শেষের পাতা
নারায়ণগঞ্জে ঠিকানা খুঁজছেন তৈমূর
বিল্লাল হোসেন রবিন, নারায়ণগঞ্জ থেকে
২৬ নভেম্বর ২০২৩, রবিবার
আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে নারায়ণগঞ্জের রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনা-সমালোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে তৃণমূল বিএনপি’র মহাসচিব এডভোকেট তৈমূর আলম খন্দকার। বিএনপি ঘরানার এই নেতা আকস্মিকভাবে ডিগবাজি দিয়ে তৃণমূল বিএনপিতে সম্পৃক্ত হওয়ায় চরম ক্ষোভ বিরাজ করছে তার এক সময়ের কর্মী- সমর্থকদের মাঝে।
নারায়ণগঞ্জের ৫টি আসনের কোথাও তৃণমূল বিএনপি’র প্রার্থী না দিতে নারায়ণগঞ্জের আওয়ামী লীগ একাট্টা। তারাও কেন্দ্রের কাছে চিঠি দিয়ে জানিয়েছেন, তৃণমূল বিএনপিকে যেন নারায়ণগঞ্জের ৫টি আসনে একটিতেও ছাড় দেয়া না হয়। ফলে ভোটের মাঠে তৃণমূল বিএনপি’র খোদ মহাসচিব তৈমূর আলমই ঠিকানা খুঁজছেন নারায়ণগঞ্জে। অন্যদিকে তৈমূর আলম খন্দকার নারায়ণগঞ্জ-১ (রূপগঞ্জ) আসন থেকে নির্বাচন করার জন্য দলীয় মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করে জমাও দিয়েছেন। এবং বলেছেন, তিনি তার দলের প্রতীক সোনালী আঁশ ‘পাট’ প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করবেন। কিন্তু ওই এলাকার আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা ঘোষণা দিয়েছেন তারা জাতীয় নির্বাচনে নৌকা মার্কার প্রতীককে বিজয়ী করবেন।
সূত্রমতে, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে নির্বাচন করতে নির্বাচন কমিশনে (ইসি) আবেদনও করেছেন তৃণমূল বিএনপি। এ নিয়ে দলের মহাসচিব বুধবার বলেছেন, ‘আমাদের দলীয় প্রতীকের বাইরে যদি নৌকা প্রতীক নিয়ে কেউ নির্বাচন করতে চায়, তাতে কোনো সমস্যা নেই।’ তিনি আরও বলেন, ‘যেহেতু আমরা ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোটভুক্ত হয়েছি, সেহেতু জোটপ্রধান শেখ হাসিনা আমাকে এবং আমাদের দল থেকে যাকে যে আসনে মনোনয়ন দেয়ার সিদ্ধান্ত নেবেন, আমরা তা মেনে নেবো। ইসিতে আবেদন করে আমরা জোটভুক্ত হয়েছি।’
তৈমূর আলম খন্দকার আরও বলেছেন, ‘আমি গত মঙ্গলবার আমার গ্রামের বাড়ি নারায়ণগঞ্জ-১ আসন থেকে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছি। এ ছাড়া নারায়ণগঞ্জ-২ ও ৩ আসন থেকে আবু হানিফ হৃদয়, নারায়ণগঞ্জ-৪ আসন থেকে এডভোকেট আলী হোসেন, নারায়ণগঞ্জ-৫ আসন থেকে এডভোকেট ভাসানী মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন। যদিও তৃণমূল বিএনপি থেকে মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করার পরপরই এডভোকেট আলী হোসেন ও এডভোকেট ভাসানীকে বিএনপি থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে।
ওদিকে পৈতৃক নিবাস নারায়ণগঞ্জ-১ (রূপগঞ্জ) আসন থেকে তৈমূর আলম খন্দকার মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করে জমাও দিয়েছেন। এই আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী বীর মুক্তিযোদ্ধা গোলাম দস্তগীর গাজী। এই আসনে মনোনয়ন পেতে আগ্রহী রূপগঞ্জ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শাহজাহান ভূঁইয়াও। তিনি বলেন, এখানে তৃণমূল বিএনপিকে মানুষ মেনে নেবে না। তৃণমূলকে মানুষ বয়কট করবে। এছাড়াও এখান আওয়ামী লীগ শীর্ষ নেতাদের মধ্যে বিরোধ থাকলেও দিন শেষে তারা এই আসনে নৌকার প্রার্থী ছাড়া কাউকে মেনে নেবেন না বলে জানিয়েছেন।
নারায়ণগঞ্জ-১ আসনে সুযোগ না পেলে নারায়ণগঞ্জ-৫ (শহর-বন্দর) আসনে হয়তো সুযোগ নেয়ার চেষ্টা করবেন তৈমূর। কিন্তু ওই আসনে ১৫ বছর ধরে মহাজোট থেকে নির্বাচিত জাতীয় পাটির এমপি ওসমান পরিবারের সদস্যরা। তাছাড়া ওসমান পরিবারসহ আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পাটির নেতাকর্মীরা এই আসনে তৈমূর আলমকে ছাড় দেবে না। এবং নারায়ণগঞ্জ-২ আসনে আওয়ামী লীগের নজরুল ইসলাম বাবু, নারায়ণগঞ্জ-৩ আসনে বর্তমান সংসদ সদস্য জাতীয় পার্টির লিয়াকত হোসেন খোকা, নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনে জাতীয় পার্টির সেলিম ওসমান ও নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনে আওয়ামী লীগের একেএম শামীম ওসমান বর্তমান সংসদ সদস্য।
