শেষের পাতা
সরজমিন
বিমানবন্দরে যাত্রীদের অবর্ণনীয় দুর্ভোগ
নাইম হাসান
২৫ জুলাই ২০২৪, বৃহস্পতিবার
দুখু মিয়া। যাবেন সৌদি আরব। বৃহস্পতিবার রাত ৩টা ১৫ মিনিটে ফ্লাইট তার। এদিন বেলা ২টায় বিমানবন্দরে এসে পৌঁছান তিনি। দেশের চলমান পরিস্থিতির কারণে ১৩ ঘণ্টা আগেই ময়মনসিংহ থেকে বিমানবন্দর আসেন তিনি। তিনি বলেন, সৌদি থেকে আসার সময়ই আমি যাওয়ার টিকিট করে এসেছি। টিকিটের কপি আছে। কিন্তু অনলাইনে ফ্লাইটের সময় ঠিক আছে কিনা দেখতে পারছি না। এত আগে বিমানবন্দরের ভেতরেও যেতে দিচ্ছে না। আমার গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহ জেলায়। কারফিউ না থাকলে ট্রেনেই আসতাম। বাধ্য হয়ে বেশি ভাড়া দিয়ে গাড়ি ভাড়া করে আসতে হলো।
দুখু মিয়ার মতো হযরত শাহজালাল বিমানবন্দরে এমন অনেক যাত্রী ভিড় করেন নির্ধারিত সময়ের অনেক আগেই। অনেকেই অভিযোগ করেছেন, বাস-ট্রেন না চলায় বাধ্য হয়ে গাড়ি ভাড়া করে এসেছেন তারা। এতে অন্য সময়ের তুলনায় বাড়তি ভাড়া গুণতে হয়েছে। দেশব্যাপী ইন্টারনেট সেবা বন্ধ থাকায় তাদের ফ্লাইটের সময় ঠিক আছে কিনা সেই অনিশ্চয়তা নিয়েই বের হয়েছেন তারা। তাদের মধ্যে কেউ কেউ ফজরের নামাজ পড়েই বেরিয়ে পড়েন। কমপক্ষে ১০ ঘণ্টা পর্যন্ত অপেক্ষমান যাত্রীকে দেখা গেছে।
বাহরাইন যাবেন রাসেল আহমেদ। এই উদ্দেশ্যে কুমিল্লা থেকে ভোর ৬টায় বিমানবন্দরে এসে পৌঁছান তিনি। সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় ফ্লাইট তার। প্রায় সাড়ে ১৩ ঘণ্টা বিমানবন্দরে অবস্থান করতে হবে তাকে। বলেন, বাড়ি থেকে আসছি, ফোন করতে পারি না। বাহিরেও কোনো যোগাযোগ করতে পারছি না। আমার বিমানের ফ্লাইটের সময়টাও বাতিল হতে পারতো। এখানে এসে দেখা ছাড়া আর কোনো উপায় নাই। এর মধ্যে প্রাইভেট গাড়ি নিয়ে এসেছি। এখানে অনেক টাকা চলে গেছে। যদি দূরপাল্লার কোনো যানবাহন চলতো তাহলে কোনো সমস্যা হতো না।
কারফিউ এর কারণে ১০ ঘণ্টা আগেই বিমানবন্দরে চলে এসেছেন রুবেল হোসেন। যাবেন কাতার। বলেন, এমনি সময় তো আমরা বাসে চড়ে আসতাম। এখন প্রাইভেটকারে এসেছি, ৩ থেকে ৪ হাজার টাকা লেগেছে। আমার বাড়ি টাঙ্গাইল থেকে ঢাকা ১ ঘণ্টার রাস্তা। ভয়ে জলদি ১০টায় চলে এসেছি। ফ্লাইট ৮টায়। এখন ভেতরে যাবো, গেলে বুঝবো সব ঠিক আছে কিনা। ইন্টারনেট না থাকায় কঠিন ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে আমাদের। এই ১০ ঘণ্টা কেক-বিস্কুট খেয়েই কাটাতে হবে।
জনি চৌধুরী। গ্রামের বাড়ি চাঁদপুর। ৫ বছর সৌদির প্রবাস জীবন পার করে ৬ মাস হলো দেশে এসেছেন। ছুটি শেষ হওয়ায় শনিবার আবারো প্রবাসে যাবেন বলে বিমানের টিকিট কেটেছিলেন। বিমানবন্দরে এসে দেখেন তার সৌদি এয়ারলাইন্স এর ফ্লাইটটি বাতিল করা হয়েছে। দেশে ইন্টারনেট সেবা বন্ধ থাকায় কিছুই জানতে পারেননি তিনি। ৩ দিন ভোগান্তি শেষে গতকাল ৪টায় তার বিমানের ফ্লাইটের জন্য সিট পেয়েছেন। তিনি