মত-মতান্তর
বাংলাদেশে স্মার্ট কৃষির প্রবর্তন এবং যন্ত্রায়নবান্ধব কৃষি ব্যবস্থাপনা
মো. আমির হোসাইন
২০ মে ২০২৪, সোমবারফসল উৎপাদন কার্যক্রমের মধ্যে সঠিক ফসল কর্তন ও কর্তনোত্তর কাজ সবচেয়ে শ্রম, ব্যয় ও দক্ষতানির্ভর। ফসল উৎপাদনের ৮-১০ ধরনের কাজের মধ্যে কেবল এ কাজেই প্রায় ২৫-৩০% ব্যয় হয়ে থাকে। বাংলাদেশে বর্তমান কৃষি শ্রমিক ঘাটতি, কর্মক্ষম তরুণ সমাজের অনভিজ্ঞতাপ্রসূত অদক্ষতা ইত্যাদি বিবেচনা করে ফসল কর্তন কমিউনিটি তৈরি করতে হবে। এজন্য তৃণমূল পর্যায়ে জমির মালিক ও যন্ত্রচালক-ব্যবস্থাপক পারিবারিক গ্রুপ প্রশিক্ষণ দিয়ে “জমি যার ফসল-আয় তার” ভিত্তিতে সামাজিক যৌথ খামার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। গবেষণায় হিসাব করা হয়েছে ১ হেক্টর জমির ধান দেশি কাঁচিদ্বারা কাটতে ২৫০ শ্রম ঘণ্টা (গ্রামীণ ৪০-৫০ জন শ্রমিক/হাজিরা ৪০০-৫০০ টাকা হিসাবে ১৬-২০ হাজার টাকা লাগে। অথচ একটি উপযুক্ত হারভেস্টার ব্যবহার করলে এ ব্যয় অর্ধেকে নেমে আসবে
বলা যায়, দেশের কৃষি সুরক্ষার জন্য কৃষি যন্ত্রায়ন অত্যাবশ্যক। এ বিষয়ে সামপ্রতিক গবেষণা থেকে (মোস্তাফিজুর রহমান ও সহ-গবেষকবৃন্দ, ২০২১) সুপারিশ পাওয়া যায় যে, স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত যন্ত্রাদির কর্মসূক্ষ্মতা কম, গরিব কৃষকের জন্য যন্ত্র ভাড়াভিত্তিক কাস্টমাইজ মালিকানা মডেলের কার্যকর উপযোগিতা এবং কার্যক্রমের স্থায়িত্বশীলতার জন্য তরুণের অংশীদারিত্ব নিশ্চিতকরণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
বর্তমানে দেশে সেচ ও জমিচাষ খাতে যন্ত্রায়নের অগ্রগতি মোটামুটি এগিয়ে চলেছে। তবে সে তুলনায় ফসল কর্তন যন্ত্রায়ন বলতে গেলে শুরুমাত্র। বাংলাদেশ কৃষকের গড় মাথাপিছু জমির পরিমাণ ০.০৪৭৮৯ হেক্টর (২০২১)। গড় খামারপিছু জমির পরিমাণ ০.৮ হেক্টর। দেশে ক্ষুদ্র খামারের (গড়ে ০.৩৭ হেক্টর, মাঝারি ১.১৩ হেক্টর, ২.২৩ হেক্টর) সংখ্যা প্রায় ১ কোটি ৫৮ লাখ, মোট খামারের প্রায় ৮২%। মাঝারি খামার ১.১৩ হেক্টর, বৃহৎ খামার ২.২৩ হেক্টর।
প্রতি হেক্টরে ৫-১৫ খণ্ড জমি। দেশে ক্ষুদ্র খামারের অধীনে প্রায় ৩৪% জমি, মাঝারি ও বৃহৎ খামারের অধীনে ৬৪% জমি রয়েছে, যার মাত্র ২০% নিজেরা চাষ করে। এশিয়া মহাদেশের আলোকে একটি লাভজনক খামারের আয়তন ফসলভেদে ২০-৫০ একর হওয়া দরকার।
খামার যন্ত্রায়ন
সফল খামার যন্ত্রায়নের প্রধান ৫টি উপাদানের মধ্যে রয়েছে ১. সরকারের সহায়তা পদ্ধতি ২. শ্রম ও দক্ষতা ব্যবস্থাপনা ৩. কৃষিজমির উন্নয়ন ৪. উপযোগী কৃষি যন্ত্রপাতি নির্বাচন ৫. কৃষি সামাজিকতা মূলধন সহায়তা দান।
১. সরকারের সহায়তা পদ্ধতি
কোভিড-১৯ পরিস্থিতি, বিরূপ পরিবেশ, খাদ্য নিরাপত্তা ও কৃষি শ্রমিক সংকট মোকাবিলা করতে বাংলাদেশ সরকার কাস্টম হায়ারিং মালিকানা পদ্ধতিতে ভর্তুকি মূল্যে ক্ষুদ্র কম্বাইন হারভেস্টার সরবরাহ কার্যক্রম গ্রহণ করে। এর মধ্যে কাস্টম হায়ারিং মালিকানা মডেল ফলপ্রসূ করতে ক্লায়েন্ট প্রদেয় কিস্তি আদায় কাজ বিধিবদ্ধ করে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের লেনা-দেনা পদ্ধতি নিশ্চিত করতে হবে।
