প্রথম পাতা
১লা আগস্ট থেকে কার্যকর
মার্কিন শুল্ক নিয়ে দুশ্চিন্তা বাড়লো
স্টাফ রিপোর্টার
৯ জুলাই ২০২৫, বুধবার
ওয়াশিংটনে চলমান সিরিজ বৈঠকের প্রত্যাশিত ফল আসেনি; বরং নেগোসিয়েশনের মাঝপথে মার্কিন শুল্ক নিয়ে ঢাকার দুশ্চিন্তা বাড়ালো প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের চিঠি। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বরাবর সম্প্রতি পাঠানো ওই চিঠিতে বাংলাদেশি পণ্যের ওপর ৩৫ শতাংশ শুল্ক বহাল রাখার কথা জানানো হয়েছে। আগামী ১লা আগস্ট থেকে ওই শুল্কহার কার্যকর হচ্ছে। তবে আশার দিক হচ্ছে- যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বাজার খোলা এবং শুল্ক-অশুল্কসহ বিদ্যমান বাণিজ্য বাধা দূর করলে কিছু বিষয় পুনর্বিবেচনার সুযোগ রেখেছে ট্রাম্প প্রশাসন। উল্লেখ্য, আজ শুল্কহার নিয়ে ওয়াশিংটনে আরেক দফা আলোচনায় বসছে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদল। অন্তর্বর্তী সরকারের বাণিজ্য উপদেষ্টা ও জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার সমন্বিত ওই দল যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনায় পূর্ণ ক্ষমতাপ্রাপ্ত।
এদিকে বাংলাদেশি পণ্যের ওপর বাড়তি মার্কিন শুল্ক বহালের প্রভাব নিয়ে চলছে নানা হিসাব-নিকাশ। যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি হওয়া অন্যান্য পণ্য বিশেষত তৈরি পোশাক খাতে এর প্রভাব কতোটা পড়বে তা নিয়ে চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের আলোচনার অনেক বিষয়ে অন্ধকারে থাকার অভিযোগ করছেন ব্যবসায়ীদের কেউ কেউ। তারা বলছেন, বিষয়টি নিয়ে বিশেষজ্ঞ এবং খাতসংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আগে থেকে আরও আলোচনা করা উচিত ছিল। তবে ‘নন-ডিসক্লোজার’ ক্লজ থাকার কারণে যে এমনটি হয়েছে সেটা মানছেন অভিযোগকারীরা। যুক্তরাষ্ট্রের মতো প্রভাবশালী দেশের সঙ্গে স্পর্শকাতর এই ইস্যুতে দরকষাকষির জন্য বাংলাদেশ টিমের যথাযথ প্রস্তুতি তথা আলোচকদের ‘যোগ্যতা’ নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় ‘বাংলাদেশের দুর্বলতার সুযোগ’ যুক্তরাষ্ট্র নিচ্ছে কিনা? সেই প্রশ্নও রাখছেন কোনো কোনো অর্থনীতিবিদ! এদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের এই সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের অর্থনীতিতে চরম নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে মনে করেন ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র নির্ভর করেই যাদের ব্যবসা, তাদের ‘পথে বসাবে’ এই সিদ্ধান্ত। উল্লেখ্য, গত এপ্রিলে বিভিন্ন দেশের ওপর রিসিপ্রোকাল ট্যারিফ বা পাল্টা শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্ত নেয় ট্রাম্প প্রশাসন, যেখানে বাংলাদেশি পণ্যে ৩৭ শতাংশ শুল্ক আরোপের কথা জানানো হয়। তবে বিশ্ব অর্থনীতিতে টালমাটাল পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে এসব শুল্ক তিন মাসের জন্য স্থগিত করেন ডনাল্ড ট্রাম্প। প্রসঙ্গত, এর আগে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশি পণ্যের ওপর গড়ে শুল্ক ছিল ১৫ শতাংশ।
চিঠিতে যে বার্তা দিয়েছেন ট্রাম্প: এদিকে নতুন শুল্ক আরোপের কথা জানিয়ে ১৪টি দেশের নেতাদের কাছে চিঠি পাঠিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প। সেসব চিঠি তিনি নিজের ট্রুথ সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রকাশ করেন। বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধানকে পাঠানো চিঠিতে ডনাল্ড ট্রাম্প বলেন- ‘দুঃখজনকভাবে, আমাদের সম্পর্কটি বর্তমানে সমতা থেকে অনেক দূরে। তাই, পহেলা অগাস্ট ২০২৫ থেকে আমরা যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানো বাংলাদেশি যেকোনো এবং সব পণ্যের ওপর ৩৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করবো। এই শুল্ক এড়াতে যদি ট্রান্সশিপমেন্টের