মত-মতান্তর
গণতন্ত্রের বিজয় জনগণের বিজয়
মোহাম্মদ আবুল হোসেন
১৬ জুলাই ২০২২, শনিবার
অবশেষে পদত্যাগ করলেন শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট গোটাবাইয়া রাজাপাকসে। এ খবরে আগের দিন বৃহস্পতিবার রাতেই বাঁধভাঙা উল্লাসে ফেটে পড়ে জনতা। তারা আতশবাজির উৎসবে মেতে ওঠে। রাজধানী কলম্বো যেন গণতন্ত্রের বিজয়ে, জনগণের বিজয়ে আনন্দে ফেটে পড়ে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এমন দৃশ্য শ্রীলঙ্কা আর দেখেনি কখনো। অথচ এর আগে গত দু’টি দিন গোটাবাইয়া দেশবাসীকে রাখেন দোদুল্যমানতায়। ঘটনাগুলো অপ্রত্যাশিত মোড় নিতে থাকে এ সময়ে। প্রথমে দেশের প্রধান নির্বাহী হিসেবে তিনি বিমান বাহিনীর বিমান ব্যবহার করেন। উড়ে যান মালদ্বীপে। সেখানে বিক্ষোভের মুখে উড়াল দেন সৌদি এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটে। বৃহস্পতিবার তা অবতরণ করেছে সিঙ্গাপুরে। তারপর তিনি কোথায় আছেন তা নিশ্চিত নয়। যদিও সেখান থেকে তার সৌদি আরবে যাওয়ার পরিকল্পনার কথা বলা হয় মিডিয়ায়। এসব দেশের মধ্যে উড়াউড়ি করলেও ১৩ই জুলাই পদত্যাগের যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তা রক্ষা করেননি। তবে শেষ পর্যন্ত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় সেই বহুল কাঙ্ক্ষিত পদত্যাগপত্র তিনি পাঠিয়েছেন ই-মেইলে। কিন্তু কেন এই বিলম্ব? কেন দেশবাসীকে এতটা লম্বা সময় অপেক্ষায় রেখে তিনি পদত্যাগ করলেন? তিনি তো জেনে গিয়েছিলেন, আর ক্ষমতায় থাকতে পারবেন না। তাহলে কি কূটকৌশল ছিল তার? প্রশ্নগুলোর উত্তর পরিষ্কার হয়ে গেছে বৃহস্পতিবার রাতেই। তাহলো তিনি একটি নিরাপদ আশ্রয় পাওয়ার আগে প্রেসিডেন্ট পদ ত্যাগ করতে চাননি।
এর কারণ, তিনি যেখানেই যাবেন সেখানেই প্রেসিডেন্সিয়াল ইমিউনিটি বা প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়মুক্তি পাবেন। তার বিচার হবে না। ফলে একবার যখন তিনি নিরাপদ আশ্রয় পেয়েছেন, তখন স্বস্তির নিঃশ্বাস নিয়ে পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দিয়েছেন। এই দায়মুক্তি পাওয়ার জন্য, প্রেসিডেন্ট হিসেবে বিশেষ সুবিধা পাওয়ার জন্য পদ ধরে রেখেছিলেন। এসব সরল সমীকরণের সমাধান বলে দেয় তিনি সিঙ্গাপুরে অবস্থান করছেন। অর্থাৎ নিরাপদ আশ্রয় না পাওয়া পর্যন্ত তিনি পদত্যাগ করতে চাননি। গতকাল সন্ধ্যায় যখন সিঙ্গাপুরে পৌঁছেন, তখনই পদত্যাগপত্র পাঠিয়েছেন। এর অর্থ বলে দেয়, তিনি সিঙ্গাপুরে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। সেখানকার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও নিশ্চিত করেছে তিনি সিঙ্গাপুরে প্রবেশ করেছেন প্রাইভেট ভিজিটে বা ব্যক্তিগত সফরে। তাহলে কি সিঙ্গাপুর তাকে আশ্রয় দিয়েই ফেলল নাকি এখান থেকে তিনি সৌদি আরব বা আরব বিশ্বের অন্য কোনো দেশে থিতু হবেন? এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজা সেই গণিতের অসমতা বিষয়ক সমীকরণের সমাধানের মতো।
