শেষের পাতা
বেহাল স্বাস্থ্যখাত (৩)
ভুল চিকিৎসায় মৃত্যুর খবর আসছে অহরহ
ফরিদ উদ্দিন আহমেদ
১৫ জুলাই ২০২৪, সোমবার
দেশে ভুল চিকিৎসার হার বাড়ছে। ভুল চিকিৎসায় মৃত্যুর খবর আসছে অহরহ। এতে স্বাস্থ্যসেবায় ভরসা হারাচ্ছে সেবাপ্রত্যাশীরা। আস্থার ঘাটতি হওয়ার কারণে বিদেশে যাচ্ছেন রোগীরা। ভুল চিকিৎসা বা চিকিৎসায় অবহেলার শিকার হলে ক্ষতিগ্রস্তের প্রতিকার পাওয়ার যে ব্যবস্থাপনা, তা আসলে কতোটা কার্যকর, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল (বিএমডিসি)কে আরও শক্তিশালী করার তাগিদ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। একই সঙ্গে মেডিকেল লাইসেন্সিং পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করার পরামর্শ দিয়েছেন।
চিকিৎসা নিতে গিয়ে অন্যায্য আচরণ, অবহেলা বা ভুল চিকিৎসায় অঙ্গ বা প্রাণ হারানোর ঘটনায় ক্ষোভ-বিক্ষোভ বাংলাদেশে এক নিয়মিত ঘটনা। এসব ঘটনায় হাসপাতাল বা চিকিৎসকদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটে প্রায়ই, এর প্রতিক্রিয়ায় আবার চিকিৎসক ধর্মঘটে ভোগান্তির উদাহরণও কম নয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে চিকিৎসাসেবার ক্ষেত্র অতীতের তুলনায় উন্নত হলেও তা ধরে রাখতে ব্যর্থ হচ্ছে নানা কারণে। স্বাস্থ্যখাতে ব্যয় যত, সেবার মান ততটা উন্নত নয়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও মন্ত্রণালয় সারা দেশের হাসপাতালগুলো নিয়ন্ত্রণে চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে আসছে। সরকারি হাসপাতালের পরিচালক, বিভাগীয় পরিচালক (স্বাস্থ্য), সিভিল সার্জন, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স-কোথায়ও সঠিক মনিটরিং ব্যবস্থাপনা নেই। অর্থাৎ স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার গোড়াতেই গলদ। তারা বলেন- চিকিৎসা সেবার দুর্দশার পেছনে অযোগ্যতা, অদক্ষতা, অব্যবস্থাপনা, অনিয়ম, দুর্নীতি যেমন, তেমনি জনবলের ঘাটতিও কম দায়ী নয়। আধুনিক প্রশিক্ষিত ডাক্তার ও টেকনিশিয়ান নেই হাসপাতালগুলোতে।
ভুল চিকিৎসা প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ বলেন, ভুল চিকিৎসা সব দেশে আছে, বাংলাদেশেও আছে। তবে, বাংলাদেশে ভুল চিকিৎসার হার বাড়ছে। আমাদের এখনই এব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে হবে। অধ্যাপক ড. আব্দুল হামিদ আরও বলেন, যত্রতত্র মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল তৈরি করে আমরা কী ধরনের ডাক্তার বানাচ্ছি, তা সবাই জানে। ভালো ছাত্রকে ভর্তি করেছি। কিন্তু, রাষ্ট্র তাদের দক্ষ ডাক্তার বানাতে ব্যর্থ হয়েছে। তাই, জাতি তাদের হাতে নিরাপদ না। এজন্য চিকিৎসকদের কোয়ালিটি বাড়াতে রাষ্ট্রকে এখন খরচ করতে হবে। দেশে-বিদেশে প্রশিক্ষণ দিতে হবে। দেশে-বিদেশে ৩, ৬, ৯ বা ১২ মাসের প্রশিক্ষণ নিতে হবে। চিকিৎসা ক্ষেত্রে নতুন নতুন যে প্রযুক্তি আসবে তার সঙ্গে খাপ খাওয়াতে হবে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও বিএসএমএমইউ-কে এই দায়িত্ব দেয়া যেতে পারে।
বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল বা বিএমডিসিকে আরও শক্তিশালী করার পরামর্শ দিয়ে স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের সাবেক এই পরিচালক বলেন, মেডিকেল লাইসেন্সিং পরীক্ষা চালু করতে হবে। এটা বাধ্যতামূলক করতে হবে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এই পরীক্ষা আছে। প্রতি পাঁচ বছর পরপর সবাইকে এই পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে হবে। শুধু একবার না, প্রতিবারই পরীক্ষায় অংশ নিয়ে সনদ নবায়ন করতে হবে। তিনি