বলেন, শনিবার এসে যখন দেখলাম বিমানের ফ্লাইটটি বাতিল করা হয়েছে, তারপর সৌদি এয়ারলাইন্সে গিয়ে খোঁজ নিয়েছি। অনেক এজেন্সির সঙ্গে কথা বলেছি। কী করবো কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। কোনো দিশা খুঁজে পাচ্ছিলাম না। ফ্লাইট যে বাতিল করা হয়েছে, আমাকে কোনো ধরনের ফোন বা মেসেজ করা হয়নি। ইন্টারনেট ঠিক থাকলে এই ভোগান্তি পোহাতে হতো না। আমি ঘরে বসেই বুঝতে পারতাম। এত আগে ঢাকায় এসে বসে থাকতে হতো না।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর থানা থেকে এসেছেন মো. মনির। বলেন, আমরা সবসময় বাসে আসি। ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা লাগতো। এখন লেগেছে ২ হাজার টাকা। বাস নাই, এজন্য সিএনজিতে আসা লাগছে। আবার ইন্টারনেট নাই। যোগাযোগ করতে পারছি না। আগে থেকেই টিকিট কেটে রেখেছিলাম আমরা। এসে দেখছি ফ্লাইট ক্যান্সেল হয়নি। এটাই সুখবর। মনিরের মতোই ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে এসেছেন উজ্জ্বল। তিনি কাতার যাওয়ার উদ্দেশ্যে এয়ারপোর্টে এসেছেন। তিনি বলেন, ইন্টারনেট ছাড়া কী কোনোভাবে চলা যায়? একটা বাচ্চারও এখন নেট লাগে। আমাদের ফ্লাইটটা ঠিক টাইমে যাবে কি-না? এটা আমরা কনফার্ম বুঝতে পারছি না, যে এটা রানিং আছে কি-না।
দুবাই প্রবাসী শরিফুল ইসলাম বলেন, কারফিউ এর জন্য ঢাকায় আসতে পারি কিনা পারি, এনিয়ে দ্বিধায় ছিলাম। আমার পরিচিত একজনের শনিবার দুবাইয়ের ফ্লাইট ছিল। সেটি বাতিল হওয়ায় সে আসার পরে ২ থেকে ৩ দিন এখানে আটকা পড়েছিল। এটা জানার পরে আমি দুইটা গ্রাম পার হয়ে গিয়ে খবর জানার চেষ্টা করছি
আশরাফুল ইসলাম। যাবেন সিঙ্গাপুর। তার বিমানের ফ্লাইট রাত ১০টায়। বলেন, আমার গ্রামের বাড়ি টাঙ্গাইল জেলায়। সকাল ৮টায় বাসা থেকে বের হয়েছি। রাস্তায় সমস্যার জন্য আগে বের হতে হয়েছে। দুপুর ১২টায় এয়ারপোর্টে চলে এসেছি। এখন ১০ ঘণ্টা বসে থাকা লাগবে।
পারভেজ মোশাররফের গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহ। তিনি সকাল ১০টায় বাসা থেকে বের হয়েছেন। ২টায় বিমানবন্দরে এসে পৌঁছান তিনি। যাবেন বাহরাইন। বলেন, এখন পর্যন্ত ফ্লাইটের সময় ঠিক আছে কিনা জানি না। নেট না থাকায় বোঝা যায়নি ফ্লাইটের সময় ঠিক আছে কি-না। যদি ফ্লাইট বাতিল করে তাহলে আবার বাড়ি ফিরে যেতে হবে। রাত সাড়ে ৯টায় বিমানের ফ্লাইটের সময়। ৮টার দিকে জানতে পারবো সবকিছু ঠিক আছে কি-না।
সকাল ৮টায় ফেনী থেকে রওনা দিয়েছেন নুরুল আলম। দুপুর ১টায় বিমানবন্দরে এসে পৌঁছেছেন। তার বিমানের ফ্লাইট সাড়ে ৭টায়। সাড়ে ৬ ঘণ্টা এখন বিমানবন্দরের বাহিরে বসেই কাটাতে হবে তাকে। বলেন, আমরা কোনো ট্রাভেলসে গিয়ে চেক করতে পারছি না যে আমার বিমানের সময়টা বাতিল হলো কি-না। বাইরে কল দিলে টাকা ফুরায় কিন্তু কোনো কথা বোঝা যায় না। কোনো খোঁজখবর পাচ্ছি না। আমরা অনেক ভোগান্তির মধ্যে আছি।