ঢাকা, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, শুক্রবার, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

প্রথম পাতা

শান্তিপূর্ণ ভোট

ইভিএমে গোলমাল

পিয়াস সরকার ও নাজমুল হুদা, কুমিল্লা থেকে
১৬ জুন ২০২২, বৃহস্পতিবার
mzamin

দিনভর শান্তিপূর্ণ ভোট হয়ে গেল কুমিল্লায়। নানা ভয় আর শঙ্কা থাকলেও শেষতক স্বস্তির বার্তাই দিয়ে গেল ভোট। পরিবেশ নিয়ে তেমন কোনো অভিযোগ না আসলেও ইভিএমের গোলযোগের ভোগান্তি ছিল দিনভর। লাইনে জটলা, ইভিএম বিকল এমন অভিযোগ করেছেন ভোটাররা। গতকাল সকালে ভোট শুরুর পরই গুমোট পরিবেশ রূপ নেয় বৃষ্টিতে। বাড়তে থাকে বৃষ্টি। আধাঘণ্টার বৃষ্টি শেষে শীতল হয় পরিবেশ। একইসঙ্গে কুমিল্লা জুড়ে পুরো বেলা ছিল শীতল ভোটের পরিবেশ। সময় সকাল ১০টা। নবাব ফয়জুন্নেছা সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়।

বিজ্ঞাপন
কেন্দ্রটি তখন প্রায় ভোটার শূন্য। ভোটারদের জন্য বসে আছেন কর্মকর্তারা, পোলিং এজেন্টরাও কাটাচ্ছেন কর্মহীন সময়। জানা যায়, কেন্দ্রটিতে মোট ভোটার ২২৫৪। সকাল ৯টা ৫৫ মিনিট পর্যন্ত ভোট কাস্ট হয় মাত্র ৯৪টি। তিনটি কক্ষে ৬টি ইভিএমে দেখা যায় ভোট কাস্ট হয়েছে যথাক্রমে ৬, ৫, ১২, ১১, ৬ ও ৮টি। রিটার্নিং অফিসার স্বাক্ষর গোস্বামী বলেন, অপেক্ষা করছি দেখা যাক ভোটার বাড়বে আশা করি। ১৫ মিনিট বাদে দেখা যায় আসতে শুরু করেছেন ভোটাররা। দেখা মেলে দুই অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তার। 

‘দাঁড়া আগে ভোট দিয়্যা লই। হাঁটতে পারতাছি না।’ এভাবেই আমানুর রহমানকে বলেন সাইদুল ইসলাম। বয়স দু’জনার আনুমানিক ৬০/৬৫। দুই বন্ধু বেরিয়েছেন ভোটের পরিবেশ দেখতে। ভাড়া করা রিকশায় করে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। তাদের দু’জনের মতো ভোটারদের আনাগোনা বাড়তে থাকে কেন্দ্রগুলোতে। সরস্বতী দেবনাথ। বয়স ৭০ ছুঁই ছুঁই। বয়সের ভারে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটেন। কিছু সময় হাঁটার পরেই হাঁপিয়ে যান তিনি। সকালে তিনি ছেলের হাত ধরে কুমিল্লা জিলা স্কুল থেকে নবাব ফয়জুন্নেছা সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় ভোটকেন্দ্রে এসেছেন। তিনি বলেন, বাবা দেশকে ভালোবাসি। তাই কষ্ট করে ছেলের সঙ্গে আসছি। ভালো মানুষকে ভোট দিতে এসেছি। বৃষ্টির জন্য একটু কষ্ট হয়েছে। বেলা ১১টা, ফরিদা বিদ্যায়তন। কেন্দ্রে যেতে শোনা যায় এক বৃদ্ধের উচ্চস্বর। কুমিল্লা শহরের তালপুকুর থেকে ভোট দিতে এসেছেন হরিপদ দে। বয়স ৮১ বছর। বার্ধক্যের কারণে এমনি তার হাঁটা চলায় কষ্ট হয়। ভোটকেন্দ্রে এসেছেন সকাল সাড়ে সাতটায়। 