নারায়ণগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আব্দুল হাই বলেন, ‘আমরা এ বছর পাঁচটি আসনেই নৌকা প্রতীক চাই। জাতীয় পার্টি কিংবা তৃণমূল কাউকে দলীয় নেতাকর্মীরা মেনে নেবেন না। আমাদের দলীয় সংসদ সদস্য এবং যারা আগামী নির্বাচনে মনোনয়ন পেয়ে নির্বাচন করতে চান, তারা সবাই এলাকায় জনপ্রিয়। তৃণমূল বিএনপি কিংবা জাতীয় পার্টিকে অন্য যেকোনো জেলা থেকে দলীয় স্বার্থে মনোনয়ন দেয়ার জন্য আমরা দলের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে চিঠি দিয়েছি।’
এছাড়াও গত ১৫ বছর ধরে নারায়ণগঞ্জ জেলা, মহানগর ও সোনারগাঁ উপজেলা আওয়ামী লীগের শীর্ষনেতারা তাদের বক্তব্যে নারায়ণগঞ্জের ৫টি আসনে নৌকার প্রার্থী দেয়ার আবেদন জানিয়ে আসছেন দলের হাই কমান্ডের কাছে।
আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা মনে করছেন, তৃণমূল বিএনপি’র প্রার্থীরা নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করার ইচ্ছা পোষণ করবেন। সেই ক্ষেত্রে শুক্রবার বিকালে রূপগঞ্জ উপজেলার কায়েতপাড়া ইউনিয়নের নাওড়া এলাকায় রংধনু গ্রুপের চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেতা আলহাজ মো. রফিকুল ইসলাম একটি সভায় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের উদ্দেশ্যে বলেছেন, এখান থেকে (রূপগঞ্জ) যিনি নৌকার মনোনয়ন পাবেন, তাকে বিপুল ভোটে বিজয়ী করবো।’ আমি রূপগঞ্জের মানুষ, রূপগঞ্জের সন্তান হিসেবে বলতে চাই, আগামী জাতীয় নির্বাচনে নারায়ণগঞ্জ-১ আসন থেকে নৌকাকে বিজয়ী করবো। এজন্য সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে।
ওদিকে একইদিন বিকালে রূপগঞ্জে এক নির্বাচনী প্রস্তুতি সভায় তৃণমূল বিএনপির মহাসচিব তৈমূর আলম খন্দকার গণমাধ্যমে বলেছেন, আমরা আমাদের মার্কা নিয়ে নির্বাচন করবো। আমি তৃণমূল বিএনপি’র মহাসচিব। বিরোধীদলীয় যে ঐক্যজোট হতে যাচ্ছে তার মুখপাত্র আমি। আমাদের দলীয় এবং জোটের সিদ্ধান্তে আমি রূপগঞ্জ থেকে এমপি পদে দলীয় প্রতীক সোনালী আঁশ ‘পাট’ প্রতীকে নির্বাচন করবো।
অন্যদিকে বিএনপি’র জেলা, মহানগর ও উপজেলা পর্যায়ের বেশক’জন নেতা মানবজমিনকে জানান, তৃণমূল বিএনপিকে প্রতিহত করা হবে।
বিএনপি’র তথ্যমতে, তৈমূর আলম খন্দকার বিলুপ্ত নারায়ণগঞ্জ পৌরসভার প্রয়াত চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেতা আলী আহাম্মদ চুনকার (মেয়র আইভীর বাবা) অনুসারী ছিলেন। এবং চুনকার হাত ধরেই তার রাজনীতিতে আসা। পরে আলী আহাম্মদ চুনকা নারায়ণগঞ্জ ঠেলাগাড়ি শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি করেন তৈমূর আলমকে। কয়েক বছর পর তিনি বিএনপিতে যোগ দেন।
বিএনপি’র রাজনীতিতে যুক্ত হয়ে এক পর্যায়ে ২০০৩ সালে তৈমূর আলম নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপি’র সাধারণ সম্পাদক হন। এরপর ২০০৯ সালের ২৫শে নভেম্বর সম্মেলনের মাধ্যমে জেলা বিএনপি’র সভাপতি নির্বাচিত হন তিনি। ২০১১ সালের ৩০শে অক্টোবর অনুষ্ঠিত নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপি’র দলীয় মেয়র প্রার্থী হওয়ার পর ভোটের মাত্র ৭ ঘণ্টা আগে দলীয় চেয়ারপারসনের নির্দেশে তিনি নির্বাচন থেকে সরে আসেন। পরে তাকে বিএনপি চেয়ারপাসনের ৬৩ নম্বর রাজনৈতিক উপদেষ্টা করা হয়। এরপর ২০২০ সালের ৩১শে ডিসেম্বর তৈমূর আলম পুনরায় জেলা বিএনপি’র আহ্বায়ক হন। কিন্তু সম্মেলনের মাধ্যমে তিনি পূর্ণাঙ্গ কমিটি করতে পারেননি দীর্ঘ এই সময়ে। এক পর্যায়ে ২০২২ সালের ১৬ই জানুয়ারি অনুষ্ঠিতব্য নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে মেয়র প্রার্থী হন তিনি। ফলে তাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। এরপর দেড় বছর দলের বাইরে থেকে ১৯শে সেপ্টেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে রাজধানীর রমনার ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে তৃণমূল বিএনপিতে যোগ দেন তৈমূর আলম।