শেষের পাতা
হেনরি কিসিঞ্জার আর নেই
মানবজমিন ডেস্ক
১ ডিসেম্বর ২০২৩, শুক্রবারযুক্তরাষ্ট্রের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার আর নেই। ১০০ বছর বয়সে তিনি কানেকটিকাটে নিজ বাড়িতে বুধবার শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। কিসিঞ্জার এসোসিয়েটস এক বিবৃতিতে এ কথা বললেও তার মৃত্যুর কারণ জানানো হয়নি। এ খবর দিয়েছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স। তার মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ, প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রিপাবলিকান দলের সাবেক প্রার্থী মিট রমনি। হেনরি কিসিঞ্জার সম্পর্কে জর্জ বুশ এক বিবৃতিতে বলেছেন, পররাষ্ট্র বিষয়ে নির্ভরযোগ্য এবং স্বতন্ত্র অন্যতম এক কণ্ঠস্বরকে হারালো যুক্তরাষ্ট্র। আমি বহুদিন ধরে এই ব্যক্তির প্রশংসা করে আসছি, যিনি তরুণ বয়সে নাৎসিদের কবল থেকে একটি ইহুদি পরিবার নিয়ে পালিয়েছিলেন। তারপর তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীতে। তারপর তিনি যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হয়েছেন। একজন সাবেক শরণার্থী থেকে তাকে এই পদে নিয়োগ করা হয়। তিনি দু’জন প্রেসিডেন্টের প্রশাসনের অধীনে কাজ করেছেন। অনেককে পরামর্শ দিয়েছেন। তার এই সেনা এবং পরামর্শের জন্য আমি কৃতজ্ঞ থাকবো। তার বন্ধুত্বের জন্য সবচেয়ে বেশি কৃতজ্ঞ থাকবো। অন্যদিকে সিনেটর মিট রমনি বলেছেন, একজন মহান মানুষ চলে গেলেন। তার পুরোটা জীবনজুড়ে ছিল যুক্তরাষ্ট্রের কূটনীতি, প্রজ্ঞা এবং স্বাধীনতার প্রতি ভালোবাসা।
প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন এবং জেরাল্ড ফোর্ড প্রশাসনে যথাক্রমে তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তার উদ্যমী নীতির ফলে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীনের মধ্যকার কঠিন সম্পর্ককে সহজ করে দিয়েছিল। কিসিঞ্জারকে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার দেয়া হয়েছিল। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তিনি পাকিস্তানের পক্ষ নেয়ার কারণে ব্যাপক সমালোচিত। দুই প্রেসিডেন্টের অধীনে তিনি দায়িত্ব পালনের সময় যুক্তরাষ্ট্রের জন্য অদম্য চিহ্ন রেখে গেছেন। শতবর্ষ বয়সে এসেও তিনি ছিলেন সক্রিয়। যোগ দিয়েছেন হোয়াইট হাউসের বিভিন্ন মিটিংয়ে। নেতৃত্বের স্টাইল নিয়ে প্রকাশ করেছেন বই। উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক হুমকির বিষয়ে সিনেট কমিটিতে সাক্ষ্য দিয়েছেন। এ বছর জুলাই মাসে তিনি প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আকস্মিক বেইজিং সফর করেন। ১৯৭০-এর দশকে প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের অধীনে তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। এ সময় এই দশকের যুগপরিবর্তনকারী বৈশ্বিক বহু ইভেন্টে তার হাত ছিল। এর মধ্যে আছে জার্মান বংশোদ্ভূত ইহুদি শরণার্থী বিষয়ক প্রচেষ্টার ফলে চীনের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক উন্মুক্ত হয়ে যাওয়া। যুক্তরাষ্ট্র-সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে ঐতিহাসিক অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ বিষয়ক আলোচনা। ইসরাইল এবং তার আরব প্রতিবেশীদের মধ্যে সম্পর্ক বিস্তৃত হওয়া ও উত্তর ভিয়েতনামের সঙ্গে প্যারিস শান্তি চুক্তি। কিন্তু ১৯৭৪ সালে পদত্যাগ করেন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন। এর