ঢাকা, ২৫ মার্চ ২০২৫, মঙ্গলবার, ১১ চৈত্র ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২৪ রমজান ১৪৪৬ হিঃ

শেষের পাতা

দুদকের ২ মামলা, ফেঁসে গেছেন মিহির ও শিল্পী

জাবেদ রহিম বিজন, ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে
৬ জুলাই ২০২৪, শনিবারmzamin

জেলা শহরের প্রাণকেন্দ্রে পাঁচতলা বাড়ি, নিজের থাকার ফ্ল্যাটে একাধিক এসি। ৩ হাজার টাকায় স্পিডবোট রিজার্ভ করে যাওয়া-আসা করতেন অফিসে। ২০১৯ সালে দৈনিক মানবজমিন-এ এমন রিপোর্ট প্রকাশের পরই ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আলোচিত সরকারি কর্মচারী মিহির কুমার ঘোষের (৫১) বিরুদ্ধে  দুর্নীতি দমন কমিশনের অনুসন্ধান শুরু হয়। অবশেষে ২টি মামলা হয়েছে এই সরকারি কর্মচারীর বিরুদ্ধে। বুধবার দুর্নীতি দমন কমিশন এসব মামলা দায়ের করে। একটি মামলায় তার স্ত্রী শিল্পী রানী ঘোষকে আসামি করা হয়েছে। শিল্পী দুদকে দেয়া হিসাব বিবরণীতে ২ হাজার টাকা পুঁজির ব্যবসা থেকে ৫ লাখ ৭৩ হাজার টাকা আয় দেখিয়েছেন। ব্যবসার এই আয় থেকে ৫তলা বাড়ি করার উল্লেখ করেন। আর দুদকের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে অস্তিত্বহীন সেই ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। যার নেই কোনো ব্যাংক হিসাব, কর্মচারী, হিসাবপত্র। আর সে কারণেই ফেঁসে গেছেন মিহিরপত্নী শিল্পী রানী ঘোষ (৪২)। দুদকের কুমিল্লা সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের উপ-সহকারী পরিচালক মো. ইমরান খানের দেয়া এজাহার দু’টির একটিতে প্রধান আসামি করা হয়েছে তাকে। স্বামী মিহিরকে করা হয়েছে ২ নম্বর আসামি। এছাড়া মিহিরের বিরুদ্ধে আরেকটি মামলা দেয়া হয়। মামলায় দুদকে দেয়া সম্পদ বিবরণীতে মিথ্যা তথ্য প্রদান ও জ্ঞাত-আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ আনা হয় তাদের বিরুদ্ধে। মিহির ও শিল্পী ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের প্রধান সড়ক টিএ রোড সংলগ্ন বণিকপাড়ার ২০/১ নম্বরের ৫তলা বাড়ির (সৈকত ভবন) বাসিন্দা।  মিহির বর্তমানে  জেলার বিজয়নগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়ে অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক পদে কর্মরত। 

