ঢাকা, ৯ মে ২০২৫, শুক্রবার, ২৬ বৈশাখ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, ১০ জিলক্বদ ১৪৪৬ হিঃ

শেষের পাতা

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় সিএনজি রেজিস্ট্রেশন বাণিজ্য

৫ কোটি টাকা গেল কোথায়?

জাবেদ রহিম বিজন, ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে
২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩, বুধবার

সরকার নির্ধারিত রেজিস্ট্রেশন ফি প্রায় ১৬ হাজার ৯’শ টাকা। সেখানে নেয়া হচ্ছে ৪৫ থেকে ৫০ হাজার টাকা। কাগজপত্রের ত্রুটি থাকলে তারও বেশি।  রমরমা এমন বাণিজ্য চলছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় সিএনজিচালিত অটোরিকশার রেজিস্ট্রেশনে। গত আড়াই মাসে প্রায় ১৮’শ সিএনজি অটোরিকশার লাইসেন্স সম্পন্ন করেছে ব্রাহ্মণবাড়িয়া বিআরটিএ কার্যালয়। সেই হিসাবে এরইমধ্যে হাতিয়ে নেয়া হয়েছে ৫ কোটিরও বেশি টাকা। সিএনজি অটোরিকশা মালিক সমিতি এবং দালালদের মাধ্যমে এই টাকা সংগ্রহের অভিযোগ ওপেন সিক্রেট। অভিযোগ রেজিস্ট্রেশনের জন্য জমা করা কাগজপত্রও যাচাই বাছাই করা হচ্ছে না ঠিকমতো। শুধু তাই নয়, অন্য জেলা থেকে কিনে আনা সিএনজি অটোরিকশার রেজিস্ট্রেশন সম্পন্ন করা হচ্ছে। গত ১৫ই জুন  জেলা যাত্রী ও পণ্য পরিবহন কমিটির সভায় ২০২২ সালের ৩১শে ডিসেম্বর পর্যন্ত ক্রয়কৃত সিএনজিচালিত অটোরিকশা রেজিস্ট্রেশনের আওতায় নিয়ে আসার সিদ্ধান্ত হয়। যাতে সভাপতিত্ব করেন ওই কমিটির সভাপতি জেলা প্রশাসক মো. শাহগীর আলম। এরপরই রেজিস্ট্রেশন শুরু করে বিআরটিএ অফিস।

সিএনজিচালিত অটোরিকশার রেজিস্ট্রেশনকে কেন্দ্র করে ব্রাহ্মণবাড়িয়া বিআরটিএ  অফিসের ভেতরে-বাইরে সরগরম অবস্থা দেখা যায় প্রতিদিন। দালালদের হাত ধরে সেখানে ভিড় করেন গাড়ি মালিকরা। শুরু হয় রমরমা বাণিজ্য। তবে রেজিস্ট্রেশনে বাণিজ্যের অভিযোগ উঠায় রেজিস্ট্রেশন বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছেন জেলা প্রশাসক। গতকাল  সোমবার বিকালে বিআরটিএ অফিসে গিয়ে দেখা যায়, মালিক ও শ্রমিক সংগঠনের নেতা কুদ্দুস মিয়া ও হেবজুল করিম বিআরটিএ’র সহকারী পরিচালকের কাছে রেজিস্ট্রেশন বন্ধ রাখার কৈফিয়ত চাইছেন। দিচ্ছেন হুমকি। ২০১৪ সাল থেকে জেলায় সিএনজিচালিত অটোরিকশার লাইসেন্স বন্ধ ছিল।  