বলেন, যদি এই পরীক্ষায় কোনো প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা খারাপ করে তখন সংশ্লিষ্ট মেডিকেল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চিন্তা করবে আমাদের ছাত্ররা লাইসেন্সিং পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হচ্ছে না। তখন তারা মনোযোগ দিয়ে ভালো লেখাপড়া করাবেন। গুণগত মান বৃদ্ধির চেষ্টা করবে ওই প্রতিষ্ঠান। তিনি বলেন, এখন বিদেশ থেকে এমবিবিএস পাস করে আসলে শুধু তাকে লাইসেন্সিং পরীক্ষা দিতে হয়, দেশে ডিগ্রি নিলে তাকে দিতে হচ্ছে না। তার পরামর্শ হলো-এই পরীক্ষা সবাইকে দিতে হবে। এক্ষেত্রে বিএমডিসি’র সক্ষমতা বাড়াতে হবে।
গত বছর ঢাকার বেসরকারি চিকিৎসালয় সেন্ট্রাল হাসপাতালে অবহেলায় প্রসূতি ও তার সন্তানের মৃত্যুর পর ভুল চিকিৎসার বিষয়টি ব্যাপকভাবে আলোচনায় এসেছে। এ ছাড়া একই বছরের ডিসেম্বর এবং চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে খতনা করাতে গিয়ে ভুল চিকিৎসায় দুই শিশুর মৃত্যুর ঘটনায় দেশে চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়ে মানুষের মধ্যে ব্যাপক নেতিবাচক প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। রাজধানীর মালিবাগের একটি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে সুন্নতে খতনা করাতে গিয়ে আহনাফ তাহমিদ আয়হাম (১০) নামে শিশুর মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। এই ঘটনায় পুলিশ দুই চিকিৎসককে আটক করে। শিশুটির পরিবারের পক্ষ থেকে থানায় দেয়া অভিযোগে বলা হয়, চলতি বছরের ২০শে ফেব্রুয়ারি আহনাফকে মালিবাগের জে এস ডায়াগনস্টিক অ্যান্ড মেডিক্যাল চেকআপ সেন্টারে ভর্তি করানো হয়। খতনা করার আগে অ্যানেসথেসিয়া দেয়ার পর তার আর জ্ঞান ফেরেনি। ‘লোকাল অ্যানেসথেসিয়া’ দেয়ার কথা থাকলেও ‘ফুল অ্যানেসথেসিয়া’ দেয়া হয় আহনাফকে। পরে ঘণ্টাখানেকের মধ্যে তাকে মৃত ঘোষণা করা হয়। আহনাফের বাবা ফখরুল আলম বলেন, অ্যানেসথেসিয়া দিতে নিষেধ করার পরও সেটি শরীরে পুশ করেন চিকিৎসক। তার অভিযোগ, এই মৃত্যুর দায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের। এর আগে গত ৩১শে ডিসেম্বর রাজধানীর সাতারকুলে ইউনাইটেড মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে খতনা করাতে এসে আরেক শিশুর মৃত্যু হয়। সেদিন খতনা করানোর জন্য শিশু আয়ান আহমেদকে পুরোপুরি অজ্ঞান করা হয়। এ ঘটনায় ভুল চিকিৎসার অভিযোগ এনে রাজধানীর বাড্ডা থানায় একটি মামলা করেছেন আয়ানের বাবা।
চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে অভিযোগের প্রতিকারের জন্য তদারকি সংস্থাটির নাম বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল বা বিএমডিসি। কিন্তু সেখানে অভিযোগকারীরা হতাশ। তারা বলছেন, অভিযোগ নিয়ে গেলে শুরুতেই তাদের নিরুৎসাহিত করা হয়, তারা বিশ্বাস করতে চায় না আর অভিযোগ নিলেও শুনানিতে দেরি হয়। আইনের বলে প্রতিষ্ঠিত সংস্থাটির ব্যবস্থা নেয়ার ক্ষমতাও সীমিত। খুব বেশি শাস্তি তারা দিতেও পারে না। সেই সঙ্গে আবার অভিযোগ রয়েছে, বিএমডিসি’র কর্তাব্যক্তিরা সবাই চিকিৎসক। তারা একই পেশার অন্যদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে অনাগ্রহ দেখান।
চিকিৎসার জন্য ভারতে রোগীদের যাওয়ার পেছনে দেশের চিকিৎসকদের আচরণ ও ভুল চিকিৎসার অভিযোগের বিষয়টি একাধিকবার স্বাস্থ্যমন্ত্রীর বয়ানেও উঠে এসেছে। কিন্তু এর প্রতিকার করতে পারতো যে সংস্থাটি, সেই বিএমডিসিকে শক্তিশালী ও কার্যকর করার কোনো দৃশ্যমান উদ্যোগ চোখে পড়ে না। ২৯ বছর বয়সী এক তরুণীকে ভুল চিকিৎসার অভিযোগ নিয়ে বছরখানেক আগে বিএমডিসিতে যান মেয়েটির বাবা। তবে সেখানে তিনি যথেষ্ট সহযোগিতা পাননি বলে অভিযোগ করেছেন।