মাধ্যমে পণ্য পাঠানো হয়, সেটিও উচ্চশুল্কের আওতায় পড়বে। তবে বাংলাদেশ বা আপনার দেশের কোম্পানিগুলো যদি যুক্তরাষ্ট্রের পণ্য উৎপাদন বা তৈরি করার সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে তাদের কোনো শুল্ক দিতে হবে না। এক্ষেত্রে এই সিদ্ধান্তের পর বাংলাদেশ যদিও শুল্ক হার বাড়ানোর কোনো সিদ্ধান্ত নেয় তাহলে যুক্তরাষ্ট্রও পাল্টা হারে শুল্ক বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেবে। শুল্কের হার বাড়ানো বা কমানোর সিদ্ধান্ত দুই দেশের সম্পর্কের ওপর নির্ভর করবে বলেও জানানো হয়েছে প্রেসিডেন্টের ওই চিঠিতে।
যুক্তরাষ্ট্রের অফিস অব দ্য ইউনাইটেড স্টেট ট্রেড রিপ্রেজেন্টেটিভ, যা ইউএসটিআর নামে পরিচিত, তাদের হিসাবে বলা হয়েছে, ২০২৪ সালে বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল আনুমানিক এক হাজার ৬০ কোটি ডলার। ওই বছর যুক্তরাষ্ট্র থেকে ২২০ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি করা হয়েছে বাংলাদেশে। যার বিপরীতে বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য রপ্তানি হয়েছে প্রায় ৮৪০ কোটি ডলারের মতো। বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের যেসব পণ্য রপ্তানি হয় তার মধ্যে রয়েছে- কৃষিপণ্য যেমন, খাদ্যশস্য, বীজ, সয়াবিন, তুলা, গম ও ভুট্টা। এ ছাড়া যন্ত্রপাতি এবং লোহা ও ইস্পাতজাত পণ্যও আসে বাংলাদেশে। আর বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি পণ্যের মধ্যে আছে- তৈরি পোশাক, জুতা, টেক্সটাইল সামগ্রী ও কৃষিপণ্য। অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র আরোপিত ‘অযৌক্তিক শুল্ক’ বাংলাদেশের অর্থনীতিকে আরও চাপে ফেলবে। তারা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের জন্য রপ্তানির উল্লেখযোগ্য গন্তব্য হওয়ায় সব পণ্য নিয়েই চিন্তা রয়েছে। তবে পোশাক খাত নিয়েই দুঃশ্চিন্তা সবচেয়ে বেশি। এই খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের নতুন শুল্কহার বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতে আঘাত হানবে। এর ফলে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে তৈরি পোশাকের দাম বেড়ে যাবে, যাতে স্থানীয় চাহিদা কমে আমদানি চাহিদাও কমাবে। বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বাবু বিবিসি বাংলাকে বলছেন, মার্কিন শুল্ক বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতকে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত করবে।
শুল্ক ইস্যুতে আলোচনায় বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র সফরে রয়েছে বাংলাদেশের একটি প্রতিনিধিদল। বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশির উদ্দিনের নেতৃত্বে ওই দলে রয়েছেন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ড. খলিলুর রহমান এবং ওয়াশিংটনে নিযুক্ত বাংলাদেশ দূতাবাসের কর্মকর্তারা। ১৩ই জুলাই ওয়াশিংটনে ইউএসটিআর (যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধির কার্যালয়)-এ প্রথম দফার আনুষ্ঠানিক বৈঠকও করেছে তারা। মঙ্গলবার সামাজিক মাধ্যমে দেয়া এক পোস্টে, ৯ই জুলাইয়ের আলোচনায় দুই দেশের মধ্যে একটি ‘ট্যারিফ ডিল’ হওয়ার আশা প্রকাশ করেছেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম। অবশ্য ট্যারিফ ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সরকারের আলোচনা নিয়ে নানা প্রশ্ন তুলছেন অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, বাংলাদেশের পক্ষ থেকে কী প্রস্তাব দেয়া হয়েছে সে বিষয়ে এখনো স্পষ্টভাবে কিছুই জানেন না তারা। ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি শামস মাহমুদ বিবিসি বাংলাকে বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রে দেয়া তিনমাস সময়ের মধ্যেই ভিয়েতনামসহ কয়েকটি দেশ আলোচনা ও চুক্তি করেছে, “আমরা কেনো পারলাম না, উই আর ফেইল্ড সামহোয়্যার (আমরা কোনো জায়গায় ব্যর্থ হয়েছি)”। বোয়িং কেনাসহ যেসব প্রস্তাব যুক্তরাষ্ট্রকে দেয়া হয়েছে যেগুলো খুব একটা কার্যকর নয় বলেই মনে করেন শামস মাহমুদ।
