ঢাকা, ১১ জুলাই ২০২৫, শুক্রবার, ২৭ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, ১৫ মহরম ১৪৪৭ হিঃ

প্রথম পাতা

হাসিনার বিচার শুরুর আদেশ

রাজসাক্ষী মামুন

স্টাফ রিপোর্টার
১১ জুলাই ২০২৫, শুক্রবার
mzamin

জুলাই গণ-অভ্যুত্থান চলাকালে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার আসামি পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন দায় স্বীকার করে মামলায় ‘অ্যাপ্রুভার’ বা রাজসাক্ষী হওয়ার আবেদন করেছেন। মামলার অপর দুই আসামি ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের অব্যাহতির আবেদন খারিজ করে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের আদেশ দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল-১। সেইসঙ্গে প্রসিকিউশনের প্রারম্ভিক বিবৃতির (ওপেনিং স্টেটমেন্ট) ৩রা আগস্ট এবং মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ শুরুর জন্য ৪ঠা আগস্ট দিন ধার্য করেছেন ট্রাইব্যুনাল-১। মামলায় ৩ জন আসামির মধ্যে একমাত্র আবদুল্লাহ আল-মামুনই কারাগারে আটক আছেন, বাকি ২ জনকে পলাতক দেখিয়ে এ মামলার কার্যক্রম চলছে। মামলায় আসামিদের বিরুদ্ধে মোট ৫টি অভিযোগ আনা হয়েছে। গতকাল বিচারপতি মো. গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বে ৩ সদস্যের ট্রাইব্যুনাল-১ চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের রাজসাক্ষী হওয়ার আবেদন মঞ্জুর করেন। ট্রাইব্যুনালে অপর দুই সদস্য হলেন- বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ ও বিচারক মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী।

সকালে আবদুল্লাহ আল-মামুনকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়। শুনানিতে তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ পড়ে শোনান ট্রাইব্যুনাল-১। এ সময় আদালত জানতে চান, তার (চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন) বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের দায় তিনি স্বীকার করেন কি না। জবাবে চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন বলেন, তিনি দোষ স্বীকার করছেন। জুলাই-আগস্টে আন্দোলন চলাকালীন সময়ে আসামিদের বিরুদ্ধে হত্যা-গণহত্যা সংঘটনের অভিযোগ আনা হয়েছে, তা সত্য। এ ঘটনায় আমি নিজেকে দোষী সাব্যস্ত করছি। আমি রাজসাক্ষী হয়ে জুলাই-আগস্ট আন্দোলন চলাকালীন যে অপরাধ সংঘটিত হয়েছে, তার বিস্তারিত আদালতে তুলে ধরতে চাই। রহস্য উন্মোচনে আদালতকে তথ্য দিয়ে সহায়তা করতে চাই। পরে ট্রাইব্যুনাল তার আবেদন মঞ্জুর করেন। এ সময় মামুন যেহেতু দোষ স্বীকার করে নিয়েছেন, সেজন্য নিরাপত্তার স্বার্থে তাকে কারাগারে আলাদা সেলে রাখার আবেদন করেন তার আইনজীবী জায়েদ বিন আমজাদ। এ সময় প্রসিকিউশন থেকে জানানো হয় যে, মামুনের নিরাপত্তার জন্য আলাদা সেলে রাখলে প্রসিকিউশনের কোনো আপত্তি নাই। ট্রাইব্যুনাল সে বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়ার আশ্বাস দেন।

শুনানি শেষে চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, আবদুল্লাহ আল-মামুন আজ ট্রাইব্যুনালে উপস্থিত ছিলেন। তাকে অভিযোগ পড়ে শোনানো হয়। ট্রাইব্যুনাল জানতে চান, তাকে যে অভিযুক্ত করা হয়েছে, সে ব্যাপারে তার বক্তব্য কী? তিনি তার দোষ স্বীকার করেন। ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে যে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়েছিল, সেই অপরাধের সবকিছু তার জানার কথা। সব তথ্য উদ্‌ঘাটনের ব্যাপারে ট্রাইব্যুনালকে সহায়তার মাধ্যমে তিনি ‘অ্যাপ্রুভার’ হতে চেয়েছেন। সেই প্রার্থনা ট্রাইব্যুনাল মঞ্জুর করেছেন।