২. শ্রম ও দক্ষতা ব্যবস্থাপনা
ফসল উৎপাদন কার্যক্রমের মধ্যে সঠিক ফসল কর্তন ও কর্তনোত্তর কাজ সবচেয়ে শ্রম, ব্যয় ও দক্ষতানির্ভর। ফসল উৎপাদনের ৮-১০ ধরনের কাজের মধ্যে কেবল এ কাজেই প্রায় ২৫-৩০% ব্যয় হয়ে থাকে। বাংলাদেশে বর্তমান কৃষি শ্রমিক ঘাটতি, কর্মক্ষম তরুণ সমাজের অনভিজ্ঞতাপ্রসূত অদক্ষতা ইত্যাদি বিবেচনা করে ফসল কর্তন কমিউনিটি তৈরি করতে হবে। এজন্য তৃণমূল পর্যায়ে জমির মালিক ও যন্ত্রচালক-ব্যবস্থাপক পারিবারিক গ্রুপ প্রশিক্ষণ দিয়ে “জমি যার ফসল-আয় তার” ভিত্তিতে সামাজিক যৌথ খামার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। গবেষণায় হিসাব করা হয়েছে ১ হেক্টর জমির ধান দেশি কাঁচিদ্বারা কাটতে ২৫০ শ্রম ঘণ্টা (গ্রামীণ ৪০-৫০ জন শ্রমিক/হাজিরা ৪০০-৫০০ টাকা হিসাবে ১৬-২০ হাজার টাকা লাগে। অথচ একটি উপযুক্ত হারভেস্টার ব্যবহার করলে এ ব্যয় অর্ধেকে নেমে আসবে।
৩. কৃষিজমির উন্নয়ন
এই দেশে কৃষিজমির প্রকার ও প্রকৃতির আবশ্যক পরিসংখ্যান উল্লেখ করা হয়েছে যা থেকে বলা যায় এগুলো খামার যন্ত্রায়নের জন্য তেমন উপযোগী নয়, তবে উপযোগী করা সম্ভব। এজন্য প্রয়োজন জমির পারিবারিক ঐতিহ্য রক্ষার চেতনা পুনঃউদ্গম ঘটানো। মৌজাভিত্তিক ৩-৫টি প্রজন্ম পরিবারের (বাবা-চাচা-ফুফু) ১০-১৫ একরের জমি নিয়ে প্রশিক্ষণভিত্তিক কর্মসংস্থান রেখে এ কাজ শুরু করা যায়।
৪. উপযোগী কৃষি যন্ত্রপাতি নির্বাচন
বাংলাদেশের কৃষি বর্তমানে প্রধানত ২ ধরনের যথা- বৃহৎ ও মাঝারি খামারের বাণিজ্যিক কৃষি (২৫%) ও ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক খামারের সামাজিক কৃষি (৭৫%)। বৃহৎ খামারের একটি বড় অংশ বর্গা চাষভুক্ত। অর্থাৎ বলা যায় বাংলাদেশের সিংহভাগ কৃষি প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র খামার উপযোগী কৃষি যন্ত্রপাতি নির্বাচন করতে হবে। মূলধন আমদানিকৃত কৃষি যন্ত্রপাতি মাঠ উপযোগিতা মান নির্ধারণের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক প্রতিযোগিতামূলক ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। বাংলাদেশের জন্য এ ধরনের মান-মাত্রায় থাকবে ১. জ্বালানি সাশ্রয়, ২. টেকসই গঠন ও ৩. খুচরা যন্ত্রাংশের প্রাপ্যতা।
৫. কৃষি সামাজিকতা মূলধন সহায়তা দান
স্মার্ট কৃষি উপযোগিতার জন্য বাংলাদেশের সার্বিক ও কৃষি সংক্রান্ত আইন-বিধিমালা সমন্বয় করে মূলধন সহায়তা স্মার্ট করতে হবে। কৃষিভিত্তিক মূলধন দিয়ে এ পেশাকে সরকারি সাশ্রয়ে রাখতে হবে। বাংলাদেশে অনেক উৎপাদনমূলক সেক্টরে মূলধনী (যেমন- বিসিক, পোশাক, আমদানি বিকল্প কারখানা) সহায়তার সুযোগ রয়েছে। এ ব্যাপারে যৌথ খামার যন্ত্রায়ন কার্যক্রম অগ্রাধিকার পেতে পারে।
স্মার্ট কৃষির যন্ত্রায়ন অনুকূল ফসল জমি ব্যবস্থাপনা বিষয়ে করণীয়:
বাংলাদেশে ভূমি-জমি উন্নয়নে পারিবারিক ও সামাজিক কৃষির ঐতিহ্য সুরক্ষা করে হারভেস্টার সমপ্রসারণে কাস্টম হায়ারিং মডেল বাস্তবায়ন করতে হবে। এজন্য -
