ঢাকা, ৯ মে ২০২৫, শুক্রবার, ২৬ বৈশাখ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, ১০ জিলক্বদ ১৪৪৬ হিঃ

অনলাইন

পাকিস্তান টুডে'র নিবন্ধ

বাহ্যিক চাপ বা অভ্যন্তরীণ খেলা নয়, প্রকৃত ক্ষমতা বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের

এম এ হোসেন
৫ ডিসেম্বর ২০২৩, মঙ্গলবার
mzamin

বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তেজনায় পরিপূর্ণ। কয়েক সপ্তাহের বিক্ষোভ এবং সহিংস সংঘর্ষে তা চরমে উঠেছে। ৭ই  জানুয়ারি নির্ধারিত সাধারণ নির্বাচন ঘনিয়ে আসার সাথে সাথে আশঙ্কার ছায়া ফেলেছে। প্রধান বিরোধী শক্তি হিসেবে পুনরুজ্জীবিত বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওয়াজেদের পদত্যাগের দাবিতে নিজেদের বিক্ষোভকে তীব্র করেছে।

এই অসন্তোষের মূল ভিত্তি সাধারণ নির্বাচনের আগে একটি নিরপেক্ষ অন্তর্বর্তী সরকার প্রতিষ্ঠার আক্রোশ ঘিরে আবর্তিত হয়। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার ওই দাবিটি কঠোরভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে। বিরোধের এই একক ক্ষেত্রটি আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি’র মধ্যে বিভেদকে আরও গভীর করেছে। টানা চতুর্থ মেয়াদে আ.লীগের ক্ষমতায় যাওয়ার ইচ্ছা প্রবল হয়ে উঠেছে যা বিস্তৃত রাজনৈতিক খাদকে আরও বেশি চিত্রিত করে। প্রধান দুই দলই অর্থপূর্ণ সংলাপ করতে অনীহা প্রদর্শন করে৷ যার ফলে আসন্ন নির্বাচনের আগে তাদের পুনর্মিলনের সম্ভাবনা নিয়ে সন্দেহ থাকে।

বিএনপি এবং জামায়াত-ই-ইসলামী নিরপেক্ষ অন্তর্বর্তী নির্বাচনকালীন সরকারের জন্য তাদের ‘এক দফা দাবি’র পক্ষে উল্লেখযোগ্য শক্তি প্রদর্শনে ২৮ অক্টোবর একটি ‘মহাসমাবেশ’ করে। জবাবে আওয়ামী লীগ ওই একইদিনে ‘শান্তি সমাবেশের’ ডাক দেয়। দুঃখজনকভাবে, শান্তিপূর্ণভাবে শুরু হওয়া সমাবেশটি সহিংসতায় পরিণত হয়, নিয়ন্ত্রণ পুনরুদ্ধারের জন্য পুলিশের হস্তক্ষেপের প্রয়োজন হয়েছিল। বিএনপি নেতাকর্মীরা পুলিশ এবং আওয়ামী লীগের সমর্থকদের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন। প্রাথমিকভাবে পুলিশি বাধা সত্ত্বেও দিনব্যাপী রাস্তার লড়াই বিএনপি’র সমাবেশ থেকে সহিংসতায় রূপ নেয়। এই গোলযোগের ফলে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক হতাহতের ঘটনা ঘটে। বিএনপি সমর্থকরা পুলিশ ও সাংবাদিকদের উপর হামলা করে, একটি পুলিশ হাসপাতালে অগ্নিসংযোগ করে এবং সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির বাসভবনে হামলা চালায়- এমন অভিযোগ রয়েছে।

বিএনপি’র অভিযোগ-হয় ইচ্ছাকৃতভাবে সহিংসতাকে উস্কানি দেয়া হয়েছিল অথবা তাদের বিক্ষোভকে অসম্মান করতে সরকারই নাশকতার অংশ ছিল। যাইহোক, বিশ্বাসযোগ্য ক্ষয়ক্ষতি এবং ধ্বংসকে  অস্বীকার করা যাবে না। এর প্রতিক্রিয়ায় সরকার বিএনপি’র সাধারণ নেতাকর্মীদের ওপর দমন-পীড়ন শুরু করেছে। অক্টোবরের নৃশংসতার পরিপ্রেক্ষিতে প্রয়োজনীয় প্রতিক্রিয়া হিসেবে আওয়ামী লীগ এই পদক্ষেপকে সাধুবাদ জানিয়েছে।

