শেষের পাতা
অপহরণ করে স্বর্ণ-টাকা লুট করাই তাদের পেশা
শুভ্র দেব
১ অক্টোবর ২০২৩, রবিবারদুবাই প্রবাসী আবিদুল্লাহ মুন্সী (২৪)। চলতি বছরের পহেলা জানুয়ারি তিনি দুবাই থেকে ঢাকার বিমানবন্দরে আসেন। সেখান থেকে রাত ১১টার দিকে একটি সিএনজি নিয়ে তার বড় ভাইয়ের খিলগাঁওয়ের বাসার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেন। চালককে তিনি বাড্ডা প্রগতি সরণি দিয়ে খিলগাঁও যাওয়ার কথা বলেন। কিন্তু চালক ওইদিকে না গিয়ে মহাখালী সড়ক দিয়ে যায়। ১৫ মিনিট পরে সিএনজিটি আর্মি স্টেডিয়ামের বিপরীতে ফ্লাইওভারের ঢালে পৌঁছামাত্র একটি মাইক্রোবাস তাকে বহনকারী সিএনজিকে বেরিক্যাড দিয়ে বাধা দেয়। এ সময় মাইক্রোবাস থেকে কয়েকজন নেমে সিএনজি’র দিকে এগিয়ে আসে। চালক তখন তার বাম পাশের দরজা খুলে দেয়। পুলিশ পরিচয় দিয়ে ওই ব্যক্তিরা আবিদুল্লাহর হাতে হাতকড়া পরিয়ে টেনেহিঁচড়ে সিএনজি থেকে বের করে মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে যায়। পরে তাকে মাইক্রোবাসের মাঝের সিটে বসিয়ে গামছা দিয়ে চোখ বেঁধে ফেলে এলোপাতাড়িভাবে মারধর করে। প্রাণে মেরে ফেলবে বলে ভয়ভীতি ও হুমকি দেয়। মারধর ও আতঙ্কে আবিদুল্লাহ ভীত হয়ে তার কাছে থাকা ১৬ লাখ টাকা মূল্যের ২৩৪ গ্রাম ওজনের ২টি স্বর্ণের বার, ১০০ গ্রাম ওজনের ১৬ লাখ টাকা মূল্যের স্বর্ণালংকার, নগদ টাকা, ল্যাপটপসহ মূল্যবান আরও অনেক কিছু নিয়ে যায়। পরে তাকে চোখ বাঁধা অবস্থায় পূর্বাচল ৪নং সেক্টরে কাঞ্চন ব্রিজের নিচের রোডের মাথায় ফেলে দেয়। পরে তিনি এ ঘটনায় বনানী থানায় ২৩শে জানুয়ারির একটি মামলা করেন।
দুবাই প্রবাসী ভুক্তভোগীর মামলার পর তদন্ত শুরু করে ডিবি। কিন্তু ক্লু-লেস এই ঘটনার তদন্ত করতে গিয়ে প্রাথমিকভাবে কোনো ক্লু খুঁজে পায়নি পুলিশ। পরে, বাদীর বক্তব্য পর্যালোচনা, সিসি ক্যামেরার ফুটেজ ও প্রযুক্তিগত সহযোগিতা নিয়ে ডিবি’র গুলশান বিভাগের ক্যান্টনমেন্ট জোনাল টিমের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার এস এম রেজাউল হকের নেতৃত্বে অপহরণ ও ডাকাত দলের সদস্যদের শনাক্ত করে ৬ জন ডাকাতকে গ্রেপ্তার করে। ২৭শে সেপ্টেম্বর ঢাকা মহানগরীর কাফরুল ও মিরপুর মডেল থানা এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তারকৃতরা হলো- মো. হাবিবুর রহমান হাবু (৫২), মো. শাহীন দেওয়ান (৪৩), মিঠুন বসু (৩৮), মো. সাইফুল ইসলাম (৩৬), জাকির হোসেন হাওলাদার (৩৫) ও মো. মঞ্জুর আলম (৩৩)। গ্রেপ্তারের সময় তাদের কাছ থেকে একটি নেভি ব্লু ট্রাভেলস ব্যাগে রক্ষিত অবস্থায় ডিএমপি পুলিশের ৩ সেট ইউনিফর্ম এবং ৫ ভরি ৩ আনা ১ রতির তৈরি স্বর্ণালংকার উদ্ধার করা হয়। ডিবি’র প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার বিষয়টি স্বীকার করেছে। তাদের নামে ডিএমপি ছাড়াও দেশের বিভিন্ন থানায় একাধিক চাঁদাবাজি, ছিনতাই ও মাদক মামলা রয়েছে।