বিএমডিসি’র তথ্য বলছে, ১৯৮০ সাল থেকে সংস্থাটি ফরমেশন শুরু হলেও অভিযোগ আসছে ২০১০ সাল থেকে। চলতি বছরের ৭ই জুলাই পর্যন্ত ১৩৯টি লিখিত অভিযোগ এসেছে সংস্থাটিতে। এরমধ্যে নিষ্পত্তি হয়েছে ৭১টি। বিচারাধীন ২১টি। সামপ্রতিক বছরগুলোয় অভিযোগের সংখ্যা কিছুটা বেড়েছে। ২০২৪ সালের জুলাই মাস পর্যন্ত অভিযোগ এসেছে ১৩ থেকে ১৪টি। ২০১০ সালে চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে এসেছিল চারটি অভিযোগ, ২০১৫ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় আটে। ২০১৬ সালে ছয়টি। পরের বছর ১৪টি এবং ২০১৮ ও ২০১৯ সালে জমা পড়ে ২৬টি করে অভিযোগ।
এ প্রসঙ্গে বিএমডিসি’র ভারপ্রাপ্ত ট্রেজারার ডা. লিয়াকত হোসেন তার দপ্তরে মানবজমিনকে বলেন, ভুল চিকিৎসা বা অবহেলার অভিযোগ পেলে তাদের সিরিজ বৈঠক করতে হয়। একটি বিষয় নিষ্পত্তি করতে ২ থেকে ৩ বছর লেগে যায়। একটি প্রক্রিয়ার মধ্যদিয়ে যেতে হয়। পদ্ধতিগত কারণে সময় লাগে। বিচার প্রক্রিয়ার কারণে দ্রুত ১ থেকে ৩ মাসে অভিযোগ নিষ্পত্তি করা সম্ভব হয় না। অভিযোগ এলে আমরা সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে বিচারের প্রক্রিয়া শেষ করি।
এদিকে, এবছরের ২৯শে জুন চিকিৎসায় অবহেলা ও মাত্রাতিরিক্ত ওষুধ প্রয়োগে রোগীর মৃত্যুর অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় দুই চিকিৎসকের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিয়েছে বিএমডিসি। ওই দুই চিকিৎসক হলেন-রাজধানীর বসুন্ধরার আকবর হেলথ কেয়ারের অধ্যাপক কর্নেল (অবসরপ্রাপ্ত) ডা. মো. নুরুল আজিম ও ডা. তানজিমা তাজরিন। বিএমডিসি জানিয়েছে, ভুল চিকিৎসা প্রমাণিত হওয়ায় ডা. মো. নুরুল আজিমকে পাঁচ বছর এবং ডা. তানজিমা তাজরিনের রেজিস্ট্রেশন এক বছরের জন্য স্থগিত করা হয়েছে। এ সময় তারা কোনো রোগীকে চিকিৎসা দেয়া বা চিকিৎসক হিসেবে পরিচয় দিতে পারবেন না বলে নির্দেশনায় উল্লেখ করা হয়েছে। সংস্থাটি জানায়, একমাত্র মেয়ে শ্রেয়শী আহমেদ ঐশীর (বয়স ১৭) ভুল চিকিৎসা ও অবহেলায় মৃত্যুজনিত কারণ উল্লেখ করে ২০২১ সালের ৩রা নভেম্বর বিএমডিসিতে অভিযোগ দাখিল করেন আহমেদ রসিদ ও শর্মিষ্ঠা আহমেদ। এতে কর্নেল অধ্যাপক ডা. মো. নুরুল আজিমকে অভিযুক্ত করা হয়। অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে কাউন্সিল অভিযোগকারী এবং চিকিৎসক উভয়ের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করে। পরবর্তীতে কাউন্সিল কর্তৃক গঠিত তদন্ত কমিটির তদন্তে প্রমাণিত হয়, তিনি একজন অভিজ্ঞ ও সিনিয়র বিশেষজ্ঞ হিসেবে তার পেশাগত দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে অবহেলা করেছেন। মাত্রাতিরিক্ত ওষুধ প্রয়োগের ফলে রোগীর মৃত্যু হয়। ডা. তানজিয়া তাজরিন মূলত ডা. নুরুল আজিমের তত্ত্বাবধানে কাউন্সেলিংয়ের কাজ করতেন। কাউন্সেলিংয়ের কাজে অদক্ষতা, অপেশাদারি আচরণ ও পেশাগত স্বীকৃত কাঠামো মেনে চলার অসামর্থ্য প্রতীয়মান হয়েছে। এ ছাড়া, ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ও তার ব্যবস্থাপনা বিষয়ক জ্ঞানেও উল্লেখযোগ্য ঘাটতি প্রমাণিত হয়েছে।
পাঠকের মতামত
নকল করে পাস হওয়া ডাক্তার দিয়ে চিকিৎসা করালে তো এমনই হবে। এখনকার বেশিরভাগ ডাক্তার টাকার বিনিময়ে সার্টিফিকেট কিনে ডাক্তার হয়েছে তারা ব্যাংক কাটতে জানে না মানুষ কেটে ফেলায়।
গত ২৫/০৬/২৪ তারিখে আমার ভাতিজা ভুল চিকিৎসা দেওয়ায় মারা গেছেন। ডাক্তারের কোন উত্তর নাই। শুধু বলেছেন, এটা একটা দূর্ঘটনা।ওই হাসপাতালে কোন শিশু ডাক্তার নাই। অথচ হাসপাতালের নাম মা ও শিশু হাসপাতাল, গাইবান্ধা