বাংলারজমিন
বৃদ্ধাশ্রমে একদিন
প্রতীক ওমর, বগুড়া থেকে
২৮ নভেম্বর ২০২৩, মঙ্গলবারজেলা শহর থেকে বেশ দূরে। সকাল ১০টায় রওনা হই সাতমাথা থেকে। সঙ্গী আরও দু’জন সহকর্মী। বাইক চলছে। উদ্দেশ্য বৃদ্ধাশ্রম দর্শন। কিছুদিন আগে বগুড়ার একজন সমাজকর্মী তহমিনা পারভীন শ্যামলীর কাছে শুনেছিলাম বৃদ্ধাশ্রমটির কথা। ‘সোনাভান বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্র’। অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী ইঞ্জিনিয়ার মজিদ খান বৃদ্ধাশ্রমটির প্রতিষ্ঠাতা। তিনি তার নিজ উদ্যোগেই মূলত প্রতিষ্ঠানটি পরিচালিত করে আসছেন। বিজন কুমার পাল নামের একজন তরুণ চিকিৎসক মেডিকেল অফিসার হিসেবে প্রায় সার্বক্ষণিক অবস্থান করেন সোনাভানে। তার সঙ্গে মুঠোফোনে আগেই সময়-কাল ঠিক করা ছিল। বগুড়ার শেরপুরের জোয়ানপুর। মহাসড়ক থেকে নেমে তিন মিনিটের পায়ে হাঁটার পথ। ঠিক সোয়া ১১টায় গন্তব্যের দেখা মেলে। মনোরম পরিবেশ। ইটের দেয়াল আর টিনের চালার ঘর। চারদিকে বাউন্ডারি দেয়াল। ভেতরে নানা ধরনের গাছ। পুরোটা জায়গাজুড়ে নিবিড় ছায়া। ঘরের বাইরে শান বাঁধানো বসার জায়গা। ঘর থেকে বের হয়ে আশ্রিতরা বাইরে সেই বসার জায়গায় বসে আছেন। একে অপরের সঙ্গে গল্প করছেন। কথা বলছেন। তাদের গল্পে শরিক হই আমরাও। জানার চেষ্টা করি কেন তাদের পড়ন্ত বয়সে বৃদ্ধাশ্রমে আসতে হলো। তাদের অনেকেরই পরিবারের সদস্য আছেন। নানা পারিপার্শ্বিকতার কারণেই এখানে আশ্রয় নিতে হয়েছে।
সবুরা বেগম। ৬৫ বছরের উপরে বয়স। উত্তরের জেলা গাইবান্ধার ফুলছড়ি উপজেলার মানুষ। অনেক দিন ধরেই পঙ্গু হয়ে বিছানা শয্যা। দুই পা অচল। একা দাঁড়াতে পারে না। স্বামী কোথায় আছেন সেই খবর তার জানা নেই। মারা গেছেন নাকি বেঁচে আছেন সেই তথ্যও বলতে পারেন না। সবুরার মা-বাবা, বোন সবাই মারা গেছে। একটি মেয়ে ঢাকায় পোশাক শ্রমিক হিসেবে কাজ করতো। কিছুদিন আগে সেও মারা গেছে। মেয়ে মারা যাওয়ার বেশ কিছুদিন পর খবর পায় সবুরা। কোথায় মাটি হয়েছে, কীভাবে মারা গেছে মেয়ে কিছুই জানে না। পঙ্গু পা নিয়ে কখনো ঢাকা শহরে তার পক্ষে যাওয়া সম্ভব ছিল না। বলতেই চোখ দিয়ে পানি আসে। এখানে সবার সঙ্গে কথা বলে, গল্প করে ভালোই আছেন সবুরা। প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে তার চিকিৎসা এবং পরিচর্যা করা হচ্ছে। এতে তিনি ভালো আছেন, আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করছেন।
