ঢাকা, ১৭ মে ২০২৪, শুক্রবার, ৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ৮ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিঃ

বিশ্বজমিন

বৃটিশ শাসনের চেয়ে এখন কি ভারতে অধিক অসমতা বিরাজমান?

মানবজমিন ডেস্ক
৩ মে ২০২৪, শুক্রবার
mzamin

অর্থনৈতিক সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ভারতীয় জনতা পার্টিকে নিয়ে ২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। কথা ছিল তিনি দুর্নীতির মূলোৎপাটন করবেন। অভিজাতদের কব্জা থেকে ভারতের মধ্যবিত্তদের উচ্চাকাক্সক্ষাকে উদ্ধার করবেন। একই সঙ্গে লাগাম টেনে ধরবেন ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতি ও বেকারত্বের। তার ১০ বছর পরে বিরল তৃতীয় মেয়াদের জন্য নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন নরেন্দ্র মোদি। অর্থনৈতিক গবেষকরা সতর্ক করেছেন যে, এরই মধ্যে ভারতে ধনী ও গরিবের ব্যবধান গিরিখাতের মতো রূপ নিয়েছে। ২০১৪ সালেই তা উল্লেখযোগ্য পরিমাণে ছিল। অনলাইন আল-জাজিরায় এ নিয়ে দীর্ঘ একটি প্রতিবেদন লিখেছেন যশরাজ শর্মা। এতে তিনি বলেছেন, ভারতে আয় ও সম্পদের অসমতা বিশ্বের মধ্যে সর্বোচ্চ যেসব স্থানে তার মধ্যে অন্যতম। ব্রাজিল, দক্ষিণ আফ্রিকা এবং যুক্তরাষ্ট্রে এই অসমতা যতটা ভারতে তার চেয়ে বেশি।

বিজ্ঞাপন
ওয়ার্ল্ড ইনইকুয়ালিটি ল্যাবের (ডব্লিউআইএল) নতুন এক গবেষণায় এসব কথা বলা হয়েছে। ভারতে যখন আগামী সরকার বেছে নেয়ার নির্বাচন চলছে, তখন সম্প্রতি প্রকাশিত গবেষণা ‘দ্য রাইজ অব দ্য বিলিয়নায়ার রাজ’ দেখিয়ে দিচ্ছে এখানে আয়ে অসমতা কতটা প্রকট। বৃটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের অধীনে যা ছিল তার চেয়ে এই অবস্থা আরও শোচনীয়। এই গবেষণাকর্মের সহ-লেক নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটির আবু ধাবি ক্যাম্পাসের নীতিন কুমার ভারতী, হার্ভার্ড কেনেডি স্কুলের লুকাস চ্যানসেল, প্যারিক স্কুল অব ইকোনমিক্সের থমাস পিকেটি, আনমোল সোমানচি। 
ভারতে সম্পদের ক্রমবর্ধমান এই ব্যবধানের বিষয়টি রাজনৈতিক ‘ফ্লাশপয়েন্ট’ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে, যখন বিরোধী কংগ্রেস পার্টি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে যে- যদি তারা নির্বাচিত হয়, তাহলে তারা একটি গোষ্ঠীগত শুমারি করবে। তাতে দেখা যাবে নরেন্দ্র মোদির শাসনামলে অনগ্রসর সম্প্রদায় কীভাবে বঞ্চিত হয়েছেন। কীভাবে তারা দুর্ভোগের শিকার হয়েছেন। 
যশরাজ শর্মা  লিখেছেন, নতুন গবেষণা অনুযায়ী ভারতে কতটা অসমতা বর্তমানে? এর কারণ কি? এর কার্যকর সমাধান কি?  বৃটিশ শাসনের চেয়েও কি খুব বেশি আয়ে অসমতা বেশি? এর উত্তর তিনিই দিয়েছেন। লিখেছেন, ১৯৩০-এর দশকের বেশি সময়ে ভারত ছিল বৃটিশ শাসনের অধীনে। তখন ভারত পরিচিত ছিল বৃটিশ সাম্রাজ্যের কাছে ‘ক্রাউন ইন দ্য জুয়েল’ হিসেবে। তখন ধনীদের শতকরা এক ভাগের কাছে ছিল জাতীয় মোট আয়ের শতকরা ২০ ভাগের কিছু বেশি অর্থ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে এই শেয়ার কমে যায়। ১৯৪০-এর দশকে তা কমে শতকরা ১০ ভাগের কিছু বেশিতে দাঁড়ায়। ১৯৪৭ সালে ভারত যখন স্বাধীন হয় তখন এর পরিমাণ ছিল শতকরা প্রায় ১২.৫ ভাগ। এই অবস্থা বজায় ছিল ১৯৬০-এর দশকের শেষ ভাগ পর্যন্ত। তখনকার প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর অধীনে বিস্তৃত সমাজবাদী ধারাবাহিক পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করা হয়। ব্যাংকগুলোকে জাতীয়করণ করা হয়। অন্যান্য পদক্ষের্পে মধ্যে জাতীয় আয়ের শেয়ার শতকরা শীর্ষ এক ভাগের পতন হয়ে ১৯৮২ সালে এসে প্রায় শতকরা ৬ ভাগে দাঁড়ায়। ভারত উদারীকরণের ফলে এর অর্থনীতি ১৯৯১ সালে এসে পাল্টে যেতে থাকে। শতাব্দীর শেষের দিকে এসে শতকরা এক ভাগ মানুষের হাতে ভারতের আয়ের শতকরা কমপক্ষে ১৫ ভাগ থেকে যায়। ২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসেন। তখন এই অর্থের পরিমাণ শতকরা ২০ ভাগ ছাড়িয়ে যায়। ২০২২-২০২৩ সময়ের মধ্যে তা অস্বাভাবিকভাবে শতকরা ২২.৬ ভাগে পৌঁছে যায়। গবেষকরা বলেন, ভারতের দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতি সেই ধারাকে আরও ত্বরান্বিত করেছে বলে মনে হচ্ছে। জাতীয় প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধি পেতে থাকে বার্ষিক কমপক্ষে ৭ ভাগ হারে। 