তাজুল ইসলাম বলেন, সুতরাং চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন পরবর্তী সময়ে এই ট্রাইব্যুনালে সুবিধাজনক সময়ে তার বক্তব্য উপস্থাপনের মাধ্যমে প্রকৃত ঘটনাসহ অপরাধ কাদের মাধ্যমে, কীভাবে সংঘটিত হয়েছিল, সেই তথ্য উদ্‌?ঘাটনে সাহায্য করবেন।

তিনি বলেন, যেহেতু মামলায় একজন আসামি উপস্থিত আছেন। বাকি আসামিরা পলাতক রয়েছেন। তাদেরকে উপস্থিত হতে বিজ্ঞপ্তি দেয়াসহ যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়েছে। কিন্তু তারা উপস্থিত না হওয়ায় রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বন্দিবিনিময় চুক্তির মাধ্যমে আসামিদের ফেরত আনার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু চুক্তির অপর পক্ষ ভারত সরকার সাড়া না দেয়ায় আসামিদের ফেরত আনা সম্ভব হয়নি।

শুনানি শেষে আসামিপক্ষের রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী মো. আমির হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, আসামিদের বিরুদ্ধে চার্জ গঠিত হয়েছে। কিন্তু বিচারপতিগণ এ কথাও বলেছেন আসামিদের ডিসচার্জের প্রেয়ারে আমি যেসব বক্তব্য তুলে ধরেছি, সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে যদি তার কোনো কিছু প্রাসঙ্গিক হয় তখন ট্রাইব্যুনাল তা বিবেচনায় আনবেন। মামলায় যুক্তিকর্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমরা আইনি লড়াই চালিয়ে যাবো। এখানে কোনো আসামি দোষ স্বীকার করেছে বলে অন্য আসামিরাও দোষী সে কথা বলা যাবে না।

উল্লেখ্য, চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন বিসিএস ৮ম ব্যাচের কর্মকর্তা। তিনি ১৯৬৪ সালের ১২ই জানুয়ারি সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলার শ্রীহাইল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজবিজ্ঞান বিষয়ে স্নাতকসহ (সম্মান) স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৮২ সালে বিসিএস (পুলিশ) ক্যাডারের ১৯৮৬ ব্যাচের (অষ্টম ব্যাচ) কর্মকর্তা হিসেবে পুলিশের সহকারী সুপারিনটেনডেন্ট (এএসপি) হিসেবে যোগ দেন। 

২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে আইজিপি’র দায়িত্ব নেন চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন। চাকরির স্বাভাবিক মেয়াদ অনুযায়ী, ২০২৩ সালের ১১ই জানুয়ারি তার অবসরে যাওয়ার কথা ছিল। ২০২৩ সালের ১২ই জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের ১১ই জুলাই পর্যন্ত তাকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয় সরকার। পরে ২০২৪ সালে এক বছর মেয়াদে তাকে আবার চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয়া হয়। গত ৫ই আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটলে তিনি আত্মগোপন করেন। পরে তার চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল করে অন্তর্বর্তী সরকার। গত বছরের ৩রা সেপ্টেম্বর তাকে গ্রেপ্তারের বিষয়টি গণমাধ্যমকে নিশ্চিত করেন ডিএমপি’র গণমাধ্যম ও জনসংযোগ বিভাগ। জানানো হয়, চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন সেনা হেফাজতে ছিলেন। তার বিরুদ্ধে মামলা হওয়ায় তিনি সেনা হেফাজতে থাকা অবস্থায় আত্মসমর্পণের ইচ্ছা প্রকাশ করেন। পরে তাকে পুলিশ হেফাজতে নেয়া হয়।

কর্মজীবনে আবদুল্লাহ আল মামুন পুলিশ সদর দপ্তর, মেট্রোপলিটন পুলিশ, আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন এবং বিভিন্ন জেলার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ইউনিটের দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সদর সার্কেল এএসপি, সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জ সার্কেল এএসপি, চাঁদপুরের হাজীগঞ্জ সার্কেল এএসপি, চাঁদপুরের অতিরিক্ত এসপি, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের সহকারী কমিশনার (ডিএমপি), আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের এএসপি, এডিসি (ডিএমপি) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এছাড়া নীলফামারী জেলার সুপারিনটেনডেন্ট পুলিশ (ডিপি), ডিএমপি’র ডেপুটি কমিশনার (ডিসি), এআইজি (এস্টাবলিশমেন্ট) এবং ঢাকা সদর দপ্তরের এআইজি (গোপনীয়) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। পরে ঢাকা রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি ও ডিআইজি হন। 

