প্রথম পাতা
প্রতিক্রিয়া
অপরাধ প্রমাণ সহজ হবে
রাশিম মোল্লা
১১ জুলাই ২০২৫, শুক্রবারজুলাই-আগস্টে গণ-অভ্যুত্থানে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় নিজের অপরাধের দায় স্বীকার করেছেন পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন। ট্রাইব্যুনালের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে তিনি তার লিখিত বক্তব্যে আদালতকে জানান, যারা এ অপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্ত তাদের মুখোশ উন্মোচন করতে চান তিনি। রাজসাক্ষী হয়ে জুলাই-আগস্ট আন্দোলন চলাকালীন যে অপরাধ সংঘটিত হয়েছে, তার বিস্তারিত আদালতে তুলে ধরতে চাই। রহস্য উন্মোচনে আদালতকে তথ্য দিয়ে সহায়তা করতে চাই। ট্রাইব্যুনাল তার আবেদন মঞ্জুর করেন। আইনজ্ঞদের মতে, রাজসাক্ষী হওয়ায় মামলার অভিযোগ প্রমাণ সহজ হবে। এর ফলে ট্রাইব্যুনালে দায়ের হওয়া অন্য মানবতাবিরোধী মামলায়ও তার সাক্ষ্য ব্যাবহার করা যাবে।
রাজসাক্ষী কী: আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন-১৯৭৩ এর ১৫ ধারায় রাজসাক্ষীর বিধান রয়েছে। এ ছাড়া রাজসাক্ষী হওয়ার বিষয়টি ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৩৭, ৩৩৮ ধারা, সাক্ষ্য আইনের ১৩৩ ধারায় উল্লেখ রয়েছে। ট্রাইব্যুনাল আইন-১৯৭৩ এর ১৫ ধারায় বলা হয়েছে, একজন রাজসাক্ষী ক্ষমা পাবেন যদি, (১) বিচারের যেকোনো পর্যায়ে, ধারা ৩-এ উল্লেখিত যেকোনো অপরাধের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত বা অবগত থাকা ব্যক্তিদের প্রমাণ সংগ্রহের লক্ষ্যে, ট্রাইব্যুনাল উক্ত ব্যক্তিকে ক্ষমা করতে পারবেন, এই শর্তে যে তিনি অপরাধের সঙ্গে সম্পর্কিত তার জ্ঞানের মধ্যে থাকা সম্পূর্ণ পরিস্থিতি এবং অপরাধের সঙ্গে সম্পর্কিত অন্যান্য সকল ব্যক্তির, প্রধান বা সহায়তাকারী হিসেবে, পূর্ণ এবং সত্য প্রকাশ করেন। (২) এই ধারার অধীনে প্রত্যেক ব্যক্তিকে বিচারে সাক্ষী হিসেবে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। তবে, (৩) বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত উক্ত ব্যক্তিকে হেফাজতে আটক রাখা হবে।
আইনজীবীরা যা বলেন: জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের মহাসচিব ব্যারিস্টার কায়সার কামাল মানবজমিনকে বলেন, একই মামলায় যখন কোনো আসামি স্বেচ্ছায় দোষ স্বীকার করেন এবং অন্য আসামিদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়ে প্রকৃত ঘটনা বা পরিস্থিতি তুলে ধরেন তখন তিনি রাজসাক্ষী (অ্যাপ্রোভার) হিসেবে অভিহিত হন। এই সুবিধা এমন ব্যক্তিদের দেয়া হয় যারা অপরাধের সঙ্গে জড়িত এবং যাদের দেয়া বক্তব্যের মাধ্যমে অন্য আসামিদের কৃত অপরাধের পুরো ঘটনা প্রকাশ হয়। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের একটি মামলায় অ্যাপ্রুভার বা রাজসাক্ষী হয়েছেন পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন। আন্দোলন চলাকালীন পুরো সময় তিনি দায়িত্বে ছিলেন। এই আন্দোলনে পুলিশ, র্যাব ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে সহস্রাধিক ছাত্র-জনতা শহীদ হয়েছেন। তিনি বিষয়গুলো পরিষ্কারভাবে আদালতের সামনে তুলে ধরতে পারবেন। মামলার সাক্ষ্য প্রমাণে সহজ হবে বলে মনে করি।
