অনলাইন
একমাত্র গ্লোবাল আইকন ড. ইউনূসের মতো তরুণেরা কেন চিন্তা করতে পারে না?
সুবাইল বিন আলম
(১ বছর আগে) ৩ অক্টোবর ২০২৩, মঙ্গলবার, ৯:৫০ পূর্বাহ্ন
সর্বশেষ আপডেট: ৩:৫৬ অপরাহ্ন
বিভিন্ন কাজের মাধ্যমে থাকার জন্য আমার তরুণ সমাজের সঙ্গে থাকার সৌভাগ্য হয়। তাদের সঙ্গে কথা বলাতে তাদের অনেক মতামত শুনতে শুনতে আমি একটা জিনিস খেয়াল করলাম তাদের ড. ইউনূসকে নিয়ে অজ্ঞানতা। এর একটা প্রধান কারণ এখন বিসিএস ছাড়া অন্য কিছু পড়তে না চাওয়া। আর একটা কারণ হচ্ছে গত ১০ বছরে মিডিয়াতে খুব বেশি না আসা। বেশির ভাগ মানুষ আসলে কি জানে ? উনি নোবেল প্রাইজ পেয়েছেন, যেখানে তার নিজের যোগ্যতার থেকে বিদেশীদের লবিংয়ে পেয়েছে বেশি বলার চেষ্টা থাকে। আর মাইক্রোক্রেডিটের মাধ্যমে মানুষজনকে সুদের ফাঁদে ফেলে দেয়া হয়েছে, কিছু মানুষের উপকার হয়েছে, কিন্তু অনেকে ফতুর হয়েছে। আসলে কি এত অল্প তার পরিধি? বিশ্ব ব্যাংকের ২০১৬ সালের তথ্যমতে, মাইক্রোফিনান্স থেকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সারা বিশ্বে উপকৃত হয়েছে ২১১ মিলিয়ন মানুষ। হ্যাঁ অনেক সমালোচনা আছে প্রয়োগ নিয়ে, কিন্তু কোনো তত্ত্বই তো শতভাগ নিখুঁত না। কিন্তু সময়ের সাথে সীমাবদ্ধতা কেটে যেতে থাকে।
২০০২-২০০৩ এর আগে কোনো বিদেশীকে বাংলাদেশ চেনাতে গেলে বলা লাগতো বাংলাদেশের পাশের দেশ ভারত। বিদেশে বাংলাদেশের দোকানগুলোর পরিচিতি–ভারতীয় রেস্তোরাঁ হিসেবে। কেউ কেউ যাতে বিদেশীরা বুঝতে না পারে–ছোট্ট করে বাংলাতে বাংলাদেশ লিখে দেয়, যেন নিজেরও লজ্জা লাগে বলতে। এখন তো অনেকেই বিদেশে যায়- আমাদের পরিচয় দিতে আর কিছু বলা লাগে? সময় বদলেছে না? আমাদের অনেকের এই কথা শোনা লাগছে- তোমরা ইউনূসের দেশের লোক। জ্বী, আমি অন্য কারো নাম আজ পর্যন্ত শুনি নাই। আপনারা কি শুনেছেন? এখন দেখি এই মানুষটি জীবনে কি কি করেছে? চট্টগ্রাম কলেজ থেকে পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতির উপর বিএ, এমএ শেষ করেন। এরপর ফুলব্রাইট স্কলারশীপ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ভ্যানডারবিল্ট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি শেষ করেন ১৯৭০ সালে। ১৯৬৯-৭২ পর্যন্ত তিনি অর্থনীতির সহকারী অধ্যাপক হিসেবে ছিলেন, কাজ করেছেন মিডল টেনেসিস স্টেট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। এরমধ্যে মুক্তিযুদ্ধের সময় ইউএসএ-তে সমর্থন আদায়ের লক্ষ্যে নাগরিক কমিটি এবং তথ্য কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন এবং বাংলাদেশ নিউজলেটার প্রকাশ করেন। দেশ স্বাধীন হলে দেশে ফিরে এসে প্রথমে পরিকল্পনা অধিদপ্তরে যোগ দিলেও পরে অর্থনীতির বিভাগীয় প্রধান হয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেন। ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষের বীভৎসতা দেখে উনি দারিদ্র্যতা দূরীকরণ প্রজেক্ট নিয়ে কাজ শুরু করেন, ১৯৭৫ সাল থেকে যার শুরু হয় ‘তেভাগা’ খামার প্রজেক্ট। পরে তা থেকে আসে গ্রামীণ ব্যাংক প্রজেক্ট। জোবরা গ্রামে শুরু হওয়া এই প্রজেক্ট গ্রামীণ ব্যাংকে রুপান্তরিত হয় ১৯৮৩ সালে। এই ক্ষুদ্রঋণের প্রজেক্ট ৪২ জন দিয়ে শুরু হলেও ২০২২ সালের জানুয়ারী মাসের তথ্য অনুসারে ঋণগ্রহীতা ছিলো ৯৫ লাখ যার প্রায় শতকরা ৯৭ জন মহিলা। এখানে লক্ষ্যণীয় যে, এই ব্যাংকের ৯২ শতাংশের মালিক ঋণগ্রহীতারা এবং ৮ শতাংশের মালিক সরকার। তাহলে ড. ইউনূস সুদখোর হলেন কিভাবে বোধগম্য না।
গ্রামীণ ব্যাংক থেকে অপসারিত হলেও গ্রামীণের প্রায় ২৯টি সহযোগী প্রতিষ্ঠানে এখনো তিনি পরিচালক পদে কাজ করে যাচ্ছেন। এছাড়াও তিনি মেম্বার অথবা পরিচালক হিসেবে কর্মরত আছেন বা ছিলেন ৯টি দেশের প্রায় ২০টি বিদেশী প্রতিষ্ঠানের। পরিচালনা ছাড়াও বিভিন্ন কমিটি বা কমিশনে এখনো কাজ করছেন তিনি। দেশের ৯টি কমিটি মেম্বার হিসেবে কাজ করলেও বর্তমানে তার মেধা দেশ কোন কাজে নিচ্ছে না। কিন্তু বিদেশি ৩৮টি কমিটি এবং কমিশনের সাথে তিনি যুক্ত। যার মধ্যে আছে জাতিসংঘের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্ত্ররাজ্য, ইউরোপীয়ান ইউনিয়নের বিভিন্ন দেশ সহ প্রায় সব মহাদেশেই তাঁর কাজের অভিজ্ঞতা আছে। সারা পৃথিবী উনার সাহায্য পাওয়ার জন্য উদ্গ্রীব, আর আমরা কোনো কিছুতে উনাকে সংযুক্ত রাখলামই না!
উপদেষ্টা হিসেবে এখনো যুক্ত আছেন আরও ৪৪টি বিদেশী প্রতিষ্ঠানের সাথে। এছাড়া তিনি কাজ করে যাচ্ছেন ‘ইউনূস সোশ্যাল বিজনেস-গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভ’-এ। যার ৯৭টি শাখা ছড়িয়ে আছে সারা বিশ্বজুড়ে। গ্রামীণের এই সামাজিক ব্যবসা মডেলের ধারণা নিয়েছে বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়, পৃথিবী সেরা উদ্যেক্তারা বা কর্পোরেটরা। তাঁর বয়স মাত্র ৮৩।
এবার আসি একাডেমিক দিকে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও তিনি কাজ করেছেন গ্লাসগো ক্যালেনডিয়ন বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর হিসেবে। এখনো চ্যান্সেলর হিসেবে আছেন আল বুখারী বিশ্ববিদ্যালয়, মালয়েশিয়াতে। ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে আছেন ইউনিভার্সিটি টেকনোলজি, মালয়েশিয়াতে এবং সংযুক্ত প্রফেসর হিসেবে আছেন লা ট্রব বিজনেস স্কুল, অস্ট্রেলিয়াতে। তিনি ২০-এর অধিক দেশ থেকে ৬২টি সম্মানসুচক ডক্টরেট ডিগ্রী পেয়েছেন। তাঁর নিজের লিখিত বই আছে ৯টির মতো। কিন্তু গুগল স্ক্লারে উনার নাম দিয়ে সার্চ দিলে হাজারের উপর, লাখের মতো জার্নাল পাওয়া যায়, যারা তাঁর কাজকে নিজের গবেষণায় রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করেছে। তাঁর লেকচার শোনার জন্য মানুষ অপেক্ষা করে, আগে থেকে শিডিউল নিয়ে ঠিক করতে হয়। সব থেকে বেশি সম্মানী পাওয়া মানুষদের একজন তিনি। এছাড়াও সব বিখ্যাত টিভি শোতে অংশ নিয়েছেন। তার ফলোয়ার সংখ্যাও বিশ্বের মধ্যে প্রথম সারির। বিভিন্ন দেশ তাঁর এবং গ্রামীণ ব্যাংকের সাফল্যগাথা পাঠ্যপুস্তকের অংশ করে নিয়েছে।