সম্পদের অসমতা: যদি ভারতে আয়ের বৈষম্য বিশাল হয়, তবে এর সম্পদের ভারসাম্যহীনতাও আরও বেশি। ১৯৬১ সালে জাতীয় সম্পদের শতকরা ১৫ ভাগের কিছু কমের নিয়ন্ত্রণ ছিল শীর্ষ শতকরা একভাগ মানুষের হাতে। এ সময়েই গবেষকরা তাদের গবেষণা শুরু করেন। বর্তমানে সেই এক ভাগ মানুষের হাতে জাতীয় সম্পদের শতকরা কমপক্ষে ৪০ ভাগ। ধনীরা দেখেছে যে, তাদের আপেক্ষিক সম্পদ বেশির ভাগই স্থির ছিল উদারীকরণের পূর্ব সময়ে। ১৯৯১ সালে শুরু হওয়ার আগে শতাব্দী শেষ হওয়ার পূর্বে তা শতকরা ২০ ভাগ পেরিয়ে যায়।  মোদি যখন ক্ষমতায় আসেন তখন তা দাঁড়ায় শতকরা ৩০ থেকে ৩৫ ভাগে। ওই সময় প্রধানমন্ত্রী মোদি ভারতকে আশ্বস্ত করেছিলেন যে, তিনি তাদেরকে অর্থনৈতিক সংগ্রামে সহায়তা করবেন। 
কিন্তু এক দশক পরে নরেন্দ্র মোদি যখন আবার নির্বাচনের জন্য প্রচারণা চালাচ্ছেন, তখন আকাশচুম্বী অসমতা। পরিস্থিতি এটাই বলে দেয় যে, বহু ভারতীয় ২০১৪ সালের চেয়ে অনেক বেশি সংগ্রাম করছেন। তা চলমান নির্বাচনে কোনো প্রভাব ফেলবে কিনা তা পরিষ্কার নয়। এমন মন্তব্য করেছেন ইউনিভার্সিটি অব ম্যাসাচুসেটস আমহার্স্টের অর্থনীতির প্রফেসর জয়তী ঘোষ। তিনি আরও বলেন, সেই একই নির্বাচন। যে নির্বাচনে ২০১৪ পর্যন্ত অর্থনৈতিক বড় বড় ইস্যুকে সামনে আনা হয়েছিল। এর মধ্যে ছিল দুর্নীতি, অর্থনৈতিক কঠিন অবস্থা, বেকারত্ব, নিম্নমানের জীবনযাপন, অপর্যাপ্ত সরকারি সেবা। 
যশরাজ শর্মা লিখেছেন, কিন্তু মোদির কয়েকদিনের নির্বাচনী প্রচারণা ধর্মীয় মেরূকরণের দিকে পরিবর্তন হয়েছে। ২০১৪ সালে তিনি অর্থনৈতিক বিষয়ে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তা থেকে সরে গেছেন। উদাহরণ হিসেবে, জাতীয় সম্পদের ওপরে ভারতীয় মুসলিমদের সবার আগে অধিকার দেয়ার চক্রান্ত করছে বিরোধী দল কংগ্রেস- এমন অভিযোগ করেছেন নরেন্দ্র মোদি। দৃশ্যত, তিনি মুসলিমদেরকে অনুপ্রবেশকারী হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। জয়তী ঘোষ বলেন, মুখরোচক কথায় আচ্ছন্ন হয়ে আছে বর্তমান শাসকগোষ্ঠী। সাধারণ মানুষ অন্ধকার বাস্তবতা থেকে অনেকটা দূরে। 
