ঢাকা, ৯ জুলাই ২০২৫, বুধবার, ২৫ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, ১৩ মহরম ১৪৪৭ হিঃ

প্রথম পাতা

একা হয়ে পড়ছেন জিএম কাদের

পিয়াস সরকার
৯ জুলাই ২০২৫, বুধবার
mzamin

ফের ভাঙনের মুখে জাতীয় পার্টি। সিনিয়র তিন নেতাকে বহিষ্কারের পর নতুন করে তৈরি হয়েছে অস্থিরতা। বহিষ্কৃত নেতারা বলছেন, তাদের বহিষ্কার অগণতান্ত্রিক। মুজিবুল হক চুন্নুই দলের বৈধ মহাসচিব। বহিষ্কৃত নেতারা দলের ঐক্য দাবি করে জানিয়েছেন প্রয়োজনে তারা নিজেরা কাউন্সিল করে নতুন কমিটির ঘোষণা দেবেন। তাদের এই ঘোষণা কার্যত জাপা’র আরও একটি ব্রাকেটবন্দি অংশের যাত্রার ইঙ্গিত দিচ্ছে। দলীয় সূত্র জানিয়েছে, বহিষ্কৃত নেতারা কাউন্সিল আয়োজনের প্রস্তুতি ইতিমধ্যে শুরু করে দিয়েছেন। এর আগে রওশন এরশাদের নেতৃত্বে যে অংশটি আলাদা হয়েছিল তারাও বহিষ্কৃত নেতাদের সঙ্গে যুক্ত হতে পারেন বলে আভাস মিলেছে। এই প্রক্রিয়াটি সফল হলে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের আরও একা এবং কোণঠাসা হয়ে পড়তে পারেন বলে নেতাকর্মীরা মনে করছেন। 

আওয়ামী লীগের তিনটি মেয়াদে সুবিধাজনক অবস্থানে থাকা জাতীয় পার্টি ফ্যাসিবাদী সরকারের পতনের পর থেকেই চাপে আছে। দলটিকে ফ্যাসিবাদের সহযোগী দাবি করে বিচার ও নিষিদ্ধ করার দাবি করে আসছে গণ-অভ্যুত্থানে অংশ নেয়া বিভিন্ন পক্ষ। সর্বশেষ দলের কাউন্সিল ঘোষণা নিয়ে টানাপড়েন শুরু হয়। কাউন্সিল ঘোষণার পরপরই ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদের নেতৃত্বে একটি প্যানেল দেয়ার তথ্য প্রকাশ করলে নিজের নেতৃত্ব নিয়ে শঙ্কিত হয়ে পড়েন জিএম কাদের। এরপরই কাউন্সিল স্থগিত করা হয়। একের পর এক বহিষ্কার করা হয় নেতাদের। দলীয় তথ্য অনুযায়ী সর্বশেষ এক সপ্তাহে অন্তত ১১ জন নেতাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। সোমবার সিনিয়র তিন নেতাকে বহিষ্কার এবং তরুণ নেতা শামীম হায়দার পাটোয়ারীকে নতুন মহাসচিব নিয়োগ দেয়ার পরিস্থিতি জটিল হয়ে পড়েছে। এই বহিষ্কারের পর গতকাল আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলন করে তিন নেতা প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। তারা বলেছেন, মুজিবুল হক চুন্নুই দলের বৈধ মহাসচিব। বহিষ্কারের প্রক্রিয়াটি গণতান্ত্রিক নয়। ওদিকে নতুন মহাসচিব ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী বলেছেন সব কিছু গঠনতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় হয়েছে। বহিষ্কৃতরা মিথ্যাচার করে দলের ক্ষতি করছেন। 

