শেষের পাতা
নিজ বাড়িতে পুলিশ কর্মকর্তার বাবা-মা’কে কুপিয়ে হত্যা
স্টাফ রিপোর্টার
২১ জুন ২০২৪, শুক্রবার
পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের উপ-পরিদর্শক (এসআই) আল-আমিন ওরফে ইমনের বাবা শফিকুর রহমান (৬০) ও মা ফরিদা ইয়াসমিন (৫০)কে নিজ ঘরের ভিতরে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। গতকাল ভোররাতে রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর কোনাপাড়া এলাকার পশ্চিম মোমেনবাগের আড়াবাড়ি বটতলার ১৭৫ নম্বর বাড়িতে এ ঘটনা ঘটে। জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯-এ খবর পেয়ে সকালে তাদের লাশ উদ্ধার করে যাত্রাবাড়ী থানা পুলিশ। স্বজনদের দাবি- গ্রামের বাড়ির জমিজমা নিয়ে বিরোধের জেরে এই হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছে।
নিহত শফিকুর রহমানের প্রতিবেশী ও আড়াবাড়ি বটতলা এলাকার বাসিন্দা মো. পারভেজ হোসেন বলেন, ইমনের বাবা শফিকুর রহমান প্রতিদিন ভোরে নামাজ পড়তে মসজিদে যেতেন। মসজিদে যাওয়ার সময় তিনি পানির মোটর চালু করে গেটের তালা খুলে বাইরে যেতেন। আর নামাজ পরে ফিরে আবার তালা খুলে ভিতরে প্রবেশ করে মোটর বন্ধ করতেন। ইমনের মা ফরিদা ইয়াসমিন সে সময় তার ঘরেই থাকতেন। কিন্তু গতকাল সকালে ইমনদের বাড়ির পানির ট্যাংকি উপচে বাড়ির বাইরে পানি পড়ছিল। বাইরে থেকে লোকজন চিৎকার করলেও কেউ বন্ধ করছিল না। একপর্যায়ে তাদের বাসার ৪ তলার ভাড়াটে এক নারী নিচতলায় নেমে মোটরের সুইচ বন্ধ করেন। এ সময় তিনি পার্কিংয়ের এক পাশে ইমনের বাবা শফিকুরকে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে চিৎকার শুরু করেন। দুই তলায় তাদের শোবার ঘরে ইমনের মা পড়ে আছেন। পরে ৯৯৯-এ ফোন দিলে যাত্রাবাড়ী থানা থেকে পুলিশ এসে লাশ উদ্ধার করে। তিনি বলেন, শফিকুর দম্পতি দীর্ঘদিন ধরে আমাদের এই এলাকায় বসবাস করছেন। আগে ভাড়া থাকতেন। এখন বাড়ি করেছেন। কখনো কারও সঙ্গে তাদের কোনো ঝগড়া-বিবাদ দেখিনি। ইমনদের বাড়ির ভাড়াটিয়াদের দাবি- বাড়ির মধ্যে জোড়া খুনের ঘটনা ঘটলেও তারা কেউ কিছু টের পাননি।
নিহত শফিকুরের মেয়ে জামাই আরিফুর রহমান বাপ্পী বলেন, এটা কোনো ডাকাতির ঘটনা নয়। ঘরের মধ্যে আলমারি খোলা থাকলেও তেমন কোনো মালামাল খোয়া যায়নি। শাশুরির গলায় স্বর্ণের চেইন, মোবাইল সবই রয়েছে। তিনি বলেন, এটি একটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। তার শ্বশুর শফিকুর রহমানের গ্রামের বাড়ি ফেনীর দাগনভূঁঞার রামচন্দ্রপুরে। সেখানে জমিজমা নিয়ে প্রতিপক্ষের সঙ্গে তাদের বিরোধ চলছিল। এর জের ধরে এই হত্যাকাণ্ড চালানো হয়েছে।
ঘটনাস্থলে যাওয়া যাত্রাবাড়ী থানার পরিদর্শক (অপারেশন) মো. তৌহিদুল হক মামুন বলেন, আমরা সকাল ৭টার দিকে ৯৯৯-এর ফোন পেয়ে ঘটনাস্থলে আসি। দেখি ভবনের পার্কিংয়ে ইমনের বাবা শফিকুরের রক্তাক্ত লাশ পড়ে আছে। তার গলা ও মাথায় ধারালো অস্ত্রের আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। পরে দোতলায় গিয়ে তাদের শোবার ঘরের মশারির ভেতর মা ফরিদার লাশ জড়িয়ে রয়েছে। তারও মাথাসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে ধারালো অস্ত্রের আঘাতের চিহ্ন দেখা গেছে। নিচতলা থেকে শুরু করে ভবনটির ৪ তলা পর্যন্ত সিঁড়িতে পায়ের রক্তাক্ত ছাপ। আমরা ধারণা করছি রাতের যেকোনো সময় বাসায় ঢুকে তাদের দুইজনকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে।
