প্রবাস
আবু নাসের ইকবাল কবির, একজন মুক্তিযোদ্ধার গল্প
হেলাল উদ্দীন রানা, যুক্তরাষ্ট্র থেকে
(১১ মাস আগে) ১২ নভেম্বর ২০২৩, রবিবার, ৩:১৩ অপরাহ্ন
আবু নাসের ইকবাল কবির। জাতির একজন সূর্যসন্তান। তার শ্রেষ্ঠ পরিচয় তিনি মুক্তিযোদ্ধা। এর বাইরে তিনি একজন ডাক সাইটে শ্রমিক নেতা। ইকবাল কবিরের হাত ধরে স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশের সিলেটে জন্ম নেয় গণপূর্ত অধিদপ্তরের শ্রমিক কর্মচারী পরিষদ। এই সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হিসেবে সংঠনটিকে তিলে তিলে গড়ে তোলেন তিনি। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে রাখেন বলিষ্ঠ ভূমিকা। এছাড়া ক্রীড়া ক্ষেত্রে পৃষ্ঠপোষকতা সহ রাখেন নানা অবদান। ছিলেন সিলেট মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের সাথে সম্পৃক্ত।
১৯৯৪ সালে সিলেট থেকেই অবসরে যান ইকবাল কবির। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগান রাজ্যে বসবাস করছেন। একই বছর অবিভাসী হয়ে যুক্তরাষ্ট্রে পা রাখেন। প্রচারবিমুখ এই মুক্তিযোদ্ধা রাষ্ট্র বা সরকারের কোনো আনুকূল্য গ্রহণ করেননি। এমন কি একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে পরিচয়ও দেন না কোথাও। তাঁর সোজা সাপটা জবাব দেশের প্রয়োজনে যুদ্ধ করেছি। এতে বলে বেড়ানোর মতো কিছু নেই। এমন কি এই মুক্তিযোদ্ধা কোনো মিডিয়ার সাথেও কথা বলেননি আজ পর্যন্ত। ১৯৬৭ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান গণপূর্ত বিভাগ (পিডব্লিউডি) তে ওয়ার্ক এসিস্ট্যান্ট পদে যোগদান করেন মুক্তিযোদ্ধা ইকবাল কবির। গণপূর্ত বিভাগের অধীনে শহরে যেসব ভবন বা অবকাঠামো নির্মাণ হতো তা দেখাশোনা করাই ছিল তাঁর মূল কাজ।
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে প্রায় দুমাস পর কর্মক্ষেত্র রংপুর থেকেই বাউরা সীমান্ত পার হয়ে যোগ দেন মুক্তিযুদ্ধে। বর্তমানে তার বয়স ৭৭ বছর। এই পড়ন্ত বেলায় এসে কথা বললেন দৈনিক মানবজমিনের সাথে।
বললেন মুক্তিযুদ্ধ সহ জীবনের না বলা কথা। মুক্তিযুদ্ধের সনদ অনুযায়ী ইকবাল কবিরের ফ্রিডম ফাইটার (এফএফ) নম্বর ১১৪০।তাঁর সাব সেক্টর কমান্ডার মেজর নাওয়াজেস উদ্দিনের স্বাক্ষরকৃত সনদপত্রটি ইস্যু করা হয় ১৯৭২ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের রংপুর থেকে। মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং শেষ হলে দেশের অভ্যন্তরে গুপ্তচর হিসাবে যুদ্ধের খবর সংগ্রহে নিয়োগ করা হয় তাঁকে। কাজ ছিল দখলদার বাহিনীর যুদ্ধের প্রস্তুতি,তাদের গতিবিধি, ক্যাম্পের অবস্থান সহ শত্রু সেনার সকল মুভমেন্টের যতটা সম্ভব নজরদারি ও খবরাখবর সংগ্রহ করে মুক্তিবাহিনীর কাছে পৌঁছে দেয়া। ইকবাল কবির- মোহাম্মদ মোস্তফা,মানিক চৌধুরী ও সুবেদার খলিলুর রহমানের তত্ত্বাবধানে ভারত সীমান্তবর্তী বাউরা ক্যাম্পে মুক্তিযুদ্ধের একমাসের প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করেন। তাঁদের এসএমজি,এসএলআর,রাইফেল,গ্রেনেট নিক্ষেপ সহ অস্ত্র চালনার প্রশিক্ষণ দেয়া হয় এবং যুদ্ধের নানা কৌশল হাতে কলমে শিক্ষা দেয়া হয়।
গণপূর্ত বিভাগে সরকারি চাকরীর সুবাদে তাঁর ছিল অনেক বাড়তি সুবিধা। স্থানীয় অনেক প্রভাবশালী বিহারী ঠিকাদারের সাথে ছিল অত্যন্ত সুসম্পর্ক। এদের মধ্যে অন্যতম ঠিকাদার ছিলেন বিহারী খলিল। ইকবাল কবিরকে তিনি সব সময় অভয় দিয়ে বলতেন "ঘাবড়াও মত ইয়ার,হ্যাম হো না"। স্থানীয় বিহারীদের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কারণে কেউ কখনও সন্দেহের চোখে দেখেনি। চাকরীর সুবাদে রংপুরের তৎকালীন বিহারী সমাজের অনেকের সাথেও গড়ে উঠে তাঁর বেশ সখ্যতা। এই সুযোগকে তিনি কাজে লাগান।