দুদকের মামলার এজাহার সূত্রে জানা যায়, ২০১৯ সালে অনুসন্ধান শেষে প্রাথমিক তথ্যের ভিত্তিতে শিল্পী রানী ঘোষের প্রতি দুর্নীতি দমন কমিশন ২০২১ সালের ১৬ই আগস্ট সম্পদ বিবরণী নোটিশ ও ফরম জারি করে। এরপর ওই বছরের ৯ই সেপ্টেম্বর সম্পদ বিবরণী জমা দেন শিল্পী।  যাতে ২০১০-১১ সালে (আয়কর নথি খোলার ভিত্তি বছরে) আয়কর নথির সঙ্গে সংযুক্ত রেকর্ডপত্রে ব্যবসা থেকে ২৮ লাখ ৬৩ হাজার টাকা উত্তোলন দেখান তিনি। কিন্তু দুদক অনুসন্ধানে নেমে তার ব্যবসা সংক্রান্ত গ্রহণযোগ্য কোনো রেকর্ডপত্র পায়নি। তার নামীয়/তার ব্যবসার আয়-ব্যয়ের হিসাব পত্র, কর্মচারীর তথ্য, ফার্মের অস্তিত্ব, ক্যাশ রেজিস্টার ও ব্যবসা সংক্রান্তে কোনো ব্যাংক একাউন্ট নেই। তার ২০১০-১১ সালের আয়কর নথি পর্যালোচনায় দুদক দেখতে পায়, ওই আয়বর্ষে ব্যবসা থেকে তিনি আয় দেখিয়েছেন ৫ লাখ ৭৩ হাজার টাকা। অথচ সেই সময়ে ব্যবসার পুঁজি দেখিয়েছেন মাত্র ২ হাজার টাকা। এজাহারে বলা হয়, এতে প্রতীয়মান হয়, আয়কর নথি খোলার আগে তার নামে কোনো প্রকার ব্যবসা ছিল না। তার স্বামী মিহির কুমার ঘোষের অবৈধ পন্থায় উপার্জিত অর্থ দিয়ে তিনি ওই বছর ৫তলাবিশিষ্ট বাড়ি নির্মাণ করেন। শিল্পী দুদকে দাখিলকৃত সম্পদ বিবরণীতে তার ৩৬ লাখ ৬৬ হাজার ৭৮২ টাকার স্থাবর সম্পদ এবং ১৫ লাখ ৬৮ হাজার ৪১ টাকার অস্থাবর সম্পদ (উপহার বাদে) থাকার ঘোষণা দেন। দায়- দেনা কোনো কিছু নেই মর্মে উল্লেখ করেন। কিন্তু সম্পদ বিবরণী যাচাইকালে তার নামে ৩৯ লাখ ৫৬ হাজার ২৬ টাকার স্থাবর সম্পদ ও ১৫ লাখ ৬৮ হাজার ৪১ টাকার অস্থাবর সম্পদ অর্জনের তথ্য পায় দুদক। ওই সময়ে তার মোট স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ পাওয়া যায় ৫৫ লাখ ২৪ হাজার ৬৭ টাকার। 

একই সময়ে তার পারিবারিক ও অন্যান্য ব্যয় পাওয়া যায় ৮ লাখ ২৬ হাজার ২৯১ টাকা। পারিবারিক ব্যয়সহ তার নামে অর্জিত মোট পরিসম্পদ পাওয়া যায় ৬৩ লাখ ৫০ হাজার ৩৫৮ টাকার। তিনি আয়কর নথি খোলেন ২০১০-১১ করবর্ষে। আয়কর নথি খোলার সময় আগের উপহার হিসেবে প্রাপ্ত স্বর্ণ বিক্রি থেকে আয়, সঞ্চয় এবং আয়কর নথি খোলার পরের গৃহ সম্পত্তি ও ব্যবসা  থেকে আয় পাওয়া যায় ৩৪ লাখ ৭৫ হাজার ৮১৯ টাকা। এক্ষেত্রে শিল্পী রানী ঘোষের জ্ঞাত-আয়ের সঙ্গে সম্পদের তারতম্য ধরা পড়ে। ফলে তার জ্ঞাত-আয় বহির্ভূত সম্পদের পরিমাণ দাঁড়ায় ২৮ লাখ ৭৪ হাজার ৫৩৯ টাকা।  এছাড়াও দুদকে দাখিলকৃত সম্পদ বিবরণীতে সর্বমোট ৫২ লাখ ৩৪ হাজার ৮২৩ টাকার স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ থাকার ঘোষণা দেন। কিন্তু যাচাইকালে তার নামে স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ পাওয়া যায় ৫৫ লাখ ২৪ হাজার ৬৭ টাকা। অর্থাৎ সম্পদ বিবরণীতে ২ লাখ ৮৯ হাজার ২৪৪ টাকার তথ্য গোপন করেন। শিল্পী রানী ঘোষ সম্পদ বিবরণীতে ২ লাখ ৮৯ হাজার ২৪৪ টাকার সম্পদের তথ্য গোপন করে মিথ্যা হিসাব দাখিল করেন এবং ও তার স্বামী মিহির কুমার ঘোষের অবৈধ সহায়তায় অসৎ উদ্দেশ্যে ২৮ লাখ ৭৪ হাজার ৫৩৯ টাকার জ্ঞাত-আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন করে ভোগদখলে রেখে দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, ২০০৪ এর ২৬(২) ও ২৭(১) ধারা এবং দণ্ডবিধির ১০৯ ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন বলে এজাহারে উল্লেখ করা হয়।