ফৌজদারি আইনজ্ঞ এডভোকেট শিশির মনির বলেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের ১৫ ধারায় রাজসাক্ষীর বিধান রয়েছে। এ ছাড়াও ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৩৭, ৩৩৮ ধারা, সাক্ষ্য আইনের ১৩৩ ধারায় উল্লেখ রয়েছে। ট্রাইব্যুনাল আইন-১৯৭৩ এর ১৫ ধারায় বলা হয়েছে, একজন রাজসাক্ষী ক্ষমা পাবেন যদি, (১) বিচারের যেকোনো পর্যায়ে, ধারা ৩-এ উল্লেখিত যেকোনো অপরাধের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত বা অবগত থাকা ব্যক্তিদের প্রমাণ সংগ্রহের লক্ষ্যে, ট্রাইব্যুনাল উক্ত ব্যক্তিকে ক্ষমা করতে পারবেন, এই শর্তে যে তিনি অপরাধের সঙ্গে সম্পর্কিত তার জ্ঞানের মধ্যে থাকা সম্পূর্ণ পরিস্থিতি এবং অপরাধের সঙ্গে সম্পর্কিত অন্যান্য সকল ব্যক্তির, প্রধান বা সহায়তাকারী হিসেবে, পূর্ণ এবং সত্য প্রকাশ করবেন। তিনি বলেন, সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন রাজসাক্ষী হওয়ার ফলে মামলার অভিযোগগুলো প্রমাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। তার দেয়া তথ্য যদি গুরুত্বপূর্ণ ও ঘটনা প্রমাণে সহায়তা করে তবে তিনি মুখ্য সাক্ষীও হতে পরেন।
সাবেক জেলা ও দায়রা জজ ড. শাহজাহান সাজু মানবজমিনকে বলেন, অপরাধীকে খুঁজে বের করা পুলিশের বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর অর্পিত। কিন্তু কখনো কখনো অপরাধের রহস্য উদ্ঘাটন করা পুলিশের পক্ষে কঠিন হয়ে পড়ে। ধৃত আসামি সহজে মুখ খুলতে চায় না। তখন পুলিশ অপরাধীকে সত্য ঘটনা বলার জন্য সাক্ষী করার প্রস্তাব দেয়া হয়। আসামি রাজি হলে তাকে রাষ্ট্রের পক্ষে সাক্ষী করা হয়। যাকে রাজসাক্ষী করা হয় তার বক্তব্য গ্রহণ করার জন্য অন্যান্য নিরপেক্ষ সমর্থন যোগ্য সাক্ষীও থাকে। কোনো আসামি রাজসাক্ষী হিসেবে সাক্ষ্য দিতে রাজি হলে প্রথমে তাকে রাজসাক্ষী হিসেবে ঘোষণা করা হয় এবং পরে কারাগারে রাখা হয় যাতে অন্য কোনো অপরাধী বা ব্যক্তি তাকে প্রভাবিত করতে না পারে। এ প্রসঙ্গে সাক্ষ্য আইনের ১৩৩ ধারায় বলা হয়েছে, অপরাধী অন্য সহযোগী অপরাধীদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য প্রদান করার উপযুক্ত ব্যক্তি বলে বিবেচিত হতে হবে। দুষ্কর্মের সহযোগীর অসমর্থিত সাক্ষ্যের ভিত্তিতে আসামিকে সাজা দেয়া হলে তা বেআইনি বলে গণ্য হবে না । এ ধারা মতে, আসামিকে যিনি রাজসাক্ষী হবেন তাকে ক্ষমা প্রদর্শনের ব্যবস্থা করা হয়েছে যাতে আসামি সাক্ষী হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে। অন্যদিকে সাক্ষ্য আইনের ১৪৪ ধারার বিধান মোতাবেক রাজসাক্ষীর একক সাক্ষ্যের ভিত্তিতে আসামিকে শাস্তি প্রদান করা আইনত যুক্তিসঙ্গত হবে না । কেননা, সে অন্যান্য সহযোগী অপরাধীদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে থাকে। কাজেই রাজসাক্ষীর মতো একজন বিশ্বাসঘাতক সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণে আদালত বেশ সতর্কতা অবলম্বন করেন। আর আসামির সংখ্যা বেশি হলে এমনভাবে সাক্ষ্য প্রদান করতে হবে যাতে প্রত্যেক আসামির পৃথকভাবে অপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া যায়।
বিগত সময় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মামলা পরিচালনাকারী আইনজীবী ফখরুল ইসলাম মানবজমিনকে বলেন, পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন রাজসাক্ষী হওয়ায় মামলা প্রমাণে অনেক সহজ হবে। কারণ বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের অনেক অবৈধ আদেশ তার মাধ্যমে পালিত হয়েছে। তিনি সবকিছু ভালোভাবে আদালতকে জানাতে পারবেন এবং তিনি যা বলবেন তা অন্য মামলায় রেফারেন্স হিসেবেও ব্যবহার করা যাবে।