পাঁচ বছর ধরে সোনাভানে অবস্থান করছেন বাদশা মিয়া। বয়সের ভারে একেবারেই ন্যুব্জ। ৯৮ বছর চলছে। মুখে একটি দাঁতও অবশিষ্ট নেই। বগুড়ার সারিয়াকান্দি যমুনা বিধৌত এলাকার মানুষ। নদী তাদের জমি, ঘরবাড়ি সব কেড়ে নিয়েছে। আর্থিকভাবে নিঃস্ব হয়েই তিনি এখানে এসেছেন। ছেলে মাছ ব্যবসা করে নিজের পরিবার কোনো রকম চালায়। মাঝেমধ্যে দেখতে আসেন। ফলমূল দিয়ে যায়। মনে অনেক কষ্ট থাকলেও মুখে হাসি নিয়েই কথা বলছেন অবলীলায়। কারও প্রতি প্রকাশ্যে কোনো ক্ষোভ নেই তার। এখানে সহপাঠীদের সঙ্গে বেশ ভালো সময় পার করছেন। আমাদের পেয়ে তার তরুণ সময়ের অনেক কথাই বলেন। তাদের আশ্রয়দাতার জন্য মন থেকে দোয়া করেন। কথা বলতে বলতে বাদশা মিয়া উঠে নামাজের ঘরের দিকে পা বাড়ান। একটু পরেই তিনি দুই কানে আঙ্গুল ঢুকিয়ে ‘আল্লাহু আকবার’ বলে জোহরে আজান দেয়া শুরু করলেন।
আরেকজন ছালেহা বেওয়া। শেরপুর উপজেলাতেই তার বাড়ি। বয়স সত্তরের এপার-ওপার হবে। নিজের বলতে আর কেউ অবশিষ্ট নেই তার। বয়সের কারণে নানা অসুখে আক্রান্ত এখন। কেউ দেখা শোনার নেই। বাধ্য হয়ে তিনি বৃদ্ধাশ্রমে আশ্রিত। কথা হয় তার সঙ্গে। বলেন এখানে যারা আছেন তারাই এখন তার আপনজন। তিন বেলা খাচ্ছেন, ঘুমানোর জন্য ভালো বিছানা রয়েছে। কথা বলার মানুষ রয়েছে। বেশ ভালোই কাটছে তারও। আমাদের সঙ্গে কথা বলতে ধীর পায়ে এগিয়ে আসেন আরেক আশ্রিত। নাম তার কোরবান আলী। বয়স ১১১। শরীর এখনো ঠিক আছে তার। সবকিছু নিজেই করতে পারেন। জীবনের শুরুতে তিনি বিভিন্ন গ্রাম-গঞ্জে বানর খেলা দেখাতেন। ভালোই আয় হতো। নিজ এলাকা শেরপুরের মির্জাপুরে বিয়ে করেছিলেন ৭/৮টি। তারপর চট্টগ্রাম, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্নপ্রান্তে মোট বিয়ে করেছিলেন ১৭টি। তার সন্তান সংখ্যা ২৬টি। তার এই গল্প নিয়ে পরে আরেকটি প্রতিবেদন লেখার ইচ্ছা আছে। আজ পাঠকদের জানাবো কেন তিনি এত সন্তান আর স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও বৃদ্ধাশ্রমে? তাকে এই প্রশ্ন করেছিলাম। কোরবান আলী বললেন, জীবনের শুরুতে, মাঝপথে বেশ ভালোই চলছিলো আমার দিনগুলো। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমার আয় কমে যায়। একপর্যায়ে এসে কোথাও আর ভ্রমণ করতে পারিনি। আয়ের অবলম্বন একটি বানর ছিল সেটিও বিক্রি করে দেই। তারপর আস্তে আস্তে আমি আয়হীন হয়ে পড়ি। পকেট ফাঁকা হয়ে যায়। আমার এমন পরিস্থিতি দেখে একে একে স্ত্রীরা চলে যায়। অনেকে মারা গেছেন। সন্তানদের মধ্যেও অনেকে বেঁচে নেই। যারা বেঁচে আছে তারাও আমাকে ছেড়ে চলে যায়। এভাবেই আজ আমি অর্থ এবং আত্মীয়তে নিঃস্ব হয়ে যাই। একদিন রেললাইনের উপর দাঁড়িয়ে গাড়ির অপেক্ষা করছিলাম। আত্মহত্যা করবো সেই উদ্দেশ্যে। এক সময় গাড়িও চলে এসেছিলো। আমি চোখ বন্ধ করে মৃত্যুর জন্য দাঁড়িয়ে ছিলাম। গাড়ি শরীরের উপর উঠবে এমন সময় একজন বয়স্ক লোক দৌড়ে এসে আমাকে লাইন থেকে টেনে সরিয়ে দেয়। তারপর সেই বৃদ্ধের সঙ্গে কথা বলে সোনাভান বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্রের ঠিকানা জানতে পারি এবং তাৎক্ষণিক একটি গাড়িতে চড়ে এখানে আসি। ঘটনা ২০১৮ সালের দিকে। সেই থেকেই এখানে আছি। এখন ভালো আছি। থাকছি, খাচ্ছি, নামাজ পড়ছি। বেশ ভালোই কাটছে। মাঝেমধ্যে আমার অতীতগুলো অনেক পীড়া দেয়।
দিনের একটা বড় অংশ কেটে যায় সোনাভানে। আশ্রিত প্রায় সবার সঙ্গেই কথা হয়। তাদের মধ্যে তাজু মিয়া, মেরিনা বেগম, কোহিনুর বেগম, খুকুমনি, সালেহা বেগম, রসেনা বেগম, কমলা বেগমসহ অনেকেই সঙ্গে গল্প আড্ডা হয়। বৃদ্ধাশ্রমটিতে মোট বেড সংখ্যা ২২টি। এরমধ্যে ১৯টি বেড পূর্ণ। তার মধ্যে ৭ জন পুরুষ ১২ জন নারী। তাদের বয়স ৫৫ থেকে ১১১ বছর পর্যন্ত।
এখানকার আশ্রিতদের সঙ্গে কথা বলে একটি জায়গায় কিছুটা অবাক হয়েছি। এদের অনেকের সন্তান আছে। স্বজন আছে। কিন্তু কারও প্রতিই তাদের কোনো ক্ষোভ নেই। চাওয়া-পাওয়া নেই। এখানে আশ্রয়কে তারা নিজেদের ভাগ্যের পরিহাস হিসেবে মেনে নিয়েছেন।
দুপুর ২টা বেজে যায় সোনাভানে। খাবার চলে আসে। আমাদের কাজ করার ফাঁকে সোনাভানের মেডিকেল অফিসার বিজন কুমার পাল খাবারের আয়োজন করেছিলেন সেটা বুঝতে পারিনি। তার এবং বয়স্ক এসব লোকদের অনুরোধে তাদের সঙ্গে খাবার খেতে হলো।
খেতে খেতেই কথা হয় বিজন কুমার পালের সঙ্গে। তিনি জানান, অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী ইঞ্জিনিয়ার মজিদ খান বৃদ্ধাশ্রমটির প্রতিষ্ঠাতা। তিনি তার নিজ উদ্যোগেই মূলত প্রতিষ্ঠানটি পরিচালিত করে আসছেন। প্রতিষ্ঠানটিকে নিয়ে তিনি অনেক স্বপ্ন দেখেন। চেষ্টা করছেন এককভাবেই। এখানকার সদস্যদের চিকিৎসাসেবা দেয়ার জন্য তাকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। তরুণ এই চিকিৎসক বিজন কুমার পাল প্রতিদিন সবার শরীরের খোঁজ রাখেন। প্রাথমিক চিকিৎসার প্রয়োজন হলে দেন। বেশি সমস্যা হলে সরকারি হাসপাতালে নিয়ে যান। এভাবেই চলছে ‘সোনাভান বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্র’। বিদায়ের সময় সবাই মূল গেট পর্যন্ত এগিয়ে আসেন। বিদায় জানায় সালাম দিয়ে আমরাও ফিরি নীড়ের ঠিকানায়।