বাংলারজমিন
গুলিতে এম্বুলেন্সেই নিথর হয়ে পড়েন টিটু
বাবাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে অবুঝ তিন শিশু
বরগুনা প্রতিনিধি
২৯ জুলাই ২০২৪, সোমবারঢাকার ধানমণ্ডি এলাকায় কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় গুলিতে মারা যাওয়া এম্বুলেন্স চালক মো. টিটু হাওলাদার (৩৬)-এর স্ত্রী আয়েশা আক্তার (২৯)। তিনি গত এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে নির্বাক।
স্বামীর মৃত্যুর খবর শোনার পর থেকেই শোকে পাথর আয়েশা। মুখে কোনো খাবার নিচ্ছেন না ঠিকমতো। মায়ের মতোই শোকে মুহ্যমান হয়ে গেছে ১০ বছরের মেয়ে তানজিলা আক্তার। আর চার মাসের ছোট মেয়ে তামান্না জানেই না তার বাবা চলে গেছে অজানা এক দেশে, যেখান থেকে সে আর কখনো ফিরবে না। ছয় বছরের ছেলে সায়মুন এখনো বুঝে উঠতে পারছে না তার বাবা কোথায়? তার ছোট্ট দুটি চোখ খুঁজে ফিরছে বাবাকে। বরগুনার বেতাগী উপজেলার হোসনাবাদ ইউনিয়নের প্রত্যন্ত এক গ্রাম নীলখোলা। এই গ্রামের বাসিন্দা রিকশাচালক আবদুর রহিম হাওলাদারের ছেলে টিটু। মা রাশেদা বেগম চার বছর আগে সাপের দংশনে মারা গেছেন। চার ভাইবোনের মধ্যে টিটু সবার বড়। অভাবের কারণে ছোট ভাই ইমরান হোসেন রিকশা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন।
অন্যদিকে এক বোনকে বিয়ে দিতে পারলেও আরেক বোন বাকপ্রতিবন্ধী হওয়ায় ভাইয়ের সংসারে আছেন। বাবা, ভাইবোন, স্ত্রী ও তিন সন্তানের মুখে খাবার তুলে দিতে টিটু কয়েক বছর আগে আসেন ঢাকায়। তাই টিটুর আকস্মিক মৃত্যুতে শোকে কাতর পুরো পরিবার। নিহত টিটু হাওলাদারের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, গাছগাছালিতে ভরা বাড়ির চারপাশ টিটুর মৃত্যুতে যেন নিস্তব্ধ। বাড়িতে প্রবেশের মুখেই কবর দেয়া হয়েছে টিটুকে।
এ সময় টিটুর মামাতো ভাই রাকিব হাসান ছলছল চোখে হাত উঁচু করে দেখাতে দেখাতে বলছিলেন, ওইখানে আমার ভাই শুয়ে আছেন। একটু দূরে ছোট্ট টিনের ঘর জুড়ে কেবল নিস্তব্ধতা। রাকিব তার মামা আবদুর রহিমকে ঘরের ভেতর থেকে ডেকে আনলেন বারান্দায়। সাংবাদিক পরিচয় জেনে আব্দুর রহিম ফ্যাল ফ্যাল চোখে কেঁদে ফেললেন।
নিহত টিটুর পিতা আবদুর রহিম বলেন, আমার ছেলে কোনো রাজনীতি করতো না। ঢাকায় এম্বুলেন্স চালিয়ে বাড়িতে আমাদের জন্য টাকা পাঠাতো। এবার আমার ছেলে ঢাকায় যাওয়ার সময় বলেছিল, বাবা ওদের (টিটুর সন্তানদের) দেখে রেখো। এই ছিল আমার ভাগ্যে? আমার বাবাকে পক্ষীর (পাখির) মতো গুলি করা হয়েছে। এখন আমার সব শেষ হয়ে গেল। আমার নাতি-নাতনিদের এখন কে দেখবে- বলেই কান্নায় ভেঙে পড়েন আবদুর রহিম।
টিটুর মামাতো ভাই রাকিব হাসান জানান, টিটু ঢাকায় একটি বেসরকারি এম্বুলেন্স চালাতেন। গত ১৮ই জুলাই দুপুরের খাবার খেয়ে কর্মস্থলে যাওয়ার পথে তিনি গুলিবিদ্ধ হন। তার মাথায় একটি বুলেট বিদ্ধ হয়। সারা শরীরে ছিল অসংখ্য রাবার বুলেটের ক্ষত। খবর পেয়ে তিনি নারায়ণগঞ্জ থেকে রাজধানীর গ্রিন লাইফ হাসপাতালে ছুটে যান। তারপর সব আইনি প্রক্রিয়া শেষে ২০শে জুলাই রাতে বাড়িতে লাশ নিয়ে আসেন। পরে সেখানেই জানাজার পর দাফন হয়। নিহত টিটুর স্ত্রী আয়েশার সঙ্গে কথা বলতে চাইলে তিনি বারান্দায় আসেন। তার কাঁধে ছোট্ট তামান্না তখনো গভীর ঘুমে নিমগ্ন। তার বিধ্বস্ত চেহারা দেখে বোঝা গেল কতোটা ঝড় বইছে জীবনের উপর দিয়ে। মাথা নিচু করে নীরবতা ভেঙে তিনি শুধু বলছিলেন, ছোট্ট তিনটি বাচ্চা নিয়ে আমি এখন কোথায় যাবো, কী করবো কিছুই জানি না। সন্তানদের অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ চিন্তা যেন স্বজন হারানো শোককে ম্লান করে দিয়েছে।