নোবেল প্রাইজ ছাড়াও তিনি মাত্র ৭ জন মানুষের মধ্যে একজন, যারা প্রেসিডেন্সিয়াল মেডেল অফ ফ্রীডম এবং কংগ্রেশনাল গোল্ড মেডেল পেয়েছেন। ফরচুন ম্যাগাজিন তাকে বিশ্বের সেরা ১২জন উদ্যোক্তা হিসেবে সম্মানিত করেছিলেন। বিশ্বের প্রথম সারির নিউজ পত্রিকাগুলো তাকে ‘মোস্ট ইনফ্লুইয়েন্সিয়াল’ মানুষদের তালিকাতে রাখে। অলিম্পিকে আমাদের দেশ সবথেকে বেশি বার অংশগ্রহণ করে কোন পদক না পাওয়া দেশের মধ্যে এক নং-এ থাকলেও আমাদের জন্য সম্মান নিয়ে এসেছিলেন মুহাম্মদ ইউনূস। ২০১৬ সালে অলিম্পিক মশাল বহন এবং ২০২১ সালে অলিম্পিক লরিয়েল হিসেবে সম্মাননা নিয়ে আসেন তিনি। বাংলাদেশে তার পুরস্কারপ্রাপ্তি শুরু হয়েছিলো ১৯৭৮ সালে প্রেসিডেন্ট অ্যাওয়ার্ডের মাধ্যমে। কিন্তু শেষ সম্মাননা আসে তাঁর নোবেল প্রাইজ পাওয়া উপলক্ষে ডাকটিকেট উন্মোচনের মধ্য দিয়ে। আমরা এরপর আর কিছুই দিতে পারি নাই। কিন্তু ২০২১ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন দেশের ১৪৫টি পুরস্কার তিনি পেয়েছেন। এর ভিতর আছে ১০টি দেশের রাষ্ট্রীয় সম্মাননা, আছে নাগরিকত্ব। ২০০৮ সালে টেক্সাস ১৪ই জানুয়ারিকে ‘মুহাম্মদ ইউনূস ডে’ ডিক্লেয়ার করেছেন। তাঁর বন্ধু তালিকাতে আছে নেলসন মেন্ডেলা থেকে শুরু করে বিশ্বের অনেক রাষ্ট্রপ্রধান, নোবেল লরিয়েট, গবেষক, সাংবাদিকেরা। এখানে একটা কথা মনে রাখবেন- পরিচিতি এবং বন্ধুত্ব এক না।
কিন্তু তার সব সাফল্য থমকে গেছে বাংলাদেশে এসে। ২০১০ থেকে শুরু হয় বিভিন্ন মামলা, যা এখন ১৬৮টি (চ্যানেল ২৪, ৩১ আগস্ট, ২০২৩)। বিচারাধীন বিষয় নিয়ে কথা বলা ঠিক হবে না। কিন্তু দেশের বিচারাধীন মামলা আছে ৪২ লাখ (জনকণ্ঠ ৩০ মার্চ, ২০২৩), সেগুলোর সমাধান না করে ঘন ঘন মামলার দিন ফেলে বিচার শেষ করার চেষ্টা দেখা গেলে, অনেকেই সন্দেহ করবে। আর কাছাকাছি সময়ে অনেকগুলো মামলা হলে, সেটাও বহির্বিশ্বের চোখে পড়বেই। উনার যেন কোনো বিচারিক হয়রানি না হয়, এই ব্যাপারে আশা করি বিচার বিভাগ লক্ষ্য রাখবে। কারণ, একটা ভুল বিদেশে আমাদের নেতিবাচক চিত্রই প্রকাশ করবে।
আমাদের তরুণেরা হতাশ থাকে, কারণ তাদের সামনে কোনো আইকন নাই। কিন্তু দেশের একজনের এত সাফল্য আমরা জানিও না। মুহাম্মদ ইউনূসের এত সাফল্যগাথা আমি এই স্বল্প জায়গাতে নিয়ে আসতে পারি নাই। আমি উনার কনসেপ্ট নিয়েও আলোচনা করতে পারি নাই, এগুলো নিয়ে সবাই গুগল করলেই পড়তে পারবেন। আসলে এত ক্ষুদ্র পরিসরে সম্ভবও না সব আলোচনার। কিন্তু ভেবে দেখেন, যখন ইন্টারনেট ছিলো না, সেই সময়ে একজন মানুষ ছোট্ট গ্রাম থেকে শুরু করে নিজেকে ৬৭ বছরের সাধনাতে নোবেল পুরস্কারের পর্যায়ে নিয়ে এসেছেন এবং তাঁর মারফত চিনিয়েছেন বাংলাদেশকে, বিশ্বকে শিখিয়েছেন অনেক কিছু- এখনকার তরুণেরা কেন স্বপ্ন দেখতে ভয় পায়? তাদের তো সুযোগ অনেক বেশি। উনি দারিদ্র্যতাকে যাদুঘরে পাঠাতে চান, আপনারাও কি নতুন কিছু নিয়ে আসতে পারেন না?
তথ্যসুত্রঃ উইকিপিডিয়া, ইউনুস সেন্টার, ব্রিটানিকা, হাভারড বিজনেস রিভিউ।
সুবাইল বিন আলম, টেকসই উন্নয়নবিষয়ক কলামিস্ট।
ইমেইল- [email protected]