যাত্রাবাড়ী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল হাসান বলেন, নিহত শফিকুর রহমান জনতা ব্যাংকের সাবেক গাড়িচালক ছিলেন। তার ছেলে ইমন পুলিশে চাকরি করেন। বর্তমানে তিনি পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চে কর্মরত। সম্প্রতি তারা পশ্চিম মোমেনবাগের আড়াবাড়ি বটতলায় নতুন একটি ৪ তলা বাড়ি তৈরি করেছেন। বাড়িটির এখনো পুরোপুরি কাজ শেষ হয়নি। ভবনের দুই তলায় ছেলে ইমনের স্ত্রীসহ শফিক দম্পত্তি থাকতেন। আর নিচতলা, তিনতলা ও চারতলা ভাড়া দেয়া আছে। শফিকুলের মেয়ের বিয়ে হয়ে যাওয়ায় তিনি তার স্বামীর সঙ্গে যাত্রাবাড়ীর মোমেনবাগের কাছেই থাকেন। বুধবার ঈদের ছুটি কাটাতে ইমন দাদাবাড়ি ফেনীতে যায়। ইমনের স্ত্রীও তার বাবার বাড়িতে গিয়েছিলেন। এই সুযোগেই হত্যাকাণ্ডটি ঘটানো হয়েছে। ওসি বলেন, ঘটনাস্থল থেকে সিআইডি বিভিন্ন আলামত সংগ্রহ করেছে। নিহত শফিকুর দম্পত্তির ছেলে ইমনও বাবা-মায়ের হত্যার খবর পেয়ে গতকাল দুপুরে ফেনী থেকে ঢাকায় ফিরেছেন। এ বিষয়ে মামলাও প্রক্রিয়াধীন। সবদিকই আমরা ক্ষতিয়ে দেখছি। লাশ ময়নাতদন্তের জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়েছে বলেও জানান এই পুলিশ কর্মকর্তা।
এ বিষয়ে ডিএমপির ওয়ারী বিভাগের উপ-কমিশনার মো. ইকবাল হোসাইন বলেছেন, বাসার নিচের প্রধান ফটক ও ঘরের দোতলার দরজা খোলা ছিল। নিহত শফিকুরের কাছে বাসার প্রধান ফটকের চাবি পাওয়া গেছে। বাসার পেছনের দেয়াল-লাগোয়া একটি ভবন বেয়ে এই ভবনে ওঠা যায়। ধারণা করা হচ্ছে, ভোরে ঘটনাটি ঘটেছে। নিহত শফিকুর নামাজ পড়তে বেড় হলে ওত পেতে ছিল খুনিরা। নামাজ পড়ে ফেরার সময় খুনিরা প্রথমে শফিকুরকে হত্যা করে। পরে তারা দোতলায় উঠে তার স্ত্রীকে হত্যা করে। এটা ডাকাতির ঘটনা নয়, পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড দাবি করে তিনি বলেন, পূর্বশত্রুতার জের ধরে এই জোড়া খুনের ঘটনা ঘটেছে। কারণ বাসার আলমারি খোলা পাওয়া গেছে। কিন্তু ইমনের নিহত মায়ের গলায় স্বর্ণের চেইন ঠিকই ছিল। মোবাইলও খোয়া যায়নি। আর খুনিরা বিশেষ করে ইমনের বাবা শফিকুরের গলাতেই একের পর এক কোপ দিয়েছে। মৃত্যু নিশ্চিত করতেই তারা শরীরের অন্য স্থান বাদে শুধু গলাতেই কুপিয়েছে। তিনি বলেন, চারতলা পর্যন্ত পায়ের রক্তাক্ত ছাপ দেখা যায়। এমনও হতে পারে, খুনিরা হত্যাকাণ্ডের পর বাড়ির ছাদ দিয়ে পেছনের দিক দিয়ে নেমে যেতে পারে। তবে খুনিদের শনাক্তে আমরা আশেপাশের সিসিটিভি ক্যামেরা যাচাই-বাছাই করছি। একইসঙ্গে ঘটনা তদন্তে ও হত্যাকাণ্ডের প্রকৃত রহস্য উদ্ঘাটনে যাত্রাবাড়ী থানা পুলিশের ৩টি দল গঠন করা হয়েছে। তদন্তের পর এ বিষয়ে বিস্তারিত বলা যাবে।
পাঠকের মতামত
মর্মান্তিক!৷ আল্লাহপাক জান্নাতুল ফেরদৌস দান করুন। আমিন।