ঢাকা, ৮ মে ২০২৪, বুধবার, ২৫ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২৮ শাওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

শেষের পাতা

একে একে ঝরলো ১৪ প্রাণ

উৎকণ্ঠায় অপেক্ষা স্বজনদের

ফাহিমা আক্তার সুমি
২১ মার্চ ২০২৪, বৃহস্পতিবার
mzamin

রত্না আক্তারের দুই চোখে অশ্রু। মলিন মুখে বসে আছেন হাসপাতালের বারান্দায়। অসহায়ের মতো তাকিয়ে ওয়ার্ডের দিকে। নাটোর থেকে পেটের দায়ে গত মাসে স্বামী-সন্তান নিয়ে এসেছেন গাজীপুরে। সেখানে তার স্বামী রাজমিস্ত্রি ও নিজে একটি পোশাক কারখানায় চাকরি নেন। হঠাৎ গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণের ঘটনায় তার জীবনে নেমে আসে ঘোর অন্ধকার। ঘটনায় তার স্বামী কবির হোসেন ও তিন বছরের মেয়ে রাহিমা দগ্ধ হয়। তারা দু’জন শেখ হাসিনা বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন।

কান্নাজড়িত কণ্ঠে রত্না আক্তার বলেন, অনেক স্বপ্ন নিয়ে শহরে এসেছিলাম। কখনো ভাবতে পারিনি এমন ঘটনা ঘটবে। আমার মেয়েটা অনেক ছোট।

বিজ্ঞাপন
পুড়ে গিয়ে দু’জনকেই অনেক কষ্ট ভোগ করতে হচ্ছে। চোখের সামনে এক এক করে দগ্ধরা অনেকে মারা যাচ্ছে, আমিও খুব ভয়ে আছি। আল্লাহ্‌ আমার ভাগ্যে কি লিখেছে। চলতি মাসের ২ তারিখে একটি পোশাক কারখানায় যোগ দেই। ঘটনার আগে আমি ডিউটি থেকে বাসার দিকে আসি। এ সময় আমার মেয়ে খেলতে বাইরে গিয়েছিল। আর স্বামী ইফতারি নিয়ে বাসার দিকে আসছিল। এ সময় আগুনের ঘটনা ঘটে। এখন আমার স্বামীর খুব খারাপ অবস্থা। আমার স্বামীর কেউ নেই। তিনি বলেন, মেয়ের বাবা ৫তলায় ভর্তি আছে আর মেয়ে দশ তলায় শিশু ওয়ার্ডে। সঙ্গে কেউ নেই একবার উপরে যেতে হচ্ছে আরেকবার নিচে। রোগীদের জন্য যে খাবার হাসপাতাল থেকে দিচ্ছে তা দিয়ে কোনোরকম চলছি। মেয়ের ১০ শতাংশ দগ্ধ আর স্বামীর ৪৫ শতাংশ। আমার বাবা-মাও আমার সঙ্গে গাজীপুরে নতুন এসেছে। সে রুম ভাড়া দেয়ার জন্য যে টাকা গুছিয়েছিল তা দিয়ে হাসপাতালে যাওয়া-আসা করছি। দুই হাজার টাকা বাসা ভাড়া দিতে হয়। এদিকে গ্যাস সিলিন্ডার কিনতে হয় সতেরোশ’ টাকায়। আমি ডিউটি শেষ করে এসে দেখি আগুনে জ্বলছে। পাশের একজন বলে ওঠে আমার মেয়ে পুড়ে গেছে তখন দৌঁড়ে গিয়ে দেখি আমার স্বামী রাস্তার মধ্যে পড়ে পোড়া শরীর নিয়ে চিৎকার করছে। আমার মেয়ে আমার মায়ের কোলে যন্ত্রণায় কাঁদছে। আমাদের বাসারই পাঁচজন দগ্ধ হয়েছিল তারমধ্যে তিনজন মারা গেছে।

শুধু রত্না নয়, এ ঘটনায় দগ্ধ রোগীদের স্বজনদের হাসপাতালের আইসিইউ ও এইচডিইউ’র সামনে বসে কাঁদতে দেখা যায়। তাদের চোখের সামনে একটার পর একটা মৃত্যু তার ভয় আর উৎকণ্টা বাড়িয়ে দিচ্ছে। সবাই যেন একটা ভয় ও আতঙ্কের মধ্যে হাসপাতালে সময় পার করছেন। 
১৩ই মার্চ সন্ধ্যা পৌনে ৬টার দিকে কালিয়াকৈরের তেলিরচালা এলাকায় একটি গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ হয়। এতে দগ্ধ হন অন্তত ৩৫ জন। হাসপাতাল সূত্র জানায়, এ ঘটনায় ৩২ জন ভর্তি ছিলেন। এরমধ্যে মৃত্যু হয়েছে ১৪ জনের। আরও ১৩ জন শেখ হাসিনা বার্ন ও প্লাস্টিক ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। তাদের ৮ জনের অবস্থা সংকটাপন্ন। ৫ জনকে চিকিৎসা দিয়ে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। গতকাল কমেলা খাতুন (৬৫) নামের আরও একজন শেখ হাসিনা জাতীয় বার্নে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আইসিইউ’তে মৃত্যু হয়েছে। এই নিয়ে মৃতের সংখ্যা ১৪ জনে দাঁড়িয়েছে।

