিলেন তাদেরও অভিনন্দন জানাচ্ছি। সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের শুরুতে সামপ্রতিক ঘটনায় নিহতদের স্মরণে প্রধান বিচারপতি দাঁড়িয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করতে আহ্বান জানালে সুপ্রিম কোর্টের উভয় বিভাগের বিচারপতি, আইনজীবীসহ উপস্থিত সবাই নীরবতা পালন করেন।
এরপর প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ বলেন, শিষ্টের লালন ও অন্যায়ের দমন হলো বিচার বিভাগের শাশ্বত দায়িত্ব। বিচারক ও কর্মকর্তাদের মধ্যে যে কেউ অন্যায় বা শিষ্টাচার লঙ্ঘন করলে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। যে কেউ ভালো কাজ করলে তাকে পুরস্কৃত করা হবে। কিন্তু কোনো ধরনের বিচ্যুতিকে প্রশ্রয় দেয়া হবে না।
এ সময় প্রধান বিচারপতি বলেন, আমি সারা দেশের সব ছাত্র-জনতা-শিক্ষার্থীকে বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতির পক্ষ থেকে অভিনন্দন জানাচ্ছি। আমি আরও অভিনন্দন জানাই বাংলাদেশের সর্বস্তরের জনগণকে, যারা শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলনে পূর্ণ সমর্থন দিয়েছেন। আজ থেকে প্রতিটি শ্রেয়, শুভ ও কল্যাণকর কর্মে সবাই বিচার বিভাগকে আপনাদের পাশে পাবেন। আমি সচেতন আছি, আমাকে বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। সুপ্রিম কোর্ট ছাড়াও জেলা জুডিশিয়ারি হলো বিচার বিভাগের সবচেয়ে বড় ও বিস্তৃত ক্ষেত্র। অধস্তন জুডিশিয়ারিতে কর্মরত বিচারক সহকর্মীরা আমরা সবচেয়ে বড় শক্তি। দেশের সাধারণ মানুষ বিচার বিভাগ বলতে মূলত ডিস্ট্রিক্ট জুডিশিয়ারিকে বোঝেন।
প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘জুডিশিয়াল সার্ভিসে কর্মরত সহকর্মীদের বলছি, আমি আপনাদের পাশে আছি। আপনারা কোনো ধরনের অন্যায়, চাপ ও ভয়ভীতির আশঙ্কা করবেন না। নির্ভয়ে নিষ্ঠার সঙ্গে বিচারিক কাজ পরিচালনা করুন। আমরা সবাই জানি, দেশের এই ক্রান্তিলগ্নে ভগ্নদশা থেকে বিচার বিভাগও মুক্ত নয়। কিন্তু ছাত্র-জনতার বিজয়ের এই ঐতিহাসিক মুহূর্ত নির্যাতিত ও নিপীড়িত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর এক সুবর্ণ সুযোগ আমাদের সামনে এনে দিয়েছে। আমরা যেন এই সুযোগের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করতে পারি, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
প্রধান বিচারপতিকে দেয়া এই সংবর্ধনায় আপিল বিভাগের বিচারপতি মো. আশফাকুল ইসলাম ও হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতিবৃন্দ ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবীরা উপস্থিত ছিলেন। সংবর্ধনায় প্রথমে অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান ও পরে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এএম মাহবুব উদ্দিন খোকন বক্তব্য দেন।
খুন-গুমের শিকার আত্মা ন্যায় বিচারের প্রতীক্ষায় আছে খুন-গুম-নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার সব আত্মা ন্যায় বিচারের প্রতিক্ষায় আছে, প্রধান বিচারপতির দিকে তাকিয়ে আছে বলে মন্তব্য করেছেন অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান। অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, গোটা দেশবাসীর মতো আমিও আশা করি আপনি (প্রধান বিচারপতি) তাদের বিমুখ করবেন না।
প্রধান বিচারপতিকে উদ্দেশ্য করে অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান বলেন, দ্বিতীয় মুক্তি সংগ্রামের মধ্যদিয়ে অর্জিত এক স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের প্রথম প্রধান বিচারপতি আপনি। আপনাকে রাষ্ট্রপতিই শুধু পছন্দ করে নিয়োগ দেননি, আপনার নিয়োগের পিছনে রয়েছে এদেশের শত শত নিরীহ ছাত্রের বুকের তাজা রক্তে ভেজা রাজপথের কালজয়ী অমর কাব্যের এক বীরত্ব গাথা উপাখ্যান। পৃথিবীর ইতিহাসে এ ঘটনা বিরল। বিপ্লবোত্তর যে কোনো দেশে রাজপথ কিংবা রণাঙ্গন ঠিক করে দেয়, সে দেশের নেতা ঠিক করে দেয়- সে দেশের নেতা কে হবে। আর আমাদের দেশের বীর ছাত্ররা, তাদের পাশে থাকা অভিভাবকেরা, তাদের শুভাকাঙ্ক্ষীরা রাজপথ থেকে আপনাকে প্রধান বিচারপতি করার দাবি তুলেছিলেন। এ ভালোবাসা বিরল, এ ভালোবাসা অমূল্য, এ ভালোবাসা নিয়ে গর্ব করতেই পারি- তাই না?
অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, বিগত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া অনেকগুলো গুম হওয়া মানুষের আত্মা, অসংখ্য মানুষের বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়ার বেদনা, অগণিত মানুষের নির্যাতন-নিপীড়নের গল্প, অনেক মৃত মানুষের গায়েবী মামলায় আসামি হওয়ার অভিশাপ, অনেক পরিবারের নিঃস্ব হওয়ার হাহাকার থেকে উৎসারিত প্রতিবাদের ভাষা থেকে প্রতিরোধে রূপ নেয়ার অন্য অবয়ব আজকের বাংলাদেশ। সেই বাংলাদেশে খুন-গুম-নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার সেইসব আত্মা, সেইসব মানুষ আজ ন্যায় বিচারের প্রতীক্ষায় আছেন, আপনার দিকে তাকিয়ে আছেন, গোটা দেশবাসীর মতো আমিও আশা করি আপনি তাদের বিমুখ করবেন না।
প্রভাবমুক্ত স্বাধীন বিচার বিভাগ চাই
প্রভাবমুক্ত সম্পূর্ণ স্বাধীন বিচার বিভাগ নিশ্চিত করতে প্রধান বিচারপতির কাছে আহ্বান জানিয়েছেন সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি ব্যারিস্টার এএম মাহবুব উদ্দিন খোকন। এ সময় সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি বলেন, বিগত দিনে বিচার বিভাগকে ক্রমান্বয়ে দলীয়করণ ও রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার করে নির্বাহী বিভাগের আজ্ঞাবহ করে রাখার মাধ্যমে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়ার চেষ্টা করা হয়। আমরা দেখেছি, কীভাবে দেশে একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে ছাত্র-জনতার যৌক্তিক ও অরাজনৈতিক শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে নৃশংস হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে বিচার বিভাগকে জনরোষের মধ্যে ফেলে কলঙ্কিত করার চেষ্টা করা হয়েছে। আমরা আর এ ধরনের ন্যক্কারজনক অধ্যায়ের পুনরাবৃত্তি আশা করি না।