হরিপদ দে জানান, সকাল ৮টায় ভোট শুরু হলে ভোট কক্ষে গিয়ে স্মার্ট কার্ড দেখিয়ে ভোট দিতে পারেননি তিনি। এরপর বাসায় গিয়ে পুরাতন ভোটার আইডি কার্ড নিয়ে আসেন। তা দিয়েও ভোট দিতে পারেননি। ভোটের নম্বর জটিলতায় বেলা সাড়ে ১০টায়ও ভোট দিতে এক কক্ষ থেকে অন্য কক্ষে ঘুরে বেরিয়েছেন তিনি। হরিপদ দে বলেন, একবার স্মার্ট কার্ড নিয়া হয় নাই পরে বাসায় যাইয়া আগের কার্ড নিয়া আসছি। এটাতেও নাকি হবে না। তারা বলছে আমি অন্য কক্ষে যাইতাম। এই কক্ষে আমার ভোট নাম্বার নাই। আমার স্মার্ট কার্ডের নাম্বারের সঙ্গে মিলে না। দীর্ঘ সময় ধরে ভোট দিতে না পারায় উষ্মা প্রকাশ করে তিনি বলেন, ভোট দিতে পারবো কিনা জানি না। চেষ্টা করে দেখি।   বেলা সাড়া ১০টায় ফরিদা বিদ্যায়তন ভোটকেন্দ্র থেকে জানানো হয়, এই কেন্দ্রে সকাল থেকে ৮ শতাংশ ভোট পড়েছে। বৃষ্টির জন্য কিছু সময় ভোটার উপস্থিতি কম ছিল। তবে বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভোটার উপস্থিতি বাড়বে বলে প্রত্যাশা করেন তারা। সকাল সাড়ে ১১টা কুমিল্লা মডার্ন স্কুলে মেলে ভিন্ন চিত্র। শ’খানেক ভোটার ভোট দেয়ার জন্য অপেক্ষা করছেন। ভ্যাপসা গরমে অতিষ্ঠ তারা।  এখানেই আবার অভিযোগ মেলে কৃত্রিম লাইনের। এমন করে প্রায় এক ঘণ্টা ধরে এক জায়গায় দাঁড়ায় আছি। কৃত্রিম লাইন করছে নাকি কে জানে? না হলে লাইন আগায় না কেন। কুমিল্লার মডার্ন স্কুলে লাইনে দাঁড়িয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ভেতরে দেখেন কোনো সিরিয়াল নাই। বাইরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড় করিয়ে রেখেছে। আমার তো মনে হচ্ছে কৃত্রিম লাইন করা হয়েছে। 

 স্মিতা দেবনাথ বলেন, গরমে গা ঘেমে যাচ্ছে। এক ঘণ্টা গাদাগাদি করে দাঁড়িয়ে আছি, কই লাইন তো আগায় না। তাদের কোনো সিস্টেম নাই। এক দরজা দিয়েই ঢুকছে, ওই দরজা দিয়েই বের করছে। ভোটকেন্দ্রে দেখা যায়, দীর্ঘ লাইন। একজনের শরীরে লেপ্টে দাঁড়িয়ে আছেন আরেকজন। শামসুল আরেফিন বলেন, আমার মায়ের বয়স ৫৫। হার্টের রোগ ও ডায়াবেটিস আছে। একঘণ্টা ধরে লাইনে দাঁড়িয়ে। বললাম চলো চলে যাই, বলে না ভোট দিয়েই যাবো।  এই ভোটকেন্দ্রের বাইরে দেখা যায়, বিজিবি ও পুলিশ মিলে কেন্দ্রের পরিবেশ সচল রাখতে ব্যস্ত। অকারণে যারা জটলা করছেন তাদেরই তাড়িয়ে দিচ্ছেন। এরই মাঝে এলেন ম্যাজিস্ট্রেট। কেন্দ্রের বাইরে জটলার মাঝে দৌড় দেন এক ব্যক্তি। দৌড়ে পাকড়াও করেন তাকে। দেখেন তার হাতে দুটি স্লিপ। কেন দুই স্লিপ এমন প্রশ্নের জবাব নেই তার কাছে। আবার তিনি সেই ওয়ার্ডের ভোটারই না। তাকে নিয়ে যাওয়ার সময় দেখা বেশ কয়েকজন ছাড়ানোর চেষ্টা করছেন। সামনে এগিয়ে পান আরও তিনজনকে তারাও এই ওয়ার্ডের ভোটার নন। তাদের চারজনের গলাতেই ছিল নৌকা প্রতীকের স্টিকার।  ম্যাজিস্ট্রেট সোহেল রানা বলেন, তারা সকলেই অন্য এলাকা থেকে প্রভাব বিস্তার করার জন্য এসেছেন। এখন তাদের জিজ্ঞাসাবাদ শেষে প্রয়োজনে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে। 