নাজমা বেগম বলেন, আমার স্বামী কুদ্দুস (৪৫) দগ্ধ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি। লালমনিরহাট জেলার কালীগঞ্জ থানায় গ্রামের বাড়ি। আমার এক ছেলে এক মেয়ে। ছেলেটা এইচএসসি পাস করে বেকার বসে আছে। গাজীপুরে ভাড়া থাকি। ওইদিন সাড়ে পাঁচটার দিকে ঘটনাটি ঘটে। গ্যাস সিলিন্ডারে আগুন লাগে। আমার স্বামীসহ অনেকে সেখানে আসে। এরপর এক একজনের শরীরে আগুন ছড়িয়ে যায়। আমরা যেখানে থাকি সেখানে ঘন বসতি। ঘরগুলো পাশাপাশি টিনশেড বাড়ি। আমি একটি পোশাক কারখানায় চাকরি করি। আমার স্বামী বিকালে নামাজ পড়তে গিয়েছিল। সে পেপ্‌সি কোম্পানিতে শ্রমিকের কাজ করতো। যখন আগুন লাগে তখন সে পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল। একটা সিলিন্ডার বিস্ফোরণ হয়ে পুরো বাড়িঘর গ্যাসে ভরে যায়। আমার স্বামীর অবস্থা বেশি ভালো না। তার ৮০ শতাংশ দগ্ধ হয়েছে। দুইটা সন্তান নিয়ে তো আমার কষ্ট হচ্ছে। আমরা তো বাসায় যেতে পারছি না দূরে হওয়ার কারণে। খাবার হোটেল থেকে কিনে খেতে হচ্ছে। রমজান মাসের দিনে তো কিছু খেতে হয়। সেহ্‌রির সময়ও হোটেল থেকে ভাত এনে খেতে হচ্ছে। দুইটা ছেলেমেয়ে নিয়ে কীভাবে চলবো সেই চিন্তা তো আছে। 
এদিকে মো. ইকরামুল হক রাজমিস্ত্রির কাজ করেন। তার ছোট ভাই মুন্নাত (১৮) ও খালাতো ভাই তারেক (১৮) ভর্তি রয়েছে। তিনিও তার ভাইয়ের সঙ্গে কাজে সহযোগিতা করতেন। 

বলেন, আমরা কাজ করে যাচ্ছি বাসার দিকে। আমার বাসা আগে আর তার কিছুদূরে খালার বাসা। আমি চলে আসি এবং ভাইদের বলি দ্রুত এসে গোসল করার জন্য। এসময় তারা বাসায় আসার সময় আগুনের ঘটনা ঘটে। কিছুক্ষণ পরে দেখি আমার ভাই কাঁদতে কাঁদতে বাসার দিকে দৌড়ে আসছে। তাকিয়ে দেখি তার শরীর পোড়া। তখন হাত, পা ও মুখ পুড়ে গেছে, শরীরে আগুন ছিল না। আমার থেকে দশ হাত দূরে এই ঘটনা। ওই অবস্থায় আমার দিকে দৌড়ে এসেছে। আমার বাড়ি সিরাজগঞ্জ। এখানে আমি, আমার স্ত্রী ও ছোট ভাই গাজীপুর কোনাবাড়ী বাসা নিয়ে থাকতাম। বাবা রিকশা চালান। শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের আবাসিক চিকিৎসক ডা. মো. তরিকুল ইসলাম বলেন, বুধবার রাত সাড়ে চারটার দিকে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) ৪-নম্বর বেডে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয় কমেলা খাতুনের। তার শরীরের ৮০ শতাংশ দগ্ধ ছিল। এই নিয়ে ১৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। এখনো ১৩ জন চিকিৎসাধীন রয়েছেন। তাদের ৮ জনের অবস্থা সংকটাপন্ন।

পাঠকের মতামত

Owners are not punished never punished and its continuing

sami
২১ মার্চ ২০২৪, বৃহস্পতিবার, ৯:২৭ অপরাহ্ন

অনেক স্বপ্ন নিয়ে শহরে এসেছিলাম। কখনো ভাবতে পারিনি এমন ঘটনা ঘটবে.

md kamal hossian
২১ মার্চ ২০২৪, বৃহস্পতিবার, ৩:৩৫ অপরাহ্ন

শেষের পাতা থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

শেষের পাতা সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status