এছাড়া যুদ্ধ শুরুর পর তিনি ভাড়া বাসা ছেড়ে পরিবারসহ আশ্রয় নেন পুলিশ লাইন লাগোয়া রংপুর সদর হাসপাতালের ভেতরে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য নির্মিত একটি শেডে। এই হাসপাতালের তৎকালীন প্রভাবশালী সিলেটি চিকিৎসক আবু তাহের চৌধুরীর আনুকূল্য ও সিলেটি নার্স আব্দুস সালাম সহ অনেকের সহযোগিতায় হাসপাতাল কম্পাউন্ডে পরিবার নিয়ে নিরাপদ আশ্রয় লাভ করেন।
ফলে মুক্তিযুদ্ধে যোগদান এবং নির্বিঘ্নভাবে কাজ করা তাঁর জন্য অত্যন্ত সহজ সাধ্য হয়। কবির বলেন, তিনি যুদ্ধকালীন সময়ে কাজের অজুহাতে রংপুর শহরের বিভিন্ন জায়গায় সারাদিন ঘুরে বেড়াতেন। রাতেও পরিচিতদের সাথে আলাপ করে যতটা সম্ভব পাক বাহিনীর নানা প্রকারের তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করতেন। এভাবে প্রায় সপ্তাহ-দশদিন পর সুযোগ বুঝে হঠাৎ করে রাতের অন্ধকারে সীমান্ত পার হয়ে চলে যেতেন ভারতে। সেখানে দুই তিন দিন অবস্থান করে সকল খবরাখবর তাঁর উর্ধ্বতনদের কাছে পৌঁছে দিয়ে তাঁদের নির্দেশ নিয়ে একই ভাবে কোনো এক রাতের আঁধারে সীমান্ত টপকে ঢুকে পড়তেন দেশের ভেতর। পরদিন সকালে হাজির হতেন নিজের কাজে। তিনি রংপুর শহর ছাড়াও নীলফামারী এলাকায় কাজ করেছেন। এসব এলাকার নানা সীমান্ত ব্যবহার করতেন বিভিন্ন সময়ে ওপারে আসা-যাওয়ায়। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে রংপুরে পাক আর্মির হেড কোয়ার্টার ছিল রংপুর ক্যান্টনমেন্টে। মুক্তিযুদ্ধ পূর্ববর্তী সময়ে ক্যান্টনমেন্ট সংলগ্ন ধাপ এলাকায় ছিল তাঁর বাসা। ফলে এই এলাকাসহ গোটা রংপুর শহর ছিল তার চেনা-জানা।
পাক আর্মির বেশীর ভাগ খবরই পেতেন নানা জনের কাছ থেকে।বিশেষ করে পাকিস্তানী বিহারী বন্ধুদের কাছ থেকে পেতেন একেবারে ভেতরের নানা খবর। তারা কী ভাবছে কোথায় আক্রমণের পরিকল্পনা করছে ইত্যাদি অতি গোপনীয় তথ্য গল্পের ছলে কৌশলে জেনে নিতেন। তাকে নানা ভাবে অভয় দিতো এ সকল বিহারী মানুষজন। বিশ্বাস করে অনেক গোপন তথ্যও জানিয়ে দিতো তাঁকে। রংপুরে তাকে কেউ চিনতে বা শনাক্ত করতে না পারলেও হবিগঞ্জে তিনি মুক্তিযুদ্ধে গেছেন এমনটা চাউর হয়ে যায়।ফলে পাক বাহিনী তার পিতার ওপর ভীষণ ভাবে চাপ সৃষ্টি করে।ভয়ে বাধ্য হয়ে তাঁর ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে গ্রামে আত্ম-গোপনে চলে যান তিনি।
ইকবাল কবিরের জন্ম ১৯৪৬ সালের ১ মার্চ। পৈতিক নিবাস নবীগঞ্জ থানার দীঘলবাঁক গ্রামে হলেও বাবার ব্যবসা সূত্রে জন্ম এবং বেড়ে উঠা হবিগঞ্জ শহরে। পিতার নাম আবু মোহাম্মদ ইউসুফ । ১৯৬৪ সালে হবিগঞ্জ হাইস্কুল থেকে মাধ্যমিক এবং ১৯৬৬ সালে হবিগঞ্জ বৃন্দাবন কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন এই মুক্তিযোদ্ধা। সরকারি চাকরীতে যোগদান ও বিয়ের কারণে লেখাপড়া বেশিদূর এগোয়নি। পরে চাকরীকালীন সময়ে রংপুর পলিটেকনিক থেকে নৈশকালীন কোর্সে ৩ বছরের ইলেকট্রিক্যাল ডিপ্লোমা সম্পন্ন করেন। মায়ের অসুস্থতার কারণে ১৯৬৬ সালের জুন মাসে ছাত্রাবস্থায় বিয়ে করেন মাহমুদা কবিরকে। এক বছর পর জন্ম নেয় প্রথম পুত্র সন্তান। দেখতে ছোটখাট প্রকৃতির মুক্তিযোদ্ধা ইকবাল কবির একজন অসম সাহসী মানুষ। বরাবরই তিনি একরোখা ও বেপরোয়া স্বভাবের ছিলেন !