৫টি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ 
গণভবনের সংবাদ সম্মেলনে উস্কানিমূলক বক্তব্য: ২০২৪ সালের ১৪ই জুলাই গণভবনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে শেখ হাসিনা উস্কানিমূলক বক্তব্য দেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে আসাদুজ্জামান খান কামাল, চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনসহ তৎকালীন সরকারের অন্যান্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের প্ররোচনা ও সহায়তায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং আওয়ামী সন্ত্রাসীরা নিরীহ ছাত্র-জনতার ওপর ব্যাপক মাত্রায় ও পদ্ধতিগতভাবে হামলা চালায়। এর মাধ্যমে হত্যা, হত্যার চেষ্টা, নির্যাতন এবং অন্যান্য অমানবিক আচরণ করা হয়। এসব ঘটনায় আসামিদের প্ররোচনা, উস্কানি, সহায়তা, সম্পৃক্ততা, অপরাধ সংঘটন প্রতিরোধে ব্যর্থতা, অপরাধ সংঘটনের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের শান্তি প্রদান না করা এবং ষড়যন্ত্র করার অপরাধ যা আসামিদের জ্ঞাতসারে ছিল বলে উল্লেখ করা হয়।

হেলিকপ্টার ও প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের নির্দেশ: শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি আন্দোলনকারীদের দমনে হেলিকপ্টার, ড্রোন এবং প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের নির্দেশ দেন। আসাদুজ্জামান খান কামাল ও চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন এই নির্দেশ বাস্তবায়নে তাদের অধীনস্থ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নির্দেশনা দেন। এর মাধ্যমে আসামিরা অপরাধ সংঘটনের নির্দেশ প্রদান, সহায়তা, সম্পৃক্ততা, এবং ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটন করেছে।

রংপুরে ছাত্র আবু সাঈদ হত্যা: ২০২৪ সালের ১৬ই জুলাই রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে ছাত্র আবু সাঈদকে গুলি করে হত্যার ঘটনায় শেখ হাসিনা, আসাদুজ্জামান খান কামাল এবং চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ- এই হত্যাকাণ্ডে তাদের নির্দেশ, প্ররোচনা, উস্কানি, সহায়তা, সম্পৃক্ততা, ষড়যন্ত্র, অন্যান্য অমানবিক আচরণের মাধ্যমে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটন হয়েছে।

চানখাঁরপুলে ছাত্র হত্যা: ২০২৪ সালের ৫ই আগস্ট ঢাকার চানখাঁরপুল এলাকায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতে ছয়জন ছাত্র নিহত হন। এই ঘটনাতেও শেখ হাসিনাসহ ৩ জনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে।

আশুলিয়ায় হত্যা ও লাশ পোড়ানো: ২০২৪ সালের ৫ই আগস্ট আশুলিয়ায় ছয়জনকে গুলি করে হত্যা; তাদের মধ্যে পাঁচজনের লাশ পুড়িয়ে দেয়া এবং একই সঙ্গে গুরুতর আহত একজনকে পুড়িয়ে দেয়ার ঘটনায় তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে। এই ঘটনায় তিন আসামি কর্তৃক হত্যার নির্দেশ, প্ররোচনা, উস্কানি, সহায়তা, সম্পৃক্ততা, ষড়যন্ত্র, অন্যান্য অমানবিক আচরণ করার মাধ্যমে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়েছে বলে অভিযোগ আনা হয়েছে। অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, আসামিদের জ্ঞাতসারে এবং তাদের নির্দেশে এই অপরাধগুলো সংঘটিত হয়েছে।

উল্লেখ্য, গত ৫ই আগস্ট ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন করা হয়। পুনর্গঠিত ট্রাইব্যুনালে গণ-অভ্যুত্থানে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে প্রথম মামলাটি (মিস কেস বা বিবিধ মামলা) হয় শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে। এছাড়াও শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে আরও ২টি মামলা রয়েছে। যার মধ্যে একটি আওয়ামী লীগ শাসনামলের সাড়ে ১৫ বছরে গুম-খুনের ঘটনায় তাকে আসামি করা হয়েছে। অপরটি রাজধানীর মতিঝিলের শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশে হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় করা মামলা। জাজ্বল্যমান এসব অপরাধের বিচার অনুষ্ঠিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে।
 

প্রথম পাতা থেকে আরও পড়ুন

প্রথম পাতা সর্বাধিক পঠিত

   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2025
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status