যুক্তরাষ্ট্রের ঘোষিত শুল্ক চূড়ান্ত নয়: অর্থ উপদেষ্টা
এদিকে বাংলাদেশের পণ্যের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের ঘোষিত শুল্ক চূড়ান্ত নয় বলে জানিয়েছেন অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, ওয়ান টু ওয়ান নিগোসিয়েশনের মাধ্যমে এটা ঠিক হবে। এ লক্ষ্যে আগামীকাল (আজ) ভোরে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধির দপ্তরের (ইউএসটিআর) কর্মকর্তাদের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য প্রতিনিধিদের বৈঠক হবে। বাংলাদেশি রপ্তানি পণ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ৩৫ শতাংশ পাল্টা শুল্ক আরোপ করে গতকাল বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে চিঠি দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প। এরপর এ নিয়ে মঙ্গলবার সচিবালয়ে সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির বৈঠক শেষে তিনি সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এ কথা বলেন। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে অর্থ উপদেষ্টা বলেন, ওখানে (যুক্তরাষ্ট্রে) আমাদের বাণিজ্য উপদেষ্টা আছেন। উনি তিনদিন আগে গেছেন। আজকেই বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দল যাচ্ছে। ৮ তারিখে মিটিং। ওদের ৮ তারিখ মানে আগামীকাল বুধবার খুব ভোরবেলা। মিটিংয়ের পর আমরা বুঝতে পারবো। তিনি বলেন, ইউএসটিআরের সঙ্গে আলাপ করবেন উনি (বাণিজ্য উপদেষ্টা)। কালকের পর আপনারা বুঝতে পারবেন। মিটিংয়ে কী কোনো উন্নতি হওয়ার আশা করা যায়? সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের উত্তরে সালেহউদ্দিন বলেন, আমরা আশাকরি। যাই হোক, সেটার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা অন্য পদক্ষেপগুলো নেবো। ভিয়েতনাম কমাতে পারলে বাংলাদেশ কেন সেভাবে কমাতে পারলো না- এই প্রশ্নের জবাবে অর্থ উপদেষ্টা বলেন, এটা ঠিক যে আমাদের ঘাটতি মাত্র ৫ বিলিয়ন ডলার। ভিয়েতনামের ১২৫ বিলিয়ন ডলার। ওখানে কিন্তু ওরা মোটামুটি ছাড় দিতে পারে। কিন্তু আমাদের এত কম বাণিজ্য ঘাটতি, তাই এত শুল্ক দেয়ার তো ন্যায্যতা থাকে না।
শুল্ক নিয়ে সরকারকে গুরুত্ব নিয়ে সমাধান খোঁজার পরামর্শ জামায়াত আমীরের: এদিকে এক ফেসবুক পোস্টে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমীর ডা. শফিকুর রহমান বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশি রপ্তানি পণ্যের ওপর শুল্ক আরোপের বিষয় সামনে এসেছে। এর আশু সমাধান প্রয়োজন। অন্যথায় রপ্তানি বাণিজ্যে বড় ধরনের সংকট তৈরি হবে। সরকারকে এ ব্যাপারে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে প্রয়োজনীয় সবকিছু করতে হবে।
চিঠি পেয়েছে সরকার, দ্বিপক্ষীয় আলোচনা ইতিবাচক সিদ্ধান্তে পৌঁছাবে: প্রেস সচিব
এদিকে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম মঙ্গলবার তার ভেরিফায়েড ফেসবুক পেইজে একটি পোস্ট দেন। সেখানে তিনি লিখেছেন, বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীনের নেতৃত্বে বাংলাদেশের একটি বাণিজ্য প্রতিনিধিদল বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছে। তারা ইতিমধ্যেই মার্কিন প্রশাসনের বাণিজ্য ও শুল্ক কর্মকর্তাদের সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠক করেছেন। বুধবার (৯ই জুলাই) আরেক দফা নির্ধারিত আলোচনা অনুষ্ঠিত হবে। মার্কিন প্রশাসনের সঙ্গে বাংলাদেশের চলমান দ্বিপক্ষীয় আলোচনা একটি ইতিবাচক সিদ্ধান্তে পৌঁছাবে বলে প্রত্যাশা ব্যক্ত করে প্রেস সচিব লিখেছেন, ঢাকা ওয়াশিংটনের সঙ্গে একটি শুল্ক চুক্তির প্রত্যাশা করছে, যা আমাদের বিশ্বাস, উভয় দেশের জন্য লাভজনক হবে।