ডিবি’র তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, চক্রটি গত ৫ থেকে ৭ বছর ধরে মানুষকে অপহরণ করে তুলে নিয়ে টাকা, স্বর্ণালংকার লুট করে। তারা দেশের বিভিন্ন বিমানবন্দর এলাকায় অবস্থান করে বিদেশ ফেরত যাত্রীদের টার্গেট করে। চক্রের একাধিক সদস্য বিমানবন্দরের বিভিন্ন স্থানে অবস্থান নেয়। একেক সদস্য একেক ধরনের কাজ করে। ইমিগ্রেশন করা অবস্থায় ওই যাত্রীদের টার্গেট করা শুরু করে তারা। টার্গেট ব্যক্তিদের পরনের পোশাকের ধরন, নাম ভেতর থেকে অন্য সদস্যকে পাঠানো হয়। অনেক সময় টার্গেট যাত্রীদের সিএনজি ও মাইক্রোবাস ভাড়া করে দেয় তারা। পরে যাত্রীকে বহনকারী গাড়িকে চক্রের দু’জন সদস্য মোটরসাইকেলে ফলো করতে থাকে। তারা মোটরসাইকেলে করে কিছুদূর ফলো করতে করতে চক্রের মাইক্রোবাসে থাকা অপারেশনাল টিমকে তথ্য দেয়। একপর্যায়ে মাইক্রোবাসে করে আসা ৪-৫ জনের একটি টিম যাত্রীর গাড়িকে টার্গেট করতে থাকে। সুবিধাজনক ও নির্জন কোনো স্থানে যাওয়া মাত্রই চক্রের কয়েকজন সদস্য যাত্রীর গাড়ির গতিরোধ করে পুলিশ, ডিবি ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অন্যান্য সংস্থার পরিচয় দিয়ে অভিযোগ আছে বলে তাদের মাইক্রোবাসে তুলে নেয়।
ক্যান্টনমেন্ট জোনাল টিমের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার এসএম রেজাউল হক মানবজমিনকে বলেন, চক্রটি ডাকাতির সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পোশাক পরে। ভুক্তভোগীর সামনে তারা এমনভাবে কথা বলে ও ব্যবহার করে দেখে বোঝার উপায় নাই তারা ভুয়া। অনেক সময় ভুক্তভোগীর হাতে হ্যান্ডকাপ পরিয়ে মাইক্রোবাসে তুলে। পরে হাত-পা ও চোখ বেঁধে মারধর করে ভয় দেখায়। মেরে ফেলারও হুমকি দেয়। এতে করে ভুক্তভোগীদের তেমন কিছু করার থাকে না। সহজেই চক্রটি সবকিছু তাদের হেফাজতে নিয়ে ভুক্তভোগীকে গাড়ি থেকে ফেলে দেয়। তিনি বলেন, শুধু একটি ঘটনাই নয়। এ রকম আরও অনেক ঘটনা ঘটছে। বেশ কয়েকটি চক্র বিমানবন্দর দিয়ে আসা যাত্রীদের টার্গেট করে কাজ করে। বেশির ভাগ সময় কেউ থানায় অভিযোগ করতে চায় না তাই এসব বিষয় সামনে আসে না। বিমানবন্দর থেকে বের হয়ে খিলক্ষেত, পূর্বাচল বা গাজীপুর রোডের নির্জন স্থানে তারা এসব কাজ করে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তারা জানিয়েছে, বিদেশ থেকে আসার সময় যারা স্বর্ণ নিয়ে আসে তাদেরকেই তারা টার্গেট করে। প্রত্যেকটি সফল অপারেশন শেষে যা আসে সেগুলো চক্রের সদস্যরা ভাগবাটোয়ারা করে নিয়ে যায়।