১. প্রতিটি প্রাজন্মিক পরিবারের জমিসম্পদ যৌথায়ন করে কৃষির পেশাগত কমিউনিটি প্রতিষ্ঠা করতে হবে যাতে হারভেস্টার অখণ্ড জমিতে কাজ করার সুযোগ পায়।
২. বৃহৎ পারিবারিক সামাজিক অঙ্গন থেকে তরুণদের যৌথ পেশাকর্মের চেতনা ও দক্ষতামূলক প্রশিক্ষণ কাজে সরকারি অনুদানপুষ্ট খাতে অগ্রাধিকার দিতে হবে।
৩. প্রতিটি প্রশিক্ষণ গ্রুপে মিশ্র জেন্ডার ও বয়সের ২০-৩০ জন সদস্য শতাধিক একর যৌথায়িত জমি থাকবে। জমি বন্ধুর বা সব সময় বড় উঁচু আইল থাকবে না।
৪. পারিবারিক সুসম্পর্ক ও শান্তি বজায় রাখার বিষয়াবলী প্রশিক্ষণে অন্তর্ভুক্ত থাকবে।
৫. গ্রুপের সঙ্গে কৃষি বিভাগসমূহের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ থাকবে।
৬. গ্রুপ তৈরি ও প্রশিক্ষণ কাজে অন্যান্য বিভাগসহ বৃহত্তর কৃষি ও যুব মন্ত্রণালয়ের বলিষ্ঠ অংশগ্রহণ
থাকবে।
৭. মৌসুম শেষে যৌথ জমির চাষপদ্ধতির আর্থিক-ব্যালেন্স সরাসরি ফসল বা বিক্রির আয় জমির পরিমাণের ভিত্তিতে বিতরণ করা হবে।
৮. যৌথ খামারের জমি উন্নয়ন, চাষ, সেচ সহ যাবতীয় কাজ সহজে সম্পাদন করা যাবে।
৯. ফসল চাষের আয়-ব্যয় ও উপকরণ ব্যবস্থাপনা সহজ হবে এবং সেইফ পদ্ধতি অবলম্বন করা যাবে।
১০. খামারে আধুনিক স্মার্ট প্রযুক্তি ব্যবহার সহজ হয়ে তা দ্রুত বাড়বে।
হিসাব মতে বাংলাদেশে বর্তমানে ধান চাষের আলোকে ৩০,০০০+ হার্ভেস্টার প্রয়োজন। সে তুলনায় বর্তমানে আছে মাত্র ৫০০০টি, অনেক সমস্যাসংকুল পরিস্থিতির আবর্তে। এ সমস্যার সফল সমাধানে উপরোক্ত পরামর্শগুলো বিবেচনায় নিলে তা সহজ হতে পারে। মনে রাখতে হবে ঘন ঘন নষ্ট হয় এবং জ্বালানি বেশি লাগে এমন মেশিন নয় উপযুক্ত শক্ত এবং জ্বালানি সাশ্রয়ী মেশিন বাংলাদেশের নরম ভেজা মাটির জন্য অধিকতর ভালো হবে।
পরামর্শকৃত যৌথ খামার অপারেশন মডেলে একটি মেশিন বছরে মাল্টিপল কৌশলে ৩০০ দিন কাজ করতে পারলে ১ বছরে বিনিয়োগকৃত টাকা উঠে আসবে। একটি মেশিনের সকল কাজে জেন্ডার ও বয়স ভেদে ৩-৫ হেক্টর জমিতে বার্ষিক অতিরিক্ত ৬-১০ জনের কর্মসংস্থান হবে। ধানের উৎপাদন ১০-২০% বাড়বে, ২০-৪০% উৎপাদন ব্যয় কমবে। পারিবারিক ও সামাজিক শান্তি প্রতিষ্ঠা হবে, প্রজন্মের যত্ন প্রজন্ম পাবে।
References:
i. MoA Agricultural Mechaniæation Road Map 2021
ii. H. Kabir, Annual Report 2019, Alim Industries Limited, Gutatikor, Sylhet,
iii. BARI Annual Reports, Bangladesh Agricultural Research Institute 2021.
(লেখক: এফসিএ, এফসিএমএ, উপদেষ্টা, গ্রুপ কিউ এ)
বাংলাদেশে কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থায় বিদ্যমান সমস্যার চেয়েও বড় সমস্যা উৎপাদিত কৃষিপণ্যের প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং বিপণন ব্যবস্থায়। এই দুইটা জায়গা পরিমিত করতে না পারার কারণে বেশ কয়টি সমস্যা হচ্ছেঃ ১। কৃষক উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য না পাওয়ায় উৎসাহ হারাচ্ছেন, মধ্যস্বত্তভোগীদের নিয়ন্ত্রণে পণ্যের বাজার চলে যাচ্ছে। ২। উৎপাদিত পণ্যের পিক সিজনে অপচয় হয়, আবার একই পণ্য অফ সিজনে অর্থ ব্যয় করে আমদানি করতে হচ্ছে। ৩। জনস্বাস্থ্যের উপর বিরূপ প্রভাব সৃষ্টি করছে।