মত-মতান্তর
টালমাটাল ইউরোপের রাজনীতি: উগ্র-ডানপন্থীদের উত্থান, ইউরো মুদ্রার দরপতন!
নিয়াজ মাহমুদ, ইউরোপ থেকে
(১ বছর আগে) ১১ জুন ২০২৪, মঙ্গলবার, ৮:০৮ অপরাহ্ন
সর্বশেষ আপডেট: ১১:৩৬ পূর্বাহ্ন

সর্ববৃহৎ নির্বাচন দেখল ইউরোপবাসী। টালমাটাল ইউরোপের রাজনীতি! ইইউ নির্বাচনে পরাজয়, পদত্যাগের ঘোষণা দিলেন বেলজিয়ামের প্রধানমন্ত্রী। ফ্রান্সে ঘটেছে অঘটন, চমক। উগ্র-ডানপন্থীদের উত্থান! ডানপন্থীদের কাছে ধরাশায়ী হয়ে আগাম জাতীয় নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েছেন ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ। আগাম নির্বাচনের ঘোষণার পর সোমবার থেকে ইউরো মুদ্রার দরপতন হয়েছে। চলতি মাসের মধ্য ইউরোর ছিলো সর্বনিম্ন রেট ।
ইউরোপের চারদিকে -উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব, পশ্চিম সর্বত্রই রং বেরং এর উগ্র-ডানপন্থীদের উত্থান ঘটছে। এদের কেউ অতীতচারী বা নস্টালজিক জাতীয়তাবাদী, কেউবা লোকরঞ্জনবাদী বা পপুলিস্ট জাতীয়তাবাদী, কেউ আবার নব্য-ফ্যাসিস্ট শিকড় থেকে গজানো কট্টর রক্ষণশীল পার্টি। বিংশ শতাব্দীতে ইউরোপে নাৎসি জার্মানি আর ফ্যাসিস্ট ইতালির বিরুদ্ধে যে ব্যাপক যুদ্ধ হয়েছিল-তারপর এখানে বেশির ভাগ ভোটারের মনে একরকম অনুভূতি তৈরি হয়ে গিয়েছিল যে চরম ডানপন্থীদেরকে আর কখনো ভোট দেয়া যাবে না। মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলো উগ্র ডানপন্থী দলগুলোর সাথে সহযোগিতা করতে অস্বীকার করতো। কিন্তু সেই সব পুরোনো 'ট্যাবু' এখন আস্তে আস্তে কেটে যাচ্ছে। মুদ্রাস্ফীতি, বেকারত্ব, অভিবাসন এসব নিয়ে বিরক্ত এবং ক্ষুব্ধ। তারা সরকারের কাছ থেকে সুরক্ষা চায়। বামপন্থী দলগুলো এই সব মানুষদের সাথে সংযোগ হারিয়ে ফেলেছে। সেজন্যই তারা ডানপন্থীদের দিকে মুখ ফিরিয়েছে। ইউরোপীয় পার্লামেন্ট নির্বাচনে ডানপন্থীদের উত্থানকে উদ্বেগের কারণ হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকেরা। এখানে হতাশ হলে তারা হয়তো আবার বামপন্থীদের দিকে তাকাবে। মানুষের সমর্থন পেন্ডুলামের মতো একবার এদিকে একবার ওদিকে যাবে - গণতন্ত্রে এটা খুবই স্বাভাবিক। প্রশ্ন হচ্ছে - যারা ক্ষমতায় আসছে তাদের দেশ পরিচালনার সক্ষমতা আছে কিনা। "বিশ্বজুড়ে ইউরোপীয় পার্লামেন্টকে ইউরোপীয় জাতিসত্তার আয়না বলা হয়ে থাকে।
অনেক ফরাসি ভোটার ব্যালটবক্সে ইইউ নির্বাচনে অর্থনীতি, কৃষি প্রবিধান বা নিরাপত্তা বিষয়ে ম্যাক্রোঁর ব্যবস্থাপনা নিয়ে তাদের অসন্তোষ প্রকাশ করে এ রায় দিয়েছেন। পাশাপাশি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে ক্রয়ক্ষমতা কমে যাওয়া। ইউরোপীয় পার্লামেন্টের ন্যাশনাল র্যালির অন্যতম প্রার্থী জর্ডান বারডেলা ইইউ-এর মুক্ত সীমান্তের মধ্যে অভিবাসীদের অবাধ চলাচল সীমিত করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে এ চমক দেখান। তিনি ইউরোপীয় ইউনিয়নের জলবায়ু বিধিগুলোও ফিরিয়ে আনতে চান।
ফরাসি মূলধারার রাজনীতির সাথে জড়িত এবং ফ্রান্সের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল Les Repiblicains এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য বাংলাদেশি সোহেল ইবনে হোসেন বলেন, আগাম নির্বাচনে ইউরোপ বিরোধীরা ক্ষমতায় আসলে শুধু ফ্রান্স নয়, ইউরোপীয় ইউনিয়নের ক্ষতি হবে। তবে আশার কথা উপনির্বাচনে যেই ক্ষমতায় আসুক, ক্ষমতায় থাকতে পারবে তিন বছর। ফরাসিদের দেখা উচিৎ উগ্র ডানপন্থীদের খপ্পরে পরলে কি হয়! ফ্রাংকো-বাংলাদেশিদের প্রতি আমার অনুরোধ যত কাজই থাকুক ৩০ শে জুন এবং ৭ ই জুলাই ভোট দানে বিরত থাকবেন না।