পরবর্তীতে বিরোধী দল নিজেদের রাজনৈতিক কৌশল জনবিক্ষোভ থেকে পরিবর্তন করে দেশব্যাপী হরতাল ও অবরোধে নিয়ে যায়। নভেম্বরের শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত অন্তত ১৮০টি গণপরিবহনে আগুন দেয়া হয়েছে। এসব ঘটনাকে বিএনপি সরকারি সংস্থা বা আওয়ামী লীগ সমর্থকদের দ্বারা সংঘটিত নাশকতা হিসেবে চিত্রিত করার চেষ্টা করছে। আওয়ামী লীগ নিজেদের নির্বাচনী প্রচারণার অংশ হিসেবে এই অবরোধ ও ধর্মঘটকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করছে।

আমার মতে, ২৮ অক্টোবর সহিংসতা উসকে দিয়ে বিএনপি এবং তার মিত্ররা অনিচ্ছাকৃতভাবে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কূটকৌশলের মধ্যে পড়ে গেছে। আওয়ামী লীগ কর্তৃক সংগঠিত এই 'ম্যাকিয়াভেলিয়ান' চক্রান্তকে এড়িয়ে যাওয়াই বিএনপির জন্য বুদ্ধিমানের কাজ হবে। যার ফলে এর অহিংস প্রচারাভিযানের দৃশ্যমানতা বৃদ্ধি পাবে এবং উচ্চতর জনসম্পৃক্ততার মাধ্যমে পশ্চিমা দেশগুলোর কাছে একটি দুর্দান্ত বার্তা পৌঁছে দেয়া যাবে।

ওয়াশিংটনের ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি (আইপিএস) চীনকে ভারসাম্যহীন করার জন্য কৌশলগতভাবে অবস্থানরত যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বাধীন জোটের সূচনাকে চিহ্নিত করে। পরাশক্তির এই প্রতিদ্বন্দ্বিতার মধ্যে বাংলাদেশ এবং অন্যান্য দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো নিজেদের এক যুগসন্ধিক্ষণের মধ্যে খুঁজে পাচ্ছে। প্রেসিডেন্ট বাইডেনের মেয়াদের মাঝামাঝি সময়ে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং প্রধানত পশ্চিমা সরকারগুলো গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া, মানবাধিকার এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতার উন্নয়নের জন্য বাংলাদেশের উপর চাপ প্রয়োগ করে আসছে। উল্লেখ্য যে, বিরোধী দল বিএনপি এবং তার মিত্ররা এ উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছে।

আওয়ামী লীগ সরকার গত এক দশকে ভারতের কাছ থেকে অটল সমর্থন উপভোগ করেছে। যাইহোক, ভারতে অনুষ্ঠিত সাম্প্রতিক জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনের পর যুক্তরাষ্ট্র ভারতের প্রতি তার নীতি পুন:নির্ধারণ করেছে, দক্ষিণ এশিয়ার প্রেক্ষাপটে ভারতকে পূর্ণ নেতৃত্ব হস্তান্তর করতে অনিচ্ছার ইঙ্গিত দিয়েছে। ভারতে অনুষ্ঠিত টু প্লাস টু সংলাপে বাংলাদেশ সম্পর্কে নিজেদের অবস্থান নিয়ে ভারত এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে ভিন্নতা প্রকাশ পেয়েছে। বিপরীতভাবে, চীন ও রাশিয়া যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনা করেছে, তাদের কর্মকাণ্ডকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে অযৌক্তিক ‘হস্তক্ষেপ’ বলে চিহ্নিত করেছে। বাংলাদেশ নিয়ে রাশিয়া ও চীনের অবস্থানের নিন্দা জানিয়েছে বিএনপি।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক অচলাবস্থা নিরসনে পশ্চিমা দেশগুলো সংলাপের কথা বলেছে। আ.লীগ মাঝে মাঝে সংলাপে সম্মত হলেও ৭ই জানুয়ারির নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর এই সুযোগ বন্ধ করে দেয়। অন্যদিকে, বিএনপি তুলনামূলকভাবে নীরব এবং আ.লীগের সাথে বসতে কমই আগ্রহী।