মধ্যবিত্তের আয় কমে যাচ্ছে: যদি শীর্ষ শতকরা একভাগ মানুষের হাতে জাতীয় আয়ের এক পঞ্চমাংশের বেশি থাকে, তাহলে শীর্ষ শতকরা ১০ ভাগ নিয়ন্ত্রণ করে শতকরা ৬০ ভাগকে। গবেষণায় এ কথা বলা হয়েছে। স্বাধীনতার পরের বছরগুলোতে, শীর্ষ ১০ ভাগের পতন হয়ে ১৯৮২ সালে তা শতকরা ৩০ ভাগে নেমে আসে। ১৯৯১ সালের উদারীকরণের পর তা আবার বাড়তে শুরু করে। রিপোর্টে বলা হয়েছে, শতকরা শীর্ষ ১০ ভাগের কাছে আছে জাতীয় সম্পদের শতকরা প্রায় ৬৫ ভাগ। আয় ও সম্পদ মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের হাতে চলে আসায় বাকি শতকরা ৯০ ভাগের জীবন ধারণের খরচ বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু ডাটা বলছে, মধ্যম ৪০ শতাংশ ভারতীয় যাদের জাতীয় আয়ের অংশ সবচেয়ে বেশি সংকুচিত হয়েছে, এমনকি দেশের প্রাপ্তবয়স্ক জনসংখ্যার নিচের শতকরা ৫০ ভাগের চেয়েও দ্রুত। ভারতের শতকরা ৪০ ভাগ মধ্যবিত্তের জাতীয় আয় ১৯৮০-র দশকের শুরুতে ছিল শতকরা ৪৫ ভাগের ওপরে। তা ২০২২ সালে এসে দাঁড়িয়েছে শতকরা ২৭ ভাগে। ভারতের সবচেয়ে দরিদ্র জনসংখ্যার অর্ধেকের জাতীয় আয় শতকরা ২৩ ভাগ থেকে একই সময়ে কমে এসে দাঁড়িয়েছে শতকরা ১৫ ভাগে। মধ্যবিত্তদের জন্য আপেক্ষিক ঊর্ধ্বমুখী গতিশীলতার সম্ভাবনা মন্থর হয়েছে- উন্নত হয়নি। এটা বিস্ময়কর কিছু নয় বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
ইউনিভার্সিটি অব ম্যাসাচুসেটস বস্টনের অর্থনীতির সহকারী প্রফেসর রিশাব কুমার জোর দিয়ে বলেন, ভারতীয় অর্থনীতির বেসরকারিকরণ, বিশ্বায়নের সঙ্গে তাল রাখা, উচ্চশিক্ষার পক্ষে থাকায় আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় অনুমোদন দেয়। ভারতে এই ধরনের শিক্ষার প্রবেশাধিকার ঐতিহ্যগতভাবে ধনী এবং উচ্চবর্ণ সম্প্রদায়ের দিকে ঝুঁকছে। 
 

বিশ্বজমিন থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

   

বিশ্বজমিন সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status