যুদ্ধের সময় খবর সংগ্রহের কাজ ছিল অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। প্রতি মুহূর্তে জান বাজি রেখেই কাজ করতে হয়েছে। সব সময় একটি ভয় তাড়া করে ফিরতো যে, কখন আসল পরিচয় বেরিয়ে পড়ে ! তাছাড়া কোনোভাবে পরিচয় ফাঁস হয়ে পড়লে মৃত্যু অবধারিত ছিল। যুদ্ধ দিনের স্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে এই মুক্তিযোদ্ধা বলেন, একদিন নানা জায়গা ঘুরে খবর নিয়ে যখন ডেরায় ফিরছিলেন তখন হঠাৎ আকাশ থেকে শত্রু সেনা একটি মর্টার শেল ছুঁড়ে মারে ! তিনি টের পেয়ে মুহূর্তে রাস্তার পার্শ্ববর্তী খাদে লাফিয়ে পড়ে কোনোরকমে প্রাণ বাঁচান! এই ঘটনাটি ঘটে রংপুর কলেজ সংলগ্ন মশিউর রহমান যাদু মিয়ার বাড়ির সামনে। এই মর্টার শেলটি তাঁর অনতিদূরে পড়ে বিধ্বস্ত হয় এবং ব্যাপক ক্ষতিসাধন করে। তিনি বলেন,আজও ভাবলে অবাক হই এই প্রায় অনিবার্য মৃত্যুর হাত থেকে আল্লাহ কী ভাবে বাঁচিয়ে আনলেন!
এই মুক্তিযোদ্ধা বলেন, রংপুরে কাজে যোগদানের পর শহরে একটি বাসা ভাড়া করে পরিবারকে রংপুরে নিয়ে আসি।বেশ কিছুদিন পর বাবা মা তাদের নাতীকে দেখতে হবিগঞ্জে যাওয়ার জন্য পীড়াপীড়ি করতে থাকেন। তখন অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়ে গেছে।যোগাযোগ ব্যবস্থাটা আজকের মতো ছিলো না।পরিবার নিয়ে অনেক কষ্টে হবিগঞ্জ পৌঁছাই। ইত্যবসরে অসহযোগ আন্দোলন তীব্র হয়ে উঠতে লাগলো। আমাকে কাজে ফিরতে হবে। কিন্তু বাবা আমাদের একা দিতে রাজি হলেন না। শেষে আমার ছোট ভাই মোজাহিদ কবিরকে আমাদের সাথে পাঠালেন। কিন্ত মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার কারণে সে আর হবিগঞ্জে ফিরতে পারেনি। যুদ্ধকালীন পুরো সময় সেও রংপুরেই থাকলো। কবির আরো বলেন, যখন মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম তখন এই খবরটা যোগাযোগের অভাবে দেশের বাড়িতে বাবাকেও জানাতে পারিনি। পরে ভারত থেকে আমার কমান্ডার খবরটি আগরতলা হয়ে হবিগঞ্জে পৌঁছার ব্যবস্থা করেন।
দেশের বর্তমান অবস্থা নিয়ে খুবই হতাশ এই মুক্তিযোদ্ধা।বললেন, জীবন বাজি রেখে মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলাম একটি বৈষম্যহীন,শোষণ মুক্ত বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে। কিন্তু স্বাধীনতার দীর্ঘ ৫২ বছর পরও দেশের মানুষকে ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য প্রাণ দিতে হচ্ছে-এরচেয়ে লজ্জার কি আছে! আজকে যা হচ্ছে পাকিস্তানের সামরিক শাষণ কালেও এমনটি প্রত্যক্ষ করিনি। বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পেয়েছে এমনটা দেখে যেতে চান এই বীর মুক্তিযোদ্ধা। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর তাঁর কমান্ডাররা রংপুরের কালেক্টরেট ভবনে অস্থায়ী ক্যাম্প স্থাপন করেন। সকল মুক্তিযোদ্ধারা এই ক্যাম্পে রির্পোট করেন। সেখান থেকে সকল মুক্তিযোদ্ধাদের সার্টিফিকেশন প্রদান করা হয়। বয়সের কারণে এই মুক্তিযোদ্ধার স্মৃতিশক্তি লোপ পেতে বসেছে। অনেক বিষয় এমনকি জায়গার নাম ও ঘটনার সন তারিখ স্মরণ করতে কষ্ট হয়। সাহায্য করতে হয় সহধর্মিনীকে। তিনি নিজেও সত্তর পেরিয়েছেন ইতিমধ্যে। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি দুই পুত্র ও ৩ কন্যা সন্তানের জনক। এই বীর মুক্তিযোদ্ধা নিজের ও পরিবারের জন্য দেশবাসীর কাছে দোয়া চেয়েছেন।