যার উত্তর হতে পারে অসীম, অসংখ্য। আবার সসীম, পরিমেয়। অনলাইন দ্য হিন্দু লিখেছে, গোটাবাইয়া রাজধানী কলম্বোতে যে জনরোষ দেখেছেন তাতে তিনি নিশ্চিত হয়েছেন দেশে থাকলে তাকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে। এ অবস্থা থেকে মুক্তির একটিই পথ। তাহলো যদি তার নামের সঙ্গে প্রেসিডেন্ট শব্দটি না থাকে, তাহলে কলম্বোর বাইরে তিনি দায়মুক্তি বা বিশেষ সুবিধা পাবেন না। এজন্য পদটি ধরে রেখে তিনি প্রধানমন্ত্রী রণিল বিক্রমাসিংহের কাছে দায়িত্ব অর্পণ করেন। সংবিধানের ধারা অনুযায়ী, প্রেসিডেন্টের অনুপস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রী দেশের ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন। সেই কৌশলটিই ব্যবহার করেছেন গোটাবাইয়া। যাতে সাংবিধানিক সংকট সৃষ্টি না হয়, সেজন্য তিনি ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব অর্পণ করেন রণিল বিক্রমাসিংহের ওপর। সেই রণিল বিক্রমাসিংহেরও কি ঘুম আছে! জনতা তাকেও পছন্দ করে না। এরই মধ্যে তারও পদত্যাগ দাবি করেছে তারা। তিনি প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্থায়ই তার পদত্যাগ দাবি উঠেছে। এখন তিনি ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট। কিন্তু পদত্যাগের দাবিকে তিনিও আমলে নিচ্ছেন বলে মনে হয় না। একজন নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত না হওয়া পর্যন্ত তিনি ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করে যাবেন। এই হিসেবে পার্লামেন্ট অধিবেশন হয়তো শিগগিরই আহ্বান করা হবে। গতকাল শুক্রবার বসার কথা ছিল পার্লামেন্ট। কিন্তু তা বাতিল করা হয়েছে।
কিন্তু পার্লামেন্টে আনুষ্ঠানিকভাবে একজন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করলেই কি জনতার গণরোষ থেমে যাবে, যখন তাদের মধ্যে রণিল বিক্রমাসিংহের পদত্যাগ দাবি জোরালো হয়েছে? তাকেও গোটাবাইয়ার মতো একই রকম অসম্মান দেখাচ্ছে জনতা। হয়তো এ কারণে তিনি প্রতিবাদ বিক্ষোভ আরও তীব্র হবে বুঝতে পেরেছেন। তাই আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য যা যা করণীয় তা করতে সেনাবাহিনীকে নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু এই নির্দেশের ফলে শ্রীলঙ্কায় রক্ত ঝরেনি। সংঘাত অবশ্যই এড়িয়ে চলা উচিত। যত দ্রুত সম্ভব জনগণের দাবি মেনে নেয়া উচিত। এরই মধ্যে বিস্ময়ভরা চোখে বিশ্ব দেখেছে শ্রীলঙ্কার নাগরিকদের অধিকারের দাবিতে ক্ষোভ এবং অপ্রত্যাশিত সাহস। দিনের পর দিন অর্থনৈতিক সংকটের ফলে তাদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। নাগরিক সমাজ যখন একত্রিত হয়েছে, তখন তা রূপ নিয়েছে এক গণবিপ্লবের। আর তাতে ভেসে গেছে ‘রাজনৈতিক বর্ণবাদী শাসকগোষ্ঠী’। বিদেশি পর্যবেক্ষকরা একে দেখেছেন কর্তৃত্ববাদী শাসকদের, ক্ষমতালোভী রাজনীতিকদের এবং তাদের লোকজনদের সত্যিকার পরিণতি হিসেবে। তবু এখন সামনে এটা দেখার বাকি থাকলো যে, শ্রীলঙ্কার রাজনীতিকরা এ থেকে কোনো শিক্ষা নেন কিনা।