অর্থনৈতিক সংকটের পটভূমিতে রাজনৈতিক অস্থিরতাও প্রকাশ পাচ্ছে। জনসংখ্যার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ জীবনযাত্রার ক্রমবর্ধমান ব্যয়, বিশেষত খাদ্যের মূল্য বৃদ্ধির সাথে হিমশিম খাচ্ছে। দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ অর্ধেক হয়ে গেছে, ২০২৩ সালের জুলাইতে রিজার্ভ ৪২ বিলিয়ন ডলার থেকে ২১ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। চলতি বছরের শুরুতে, বাংলাদেশ আইএমএফ-এর কাছে সহায়তা চেয়েছিল। বাংলাদেশে শ্রম আইন সংস্কার নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক উদ্বেগ রপ্তানি ও আমদানির ক্ষেত্রে দেশের তৈরি পোশাক খাতের জন্য সম্ভাব্য ভয়াবহ পরিণতির ইঙ্গিত দিচ্ছে।

বিএনপি’র কৌশলের লক্ষ্য হলো পশ্চিমা 'লিভারেজ'কে কাজে লাগানো এবং অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ বিষয়ে জনগণের অসন্তোষকে পুঁজি করা। আন্দোলন করে তারা হয় হাসিনাকে পদত্যাগ করাতে, নয়তো সহিংসতার পথ অবলম্বন করিয়ে কোণঠাসা করাতে চায়, যাতে বৃহত্তর রাজনৈতিক সংঘর্ষের উদ্রেক হয়। এই সীমিত প্রেক্ষাপটে হাসিনার সামনে বিকল্প রয়েছে দুটি: নির্বাচনকালীন অন্তর্বর্তী সরকার পুনর্বহাল করা অথবা সামরিক বাহিনীর হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দেয়া। যদিও সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপ তাৎক্ষণিকভাবে বিএনপি’র পক্ষে নাও যেতে পারে, কিন্তু এতে শেষ পর্যন্ত খেলার মাঠ সমান হতে পারে। এর বিপরীতে, আওয়ামী লীগ সাংবিধানিক প্রক্রিয়াকে সমর্থনের মাধ্যমে প্রতিকূলতা মোকাবেলায় নৈতিক শক্তি অর্জন করে।

তারা মনে করে, আইনসম্মত চাপ বিএনপি নেতা তারেক রহমানের 'কমান্ড' এবং 'কন্ট্রোল' কে ব্যাহত করতে পারে। যদি বিএনপি’র চেইন অব কমান্ড ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাহলে রাজনৈতিকভাবে বেঁচে থাকার জন্য ঢাকায় ফিরে আসা এবং সম্ভাব্য কারাবরণ করা কিংবা নির্বাসনে থাকাকালীন রাজনৈতিক বিপর্যয় মেনে নেয়া- এ দুয়ের মধ্য থেকে নিজের পছন্দ বাছাই করতে তারেকের পথ সংকুচিত হবে।

ক্রমাগত অস্থিরতার মধ্যে, সমাবেশের স্বাধীনতার অধিকারকে সমুন্নত রাখা এবং শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদকারীদের নিরাপত্তা রক্ষা করা অপরিহার্য। কিন্তু, এটি একটি বিশাল কাজ। এই বিস্তৃত এবং তীব্র জটিল রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে, সমঝোতাও রাজনৈতিক অস্তিত্বের জন্য হুমকি হিসেবে বিবেচিত হয়।

১৮ কোটি মানুষ অধ্যুষিত জাতির ভাগ্য বাহ্যিক চাপ বা অভ্যন্তরীণ শক্তির খেলার অধীন নয়। সত্যিকারের ক্ষমতা সাধারণ মানুষের কাছে এবং তারা বুঝতে পারে কখন এবং কীভাবে তাদের কর্তৃত্ব জাহির করতে হবে।

 

[নিবন্ধটি পাকিস্তান টুডে'তে সোমবার (০৪ ডিসেম্বর) ইংরেজিতে প্রকাশিত হয়েছে] 

অনলাইন থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

অনলাইন সর্বাধিক পঠিত

   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2025
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status