মিহির কুমার ঘোষের বিরুদ্ধে দুদকে দেয়া সম্পদ বিবরণীতে মিথ্যা হিসাব প্রদান করার অভিযোগে আরেকটি মামলা হয়। সম্পদ বিবরণীতে স্থাবর সম্পদ ২৩ লাখ ৬০ হাজার টাকার এবং অস্থাবর সম্পদ (উপহার বাদে) ১৫ লাখ ১০ হাজার ৯৬৯ টাকার মর্মে ঘোষণা দেন। কিন্তু যাচাইকালে তার নামে স্থাবর সম্পদের পরিমাণ ২৩ লাখ ৬০ হাজার টাকা ঠিক পাওয়া গেলেও অস্থাবর সম্পদ পাওয়া যায় ১৮ লাখ ৮৭ হাজার ৬৯১ টাকার। ৩ লাখ ৭৬ হাজার ৭২২ টাকার সম্পদের তথ্য গোপন করার অভিযোগ আনা হয় তার বিরুদ্ধে।

১৯৯৬ সালে সরকারি চাকরিতে যোগ দেন মিহির কুমার ঘোষ। প্রথম পোস্টিং জেলার বাঞ্ছারামপুরে। এরপর জেলা প্রশাসকের কার্যালয়। সেখান থেকে পর্যায়ক্রমে  জেলার বিভিন্ন উপজেলায় পোস্টিং হয় তার। পোস্টিংয়ে সবসময় মাল কামানোর জায়গাকেই বেছে নেন। কিন্তু সব কর্মস্থল থেকে বদলি হতে হয় তাকে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ কাঁধে নিয়ে। ২০১৭ সালের আগস্ট থেকে দু’বছর নবীনগর সহকারী কমিশনার-ভূমির অফিসে চাকরিকালে ওই অফিসকে দুর্নীতির আখড়া বানান। স্পিডবোট রিজার্ভ করেই নবীনগরের অফিসে যাওয়া-আসা করতেন।   সেখান থেকে নাসিরনগরে  যোগ দিয়েও মজে ওঠেন অনিয়ম-দুর্নীতিতে। তার বিরুদ্ধে বাজার ইজারায় সরকারের দেড় কোটি টাকা  লোকসান করে দেয়ার অভিযোগ ওঠে। ব্যক্তিগত সুবিধার বিনিময়ে সরকারের রাজস্ব আয়ে ব্যাঘাত সৃষ্টি করেন মিহির। ২০২১ সালের ২৭শে সেপ্টেম্বর তৎকালীন জেলা প্রশাসক হায়াত-উদ- দৌলা খান ওই অফিস পরিদর্শনে গিয়ে হাটবাজার ইজারার হিসাবে গরমিল পেয়ে মিহিরকে আটক করার নির্দেশ দেন। আশুগঞ্জ, বিজয়নগর ও কসবা উপজেলাতে চাকরি করার সময়ও তার বিরুদ্ধে উঠে অভিযোগ। 

জেলা শহরের প্রধান সড়ক টিএ রোডের পাশেই বণিকপাড়ায় পৌনে ৪ শতক জায়গার ওপর ৫তলা বাড়ি করেছেন মিহির কুমার ঘোষ। বাড়ির ফ্লোর ও সিঁড়িতে ব্যবহার করেছেন দামি পাথর। আর সেসব আনা হয় ঢাকা থেকে। তার থাকার ফ্ল্যাটে আছে একাধিক এসি। ৪টি সিসি ক্যামেরা লাগানো আছে বাড়িটিতে নিরাপত্তা ব্যবস্থা হিসেবে। ২০০৭ সালে এই বাড়ি করার সময়েই আলোচিত হন মিহির। মিহির যে জায়গায় বাড়ি করেছেন এর প্রতিশতক জায়গার মূল্য প্রায় ৪০ লাখ টাকা। তার একটি গাড়ি আছে বলেও জানান প্রতিবেশীরা।

পাঠকের মতামত

এই জন্যইতো ‘‘অফিস সহকারী ”পদে চাকরি পেতেও না কি15/20 লেগে যায়!

md. Shahjahan Siraj
৬ জুলাই ২০২৪, শনিবার, ২:১৩ অপরাহ্ন

এই দুর্নীতির মামলায় দোষী কেউ হবে না। প্রতিবেশীর সাথে চুক্তি আছে।

Khokon
৬ জুলাই ২০২৪, শনিবার, ১২:০১ অপরাহ্ন

শেষের পাতা থেকে আরও পড়ুন

শেষের পাতা সর্বাধিক পঠিত

   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status