ঢাকা, ৩ জুলাই ২০২৫, বৃহস্পতিবার, ১৯ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, ৬ মহরম ১৪৪৭ হিঃ

বাংলারজমিন

নববধূকে ঘরে তোলার আগেই গুলিতে ঝরে গেল আল-আমিনের প্রাণ

জাহিদ হাসান, কুমিল্লা থেকে
২ আগস্ট ২০২৪, শুক্রবার
mzamin

জুমার নামাজ পড়তে যেতে ছেলেটা বলে গেল শ্বশুরবাড়ি যাবে। আমি বললাম সাবধানে যাইস। বাসার পাশেই মসজিদ। রাস্তার এপার-ওপার। নামাজ পড়ে বের হয় আমার মানিক, সঙ্গে ছিল তার দুই বন্ধু। একজনের পায়ে গুলি লাগে। তবুও দু’জন কোনোরকম দৌড়ে আসতে পারলেও আমার পাখিটা আর উঠতে পারে নাই। রাস্তায় নাকি কেউ ভয়ে তার লাশ ধরেনি অনেকক্ষণ।’
গত ১৯শে জুলাই (শুক্রবার) কারফিউর দিনে ঢাকার সাভারের রেডিও কলোনিতে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষের সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায় সাইমন ইসলাম আল-আমিন (২৩)।
জানা গেছে, সাইমন ইসলাম আল-আমিন কুমিল্লার বরুড়া উপজেলার লক্ষ্মীপুর ইউনিয়নের দৌলতপুর মধ্যপাড়ার মো. বাবুল ও মনোয়ারা বেগম দম্পতির মেজো ছেলে। তিনি সাভারের রেডিও কলোনি এলাকায় ভাড়া বাসায় পরিবারের সঙ্গে থাকতেন। একই এলাকার একটি ফ্যাক্টরিতে নতুন কাজ পেয়েছেন। বাবা গাজীপুরে কাজ করতেন। ১৯শে জুলাই (শুক্রবার) নিহতের পর শনিবার তার লাশ দাফন করা হয় নানাবাড়ি বরুড়া উপজেলার লক্ষ্মীপুর ইউনিয়নের দৌলতপুর দক্ষিণপাড়া গ্রামে। সেখানেই তাকে কোনো ময়নাতদন্ত ছাড়াই দাফন করা হয়।
আল-আমিনের মা মনোয়ারা বেগম বলেন, ‘আমাদের বাসা সাভারের রেডিও কলোনি এলাকায়। মসজিদ আমাদের বাসা থেকে সামান্য দূরে। রাস্তা পার হয়ে যেতে হয়। ছেলেটা রাস্তা পার হয়ে জুমার নামাজ পড়তে যায়। নামাজ শেষে ফিরছিল বাসায়। নামাজ শেষে বাসা থেকে গুলির শব্দ শুনে বের হই। সামনেই রাস্তার মোড়ে পাম্পের সামনে লোকজন জড়ো হয়ে আছে। আমি দেখে চলে আসি। শুনছিলাম আল-আমিন গুলিবিদ্ধ হয়েছে। আমার মনটা কেমন কেমন জানি করছিল। এরপরেও আবার বাসায় ফিরি। কিছুক্ষণ পর তার এক বন্ধু কল দিয়ে বললো, আল-আমিন গুলিবিদ্ধ হয়েছে। তখন মনে হয়েছিল মানুষ আমার ছেলেকে পড়ে যেতে দেখেই দূরে গিয়ে জড়ো হয়েছিল। আমি বাসা থেকে বের হতে হতে আরেকটা কল আসে, হাসপাতাল থেকে করা অচেনা ওই নম্বরে বলতেছিল, খালাম্মা আল-আমিন মারা গেছে। এ সময় চারিদিকে আর্তনাদের শব্দ শোনা যাচ্ছিল। আমি দৌড়ে হাসপাতালে গিয়ে দেখি পাখিটার রক্তাক্ত শরীর পড়ে আছে। যেন হাসতেছিল আমাকে দেখে।’
আল আমিনের বাবা মো. বাবুল বলেন, ‘ঘটনার পর আমাকে কেউ একজন কল দিয়ে বলেন, আপনার ছেলে গুলিবিদ্ধ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি। আরেকজন এই নম্বরেই বলেন মারা গেছে। আমি তখন আমার কর্মস্থল গাজীপুরে। আমি বিশ্বাস করিনি। কারণ, সকালে আল-আমিনের সঙ্গে কথা হয়েছে। আমার ছেলেটা আমাকে কতো অনুরোধ করে বলেছিল যেন বের না হই। আমিও বের না হওয়ার ওয়াদা করি। কিন্তু আমি বের না হলেও আমার ছেলেটাকে আর দেখা হলো না। তার লাশ নিয়ে বাড়ি আসলাম।’
এ সময় কান্নায় ভেঙে পড়েন ছেলে হারানো বাবা। তিনি বলতে থাকেন, ‘আমার ছেলে রাজনীতি করে না। এইচএসসি পরীক্ষা দিয়ে আর পড়াশোনা করেনি। আবার উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পরিকল্পনা করছিল। ছেলেটা নামাজে গেছে। তার কী অন্যায় ছিল? কোন দোষে তাকে গুলি মারা হলো?’
বুক চাপড়ে আহাজারি করে আল-আমিনের মা মনোয়ারা বেগম বলেন, ‘ঘরের পাখিকে ২৩ বছর না খেয়ে না পরে বাঁচিয়ে রেখেছি। টাকা-পয়সার জন্য বাবুটারে পড়াশোনা করাতে পারিনি। পরে কাজ করতে যায়। জুলাই মাসের দুই তারিখে কাজে গিয়ে বেতন পাওয়ার আগেই মারা গেছে। ইচ্ছে ছিল বড় ভাইয়ের প্রবাসে যাওয়ার ঋণ শেষ করে আবার পড়াশোনা করবে। ভালো চাকরি পেয়ে সংসারের হাল ধরবে। গত ৫ মাস আগে বিয়ে করেছে। বউটাকে আর তুলে আনতে পারি নাই। এর আগেই আমার ছেলেটাকে খুন করে দিল তারা।’
তিনি জানান, শুক্রবার সারারাত কোনো এম্বুলেন্স খুঁজেও পাওয়া যায়নি। পরে শনিবার ভোরে কুমিল্লার লাকসাম থেকে একটি এম্বুলেন্স গিয়ে তার লাশ আনে। পরদিন সকাল ১০টায় ময়নাতদন্ত বা পুলিশ রিপোর্ট ছাড়াই তার লাশ দাফন করা হয়।
মনোয়ারা বেগম বলেন, ‘সেদিন তেমন কোনো ঝামেলা হয়নি। আমার ছেলেটাকে কেন মারলো তারা? আমার ছেলে আন্দোলনও করেনি সংগ্রামও করেনি। নামাজ পড়তে গেছে। আর লাশ হয়ে ফিরেছে। পুলিশ এসে বলছে আমাকে ক্ষতিপূরণ দেবে। কিন্তু আমার ছেলে কি আর ফিরে আসবে?’
 

বাংলারজমিন থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

বাংলারজমিন সর্বাধিক পঠিত

   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2025
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status