ম্যাক্রোর মতো জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎজের জন্যও এই নির্বাচন দুঃসংবাদ হয়ে এসেছে। নির্বাচনে তাঁর সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টি সবচেয়ে বাজে ফল করেছে। অতি ডানপন্থী অলটারনেটিভ ফর জার্মানি (এএফডি) দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছে। অবশ্য ভালো ফল করেছে ইতালির প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনির দল। ইউরোপীয় পার্লামেন্ট নির্বাচনে পরাজয়ের পর পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছেন বেলজিয়ামের প্রধানমন্ত্রী আলেক্সান্ডার ডি ক্রু। তার দল মাত্র ৫ দশমিক ৯ শতাংশ ভোট পেয়েছে। ইউরোপের পার্লামেন্টে এমন শোচনীয় হারের পরই পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছেন।
ইউরোপীয় পার্লামেন্ট নির্বাচনে কোনো দল থেকে ব্যক্তিবিশেষ সরাসরি ভোটে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারেন না। শুধু দলভিত্তিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়। নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী প্রতিটি দল ইউরোপীয় পার্লামেন্টের সম্ভাব্য সংসদ সদস্য হওয়ার জন্য তালিকা তৈরি করে। যেকোনো দল তাদের প্রাপ্ত ভোটের অনুপাত অনুযায়ী সংসদ সদস্যপদ লাভ করে।
ফলাফল পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে, ইউরোপের প্রধান রাজনৈতিক দল ইউরোপিয়ান পিপলস পার্টি (ইপিপি) এবারও সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে। তারা পেয়েছে ১৮৯টি আসন। ইপিপির ১৩টি আসন বেড়েছে। ২০১৯ সালে তারা পেয়েছিল ১৭৮ আসন। আর ২০১৪ সালের নির্বাচনে ইপিপি পেয়েছিল ২২১ আসন। অন্যদিকে, দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা ইউরোপের সোশ্যালিস্ট ও ডেমোক্রেটদের জোট এস এন্ড ডি পেয়েছে ১৩৫টি আসন। এসএন্ডডির ৪টি আসন কমেছে। ২০১৯ সালে তারা পেয়েছিল ১৪৭ আসন। ইউরোপীয়রা ২০১৯ সালে শেষ ভোটে ৭৫১ জন আইনপ্রণেতাকে নির্বাচিত করেছিল। পরের বছর ব্রিটেন ইইউ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর ইউরোপীয় পার্লামেন্টের (এমইপি) সদস্য সংখ্যা ৭০৫ এ নেমে আসে। বর্তমান নির্বাচনের পর ইউরোপীয় পার্লামেন্টে ১৫ জন অতিরিক্ত সদস্য থাকবেন। ফলে মোট সংখ্যা দাঁড়াবে ৭২০ জন। ইউরোপীয় ইউনিয়নের তিনটি প্রধান ইনস্টিটিউটের মধ্যে ইউরোপীয় পার্লামেন্ট অন্যতম। এ ছাড়া বাকি দু’টি হলো ইউরোপীয় কমিশন এবং ইউরোপীয় কাউন্সিল। ইউরোপীয় পার্লামেন্ট বা পার্লামেন্টের সদস্যরা মূলত জোটভুক্ত দেশগুলোর জনগণের প্রতিনিধিত্ব করে। ইউরোপীয় পার্লামেন্ট জোটের বিভিন্ন বিষয়ে আইনপ্রণেতা হিসেবে কাজ করে। জোটের বাজেটের ক্ষেত্রেও ইইউ পার্লামেন্টে সম্মতির প্রয়োজন হয়। ইউরোপীয় কমিশন জোটের প্রশাসনিক বিষয়াদি এবং ইউরোপীয় কাউন্সিল সদস্য রাষ্ট্রগুলোর সরকারগুলোর প্রতিনিধি–সংবলিত কমিটি। ইইউ পার্লামেন্টের সদস্যরাই তাদের পছন্দমতো ভোট দিয়ে পাঁচ বছরের জন্য ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করেন।