তখন প্রায় বেলা ১টা। ধীরগতির ইভিএম নিয়ে ব্যাপক অসন্তুষ্টি দেখা দেয়। ভোটই দিতাম না, একঘণ্টা ধরে লাইনে দাঁড়ায় আছি ফিঙ্গার ম্যাচ করে না। হাত ধুয়ে আসতে বললো আসলাম তাও মেলে না। এখন চলে যাচ্ছি এভাবেই রাগ নিয়ে বলছিলেন জামান চৌধুরী।  আমিরুল ইসলাম নামের এক ভোটার জানান, ৪-৫ বার চেষ্টা করার পরে তার আঙ্গুলের ছাপ মিলেছে। এতে তার অনেকটা সময় লেগেছে। তার মতো অনেকেই এই সমস্যায় পড়েছেন।  সিয়াম মাহমুদ বলেন, আমার আঙ্গুলের ছাপ মিলছিলো না। পরে হাত ভালো করে সাবান দিয়ে ধুয়ে এসেছি। এরপর মিলেছে।  আঙ্গুলের ছাপ না মেলায় বিপাকে পড়ছেন কর্মকর্তারাও। আর বড় হচ্ছে লাইন। বাড়ছে বিরক্তি। সানজিদা আক্তার বলেন, আমি, ভাইয়া আর আম্মু ভোট দিতে এসেছি। আমরা ভোট দিলাম কিন্তু আম্মুর ফিঙ্গার মিললো না। আম্মু ভোট না দিয়ে যাবেই না। পরে আম্মুকে মিথ্যা কথা বলে নিয়ে এসেছি।  বিকাল ৩টা। কুমিল্লা সরকারি সিটি কলেজ কেন্দ্রে ভোটারদের উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো। 

দীর্ঘ লাইনে ভোট দিচ্ছেন ভোটাররা। এই সময়ে ভোট দিতে এসেছেন বাছুম মিয়া। ইভিএমের জটিলতা বুঝতে না পেরেও দীর্ঘ সময় গোপন কক্ষে ভোট দেয়ার চেষ্টা করেছিলেন তিনি। অনেক চেষ্টার পরেও ভোট দিতে পারেননি। পরে তার সঙ্গে ভোট দিতে গোপন কক্ষে যান আপন ভাতিজা জামাল। তবুও তার ভোট দেয়া সম্পন্ন হয়নি। দীর্ঘ লাইনে ভোটাররা অপেক্ষা করায় দায়িত্বরত এক কর্মকর্তা বিরক্তি প্রকাশ করেন।  ভোট দেয়া সম্পন্ন হয়েছে কিনা সেটা বুঝতে পারেনি বাছুম মিয়া। তিনি বলেন, ভোট হইছে কিনা বোঝা যায় না। আমার সঙ্গে আমার ভাতিজা গেছে। আমারে নাম্বারটা দেহাই দিলো। জামাল বলেন, আমার চাচা ভোট দিতে পারছেন না। তাই আমি দিয়ে দিচ্ছি। আমার আপন চাচা হয়। কেন্দ্রটিতে শেষ মুহূর্তের মতো ভোট দিচ্ছেন ভোটাররা। এখানে ইভিএমে ভোট দিতে গিয়ে বিড়ম্বনায় পড়ছেন বাছুম মিয়ার মতো অনেকেই। অনেকেই বিষয়টি বুঝতে পারছেন না। কারও কারও আবার আঙ্গুলের ছাপ মিলছে না। এতে উষ্মা প্রকাশ করেন অনেকে। 

তারা বলছেন, আগের ভোটের নিয়মই ভালো ছিল।  বিকাল পৌনে ৪টা। বড় পুকুরপাড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে শেষ মুহূর্তের মতো ভোট দিচ্ছেন ভোটাররা। নারী-পুরুষ উভয় ভোটারই শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ভোটকেন্দ্রে উপস্থিত ছিলেন। এ সময়েও পরিবেশ শান্ত ছিল। উৎসবমুখর পরিবেশে ভোট দিয়েছিলেন সবাই। বিকাল ৪টা নাগাদ কেন্দ্রে উপস্থিত ভোটাররা তাদের ভোট দিয়েছেন। এরপর আর নতুন করে কাউকে কেন্দ্রে ঢুকতে দেয়া হয়নি। এ সময় যাদের ভোট দেয়া শেষ হয়েছে তাদের সতর্ক করে বাঁশি বাজাতে থাকেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। ভোট শেষ হওয়া ভোটারদের কেন্দ্র থেকে বাহিরে সরিয়ে দেন তারা। আর নির্ধারিত সময়েই কেন্দ্রে অবস্থিত ভোটারদের ভোট প্রদানে ১৫ মিনিট সময় লেগেছিল। ভোট প্রদান শেষে অনেকেই কেন্দ্রের আশেপাশে ফলাফলের জন্য অপেক্ষা করছিলেন।

প্রথম পাতা থেকে আরও পড়ুন

   

প্রথম পাতা সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status