সংবাদ সম্মেলনে ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ বলেন, আমরা এখনো স্বপদে বহাল রয়েছি, আমাদের মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু বহাল রয়েছেন। ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারীর নিয়োগ সম্পূর্ণ অবৈধ। জিএম কাদের প্রেসিডিয়ামের সভায় সিদ্ধান্ত হয় বলে জানিয়েছেন- যা মিথ্যা। ওই প্রেসিডিয়ামের সভায় কোরাম হয়নি। আর গঠনতন্ত্রের ২০/৩ (খ) ধারায় বলা হয়েছে মহাসচিব চেয়ারম্যানের সঙ্গে আলোচনা করে, প্রেসিডিয়ামের মিটিং আহ্বান করবেন। আলোচ্যসূচি নির্ধারণ করবেন মহাসচিব। আমাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলা হয়েছে আমরা গঠনতন্ত্রবিরোধী কাজ করেছি। আমরা পার্টির বিরুদ্ধে কী কাজ করেছি। আমরা বিবৃতি দিয়ে ২০ এর ১ (ক) ধারা বাতিল করতে বলেছি, হিসাবে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে এবং বৃহত্তর ঐক্যের কথা বলেছি।

তিনি আরও বলেন, আমরা প্রায় সকলেই প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, প্রতিষ্ঠাকালীন থেকে দলের সঙ্গে রয়েছি। আমিও এই পার্টির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ছিলাম, আমাকে যখন ঘোষণা করা হয়, তখন পার্টির চেয়ারম্যান আমার পাশে বসে ঘোষণা দিয়েছিলেন। আর জিএম কাদের জোর করে স্বাক্ষর নিয়েছেন। একজন মৃত্যু পথযাত্রী ছিলেন। ঠিক যেভাবে মিলিটারি ক্যু হয়। পার্টিকে ঐক্যবদ্ধ করা এবং কাউন্সিলের মাধ্যমে সকল সমস্যা সমাধানের দাবি জানান তিনি।

জাতীয় পার্টি ছোট হতে হতে এখন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে বলে মন্তব্য করেছেন কাজী ফিরোজ রশীদ। তিনি বলেন, আমরা ঐক্যবদ্ধ হলে জাতীয় পার্টি আগামীদিনে অনেক ভালো করতে পারবে। জিএম কাদের একেএকে সবাইকে বের করে দিয়েছেন। আমরা সবাই চাই একটি ঐক্যবদ্ধ জাতীয় পার্টি।
সদ্য বহিষ্কার হওয়া মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, আমি এমন কি অপরাধ করলাম, যার জন্য পার্টির প্রাথমিক সদস্যপদ পর্যন্ত অব্যাহতি দিলেন। মহাসচিব থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে কোনো আপত্তি নেই। আমার একটাই দুঃখ ’৮৬ সালে প্রথম সংসদ সদস্য নির্বাচিত হই। ১৯৮৭ সালে উপমন্ত্রী হয়েছি, তখন থেকে পার্টির সঙ্গে আছি। আমি যখন মন্ত্রী তখন জিএম কাদের একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানের ডেপুটি ম্যানেজার। তিনি ১৯৯৬ সালে পার্টির সদস্যপদ গ্রহণ করেন। তার কোনো যোগ্যতা নেই, তার একমাত্র যোগ্যতা হচ্ছেন তিনি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের ভাই। তারপরও তাকে নেতা মেনে রাজনীতি করেছি। ২৮ জন নেতাকে প্রমোশন দিয়েছেন, আমি জানি না।

তিনি বলেন, জাতীয় পার্টির গঠনতন্ত্রের ২০ এর ১ (ক) ধারা মতো আর কোনো রাজনৈতিক দলে ধারা নেই। তাই আমি বললাম এই ধারা পরিবর্তন করা দরকার। এই ধারায় তাকেও (জিএম কাদের) দুই দফায় জাতীয় পার্টি থেকে অব্যাহতি দিয়েছিলেন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ।