ফলে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির প্রধান ‘আর্কিটেক্ট’- কিসিঞ্জারের প্রভাব কমতে শুরু করে। তা সত্ত্বেও তিনি প্রেসিডেন্ট জেরাল্ড ফোর্ডের প্রশাসনের অধীনে একটি কূটনৈতিক শক্তি হিসেবে তার প্রভাব অব্যাহত রাখেন। তারপর জীবনের বাকি সময়ে শক্তিশালী মতামত দিয়ে গেছেন। অনেকের কাছেই তিনি একজন প্রখর মেধাবী, অভিজ্ঞ কূটনীতিক। আবার অনেকে তার তীব্র সমালোচনা করেন। তাকে কেউ কেউ কমিউনিস্ট বিরোধী স্বৈরশাসকদের সমর্থন করার দায়ে অভিযুক্ত করেন। এর মধ্যে বিশেষ করে আছে লাতিন আমেরিকা। পরের বছরগুলোতে অন্য দেশগুলোতে তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তার বা যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে প্রশ্ন করার হুমকি থাকায় বিদেশ সফর কমিয়ে দেন।
১৯৭৩ সালে উত্তর ভিয়েতনামের লি ডাক থো’র সঙ্গে যৌথভাবে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার জেতেন। তবে থো এই পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেন। এ নিয়ে নানা বিতর্ক হয়। কম্বোডিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের গোপন বোমা হামলার প্রসঙ্গ উঠা এবং নোবেল পুরস্কারের জন্য বাছাই নিয়ে বিতর্কে নোবেল কমিটি থেকে দু’জন সদস্য পদত্যাগ করেন। হেনরি কিসিঞ্জারকে প্রেসিডেন্ট জেরাল্ড ফোর্ড একজন সুপার পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে অভিহিত করেছেন। তার আত্মবিশ্বাসের কথা তুলে ধরেছেন তিনি। প্রেসিডেন্ট ফোর্ড বলেছেন, নিজের মনে কখনো কোনো ভুল করেননি হেনরি। ২০০৬ সালে প্রেসিডেন্ট ফোর্ড মারা যাওয়ার অল্প আগে এক সাক্ষাৎকারে হেনরি কিসিঞ্জার সম্পর্কে বলেছিলেন, আমি যত মানুষকে দেখেছি বা চিনেছি তার মধ্যে তার ছিল সবচেয়ে বেশি সংবেদনশীলতা (থিনেস্ট স্কিন)।
হেনরি কিসিঞ্জারের আসল নাম হেইঞ্জ আলফ্রেড কিসিঞ্জার। তার জন্ম ১৯২৩ সালের ২৭শে মে জার্মানির ফার্থে। নাৎসিরা যখন ইউরোপের ইহুদিদের নির্মূল শুরু করে তার আগে ১৯৩৮ সালে তিনি সপরিবারে যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান। সেখানে তার ইংরেজি নাম হেনরি ধারণ করেন। এর মধ্য দিয়ে ১৯৪৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক হন হেনরি কিসিঞ্জার। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইউরোপে সেনাবাহিনীতে দায়িত্ব পালন করেন। বৃত্তি নিয়ে চলে যান হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটিতে। সেখান থেকে ১৯৫২ সালে মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন। ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেন ১৯৫৪ সালে। পরের ১৭ বছর তিনি হার্ভার্ডের ফ্যাকাল্টিতেই ছিলেন। এ সময়ের বেশির ভাগ সময় তিনি সরকারের বিভিন্ন এজেন্সির কনসালট্যান্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এর মধ্যে ১৯৬৭ সালে তিনি ভিয়েতনামে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মধ্যপন্থি হিসেবে কাজ করেন। প্রেসিডেন্ট লিন্ডন জনসনের প্রশাসনের সঙ্গে সম্পর্ককে ব্যবহার করে তিনি নিক্সন ক্যাম্পের কাছে শান্তির মধ্যস্থতাকারী হিসেবে তথ্য পাঠান। এক পর্যায়ে ভিয়েতনাম যুদ্ধ বন্ধে রাজি হন রিচার্ড নিক্সন। এর ফলে ১৯৬৮ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিজয়ী হন তিনি। ফলে হোয়াইট হাউসে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হিসেবে নিয়ে নেন হেনরি কিসিঞ্জারকে।