প্রথম পাতা
অগ্নিঝরা জুলাই
আরিফকে হারিয়ে অসহায় পরিবার
ফাহিমা আক্তার সুমি
১১ জুলাই ২০২৫, শুক্রবার
আমার সন্তান হত্যার বিচার চাই। সে ছিল আমাদের একমাত্র অবলম্বন। তার মৃত্যুর পর থেকে আমরাও ভালো নেই। কোনো বাবা-মা কী ভালো থাকতে পারে। আমার ছেলে হারানোর শোক তো এখনো কাটছে না। কি অন্যায় করেছিল আমার সন্তান। এভাবে কথাগুলো বলছিলেন ২০২৪-এর গণ-অভ্যুত্থানে ১৯শে জুলাই ঢাকার যাত্রাবাড়ীতে গুলিবিদ্ধ আঠারো বছর বয়সী আরিফ হোসেনের বাবা। আরিফের ডান চোখের নিচে গুলিটি বিদ্ধ হয়ে মাথার পিছন দিক থেকে বেরিয়ে যায়। পরে রক্তাক্ত অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। আরিফ ছিলেন বাবা-মায়ের একমাত্র ছেলে সন্তান। ভোলার লালমোহনের একটি মাদ্রাসায় পড়তেন। তার বাবা কৃষিকাজ করে সংসার চালান। অভাবের সংসারে হাল ধরতে যাত্রাবাড়ীর একটি খাবারের হোটেলে চাকরিও নিয়েছিলেন আরিফ। তবে পরিবারকে নিয়ে সেই ইচ্ছা আর পূরণ হয়নি তার। আরিফের এমন মৃত্যুতে এখনো স্বাভাবিক হতে পারেনি পরিবারটি।
শহীদ আরিফের বাবা মো. ইউসুফ মানবজমিনকে বলেন, আমি আমার সন্তান হত্যার বিচার চাই। আরিফ ছিল আমার একমাত্র ছেলে সন্তান। তার চিন্তায় এখনো খেতে পারি না, ঘুমাতে পারি না। ওর মা এখনো কাঁদতে থাকে। অভাবের সংসারে পরিবারের হাল ধরতে তাকে ঢাকা পাঠানো হয়েছিল। সেখানে তার মামাতো ভাইয়ের সঙ্গে হোটেলে কাজ করতো। শেষ ঢাকায় যাওয়ার ১৭ দিন পর গুলিতে মারা যায়। আমরা কীভাবে বেঁচে থাকবো। আমার ছয় সন্তানের মধ্যে আরিফ একমাত্র ছেলে সন্তান ছিল। আমি চেয়েছিলাম আমার সন্তান ঢাকায় চাকরি করে আমাকে সহযোগিতা করবে, আমি কখনো ভাবিনি আমার সন্তান এভাবে হারিয়ে যাবে। সে সময়ে আমি যদি জানতাম তাহলে আমার হাজার কষ্ট হলেও আমি তাকে ঢাকায় পাঠাতাম না। গ্রামে রেখেই আমি কাজ করে তার পড়াশোনা শেষ করাতাম। আরিফ সবসময় চাইতো আমাদের সংসারের অভাব ঘোচাবে। আমি বয়সের কারণে বিভিন্নভাবে অসুস্থ, এখন বেশি পরিশ্রমের কাজ করতে পারি না। দুইটা মেয়ে এখনো পড়াশোনা করছে আমি একা তাদের সব প্রয়োজন মেটাতে পারছি না। হয়তো ছেলে সন্তানের অভাব পূরণ হবে না কিন্তু আমি মেয়েদেরও মানুষের মতো মানুষ করতে চাই। আরিফ থাকলে তো আমাদের এই বয়সে এসে মেয়েদের জন্য চিন্তা করতে হতো না, সে সবই সামলে নিতো। আমি মাঠে-ঘাটে কাজ করলেও আমার সন্তানদের পড়াশোনা করিয়েছি। আরিফ ছোটবেলা থেকে অনেক ভদ্র-শান্ত স্বভাবের ছিল। সে খেলাধুলায় অনেক সময় দিতো।
সেদিনের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে আরিফের মামাতো ভাই সাহাবউদ্দিন বলেন, গত ১৯শে জুলাই শুক্রবার দুপুরের পর নামাজ ও খাওয়া-দাওয়া শেষে আরিফ যাত্রাবাড়ীতে ছাত্রদের সঙ্গে আন্দোলনে যায়। কিছুক্ষণ পরে সেখানে থাকা শিক্ষার্থীরা খবর দেন আমার ভাই গুলিবিদ্ধ হয়েছে। পরে ভাইকে রক্তাক্ত অবস্থায় উদ্ধার করে স্থানীয় একটি হাসপাতালে নেয়া হয়। সেখান থেকে চিকিৎসা না পেয়ে আমরা তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাই। হাসপাতালে নেয়ার পর চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
তিনি বলেন, ৫ বোনের একমাত্র ভাই ছিল আরিফ। ওর বাবা-মায়ের খুব ইচ্ছা ছিল আরবী লাইনে পড়াশোনা শেষ করানোর। বাবার কষ্ট দেখে আরিফের স্বপ্ন ছিল ঢাকায় এসে চাকরি করবে সেই টাকা দিয়ে বাবা-মা ও বোনকে দেখবে, নিজের পড়াশোনার খরচ চালাবে। ১৯শে জুলাইয়ের আগেও সে আন্দোলনে গিয়েছিল কিন্তু সেইদিন আর ফিরে আসেনি। তিনি বলেন, আরিফ আমার সঙ্গেই ঢাকায় থাকতো। ভাইবোনের মধ্যে ও ছিল চতুর্থ।