সংবাদ সম্মেলনে পূর্বে বহিষ্কৃত একাধিক নেতা উপস্থিত ছিলেন। এরমধ্যে অন্যতম সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা, সাইদুর রহমান টেপা, শফিকুল ইসলাম সেন্টু, এটিইউ তাজ রহমান, সোলায়মান আলম শেঠ, নাসরিন জাহান রতনা, নাজমা আক্তার, জহিরুল ইসলাম জহির, মোস্তফা আল মাহমুদ, মাসরুর মওলা, জসিম উদ্দিন ভূঁইয়া, মো. আরিফুর রহমান খান। সংবাদ সম্মেলনে রওশন এরশাদপন্থি কয়েকজন নেতাকেও দেখা যায়।

সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত থাকা একজন নেতা মানবজমিনকে বলেন, এখন আমরা বহিষ্কৃতরা এক হওয়ার চেষ্টা করছি। জিএম কাদের যদি কাউন্সিলের তারিখ ঘোষণা করেন সেদিন আমরা উপস্থিত হবো। আর যদি তা না হয় আমরা নিজেরা কাউন্সিল করার প্রস্তুতি নিচ্ছি। তিনি বলেন, জিএম কাদের বহিষ্কার করতে করতে একা হয়ে পড়েছেন। তার পাশে যেসব নেতা আছেন তাদের দেশের মানুষ কেউই চেনেন না। একে একে বহিষ্কার করতে করতে তিনি প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্যদেরও বহিষ্কার করা শুরু করেছেন।

সাবেক প্রেসিডেন্ট হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের গড়া জাতীয় পার্টি রাজনৈতিক দল হিসেবে সবচেয়ে বেশি ভাঙনকবলিত। এরশাদের জীবদ্দশায় জাপা, জেপি, বিজেপি ও জাপা (জাফর) নামে চার টুকরোসহ মোট আটবার ভাঙন হয়। এরশাদের মৃত্যুর পর সহধর্মিণী রওশন এরশাদের নেতৃত্বে আরেকটি জাপা’র সৃষ্টি হয়েছে।

এদিকে আরেক সংবাদ সম্মেলনে সদ্য ঘোষিত মহাসচিব ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী বলেন, প্রেসিডিয়াম মিটিংয়ে ২৮শে জুন কাউন্সিল হওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। সেখানে অনেকেই বলেছিলেন জায়গা না পাওয়া গেলে কাকরাইলে হবে। কিন্তু সেটার কোনো রেজুলেশন হয় নাই। জায়গা না পাওয়ায় কাউন্সিল পিছিয়ে দেয়া হয়। এরপর সিনিয়র নেতারা তীব্র রি-অ্যাকশন দেখান। জিএম কাদেরকে বহিষ্কার করার কথা বলেন। আলাদা কাউন্সিলেরও কথা বলেন। গঠনতন্ত্রে বলা হয়েছে সভাপতিত্ব করবেন চেয়ারম্যান। এর বিকল্প কোনো সুযোগ নাই। 

তিনি আরও বলেন, এরপর আমাদের ২৮টি ইউনিটের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে ডাকি। প্রেসিডিয়াম মিটিং ডাকি। ২৫ জন প্রেসিডিয়ামের সদস্যদের মিটিংয়েও সর্বসম্মতিক্রমে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত হয়। গঠনতন্ত্র মোতাবেক ৩০ (১) অনুসারে বহিষ্কার করা যায়। মহাসচিব পদ শূন্য হওয়ায় আমাকে নিয়োগ দেয়া হয়। সিনিয়র নেতারা যা বলেছেন তা ভুল। সব সিদ্ধান্ত গঠনতন্ত্র মোতাবেক হয়েছে। তারা বলছেন, কোরাম ছিল না। কিন্তু সেখানে কোরাম ছিল। তাদের সমর্থন না থাকায় তারা দলকে, নিজেকে হেয়প্রতিপন্ন করছে। এধরনের মিথ্যাচারগুলো বন্ধ হওয়া উচিত।
 

প্রথম পাতা থেকে আরও পড়ুন

প্রথম পাতা সর্বাধিক পঠিত

   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2025
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status