শহরের পৈরতলা বাসস্ট্যান্ডে কথা হয় নতুন রেজিস্ট্রেশন করা সিএনজিচালিত এক অটোরিকশা মালিকের সঙ্গে। ওই সিএনজি মালিক জানান, রেজিস্ট্রেশনে তার খরচ হয়েছে ৫২ হাজার টাকা। এরমধ্যে ২৬ হাজার টাকা নেয়া হয়েছে ব্যাংক ড্রাফটের কথা বলে। বিআরটিএ অফিসে যারা কাজ করবে তাদের জন্য ১০ হাজার টাকা। আর বাকি টাকা যার মাধ্যমে করিয়েছে সে নিয়েছে। শহরের মেড্ডার এক ওয়ার্কশপ মালিকের মাধ্যমে তিনিসহ ৪০ জন তাদের রেজিস্ট্রেশন করিয়েছেন। তবে  মেড্ডার ওই ওয়ার্কশপ মালিক জহির ১০টি গাড়ির রেজিস্ট্রেশন করিয়ে দেয়ার কথা স্বীকার করেন। জানান, একজনের মাধ্যমে এই কাজ করিয়েছেন। টাকা কীভাবে কি হয়েছে সেটি তার জানা নেই। মেড্ডায় আরেক সিএনজি অটোরিকশার মালিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, কথা ছিল ব্রাহ্মণবাড়িয়ার  গাড়িগুলোর রেজিস্ট্রেশন হবে। বলতে গেলে  জেলার পূর্বাঞ্চলের কিছু গাড়ি ছাড়া ব্রাহ্মণবাড়িয়ার গাড়ি রেজিস্ট্রেশনের বাকি নেই। এই সুযোগে যারা গাড়ির কেনাবেচায় জড়িত, আমরা যাদের ব্যাপারী বলি তারা চট্টগ্রাম, ফেনী, কুমিল্লা, হবিগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ থেকে অনটেস্ট গাড়ি এনে এখানে নাম্বার লাগাচ্ছে। কিন্তু নিয়ম হচ্ছে যে জেলা থেকে গাড়ি কেনা হয়েছে সেখানেই রেজিস্ট্রেশন করতে হবে। এক্ষেত্রে বিআরটিএ অফিসে একটি কাজ করে রেজিস্ট্রেশনের জন্য যে কাগজপত্র জমা দেয় সেখান থেকে শোরুমের কাগজটি সরিয়ে ফেলে। তখন আর বোঝায় উপায় থাকে না গাড়িটি কোন জায়গা থেকে কেনা হয়েছে। এখানে রেজিস্ট্রেশন নিয়ে সংগঠনের নেতা ও তাদের সাঙ্গপাঙ্গরা একটা হিসাব করেছেন। মোট সাড়ে ৩ কোটি টাকার খেলা। এরমধ্যে খুচরা হিসাবে এম আই এক্সট্রা একটা টাকা নিচ্ছে। নাম্বার প্লেটের জন্য সরকারি জমা হওয়ার পরও তারা আবার নাম্বার প্লেটের জন্য অতিরিক্ত ৫ শ’ টাকা নিচ্ছে। ব্লু বুকের ফিঙ্গারের জন্য নিচ্ছে ৫ শ’ টাকা। এসব হচ্ছে হিসাবের বাইরে। আর সাড়ে ৩ কোটি টাকা সংগঠন, বিআরটিএ এবং এল আর ফান্ড-এই খাতে ভাগবাটোয়ার কথা শুনেছি। মালিক সমিতির সিগন্যাল ছাড়া রেজিস্ট্রেশন হয় না। ব্যাংকের কাগজটা তাদের মাধ্যমেই হয়। 

জেলা সিএনজি মালিক সমিতির সাবেক নেতা সাইফুল ইসলাম অপু বলেন- জেলায় আগের রেজিস্ট্রেশনকৃত ৫ সহস্রাধিক সিএনজি’র মধ্যে ১/২’শ সিএনজি অটোরিকশারও নবায়ন নেই। নবায়ন থেকে টাকা খাওয়া যাবে না বলে বিআরটিএ’র লোকজন রেজিস্ট্রেশন শুরু করেছে। অথচ গাড়িগুলো নবায়ন করলে সরকার অনেক টাকা পেতো। একটা সিন্ডিকেট করে তারা রেজিস্ট্রেশনের জন্য ৪০/৪৫ হাজার টাকা করে নিচ্ছে। সিএনজি অটোরিকশা মালিক সমিতির সাবেক ভারপ্রাপ্ত সভাপতি কাজী মনিরুল ইসলাম বলেন-সবমিলিয়ে সরকারি ভাবে রেজিস্ট্রেশনে ১৮ থেকে ২০ হাজার টাকা খরচ। কিন্তু বিআরটিএ ৪০/৪২ হাজার টাকা নিচ্ছে। কেন তারা এত টাকা নিচ্ছে সেটি আমাদের বোধগম্য নয়। 
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে জেলার বিভিন্ন উপজেলায় ব্যাপারী বা গাড়ি কেনাবেচায় জড়িতরা এই রেজিস্ট্রেশনের দালালি করছে। জেলা সদরে ঘাটুরার সাজু হাজারী, মেড্ডার হুটমিস্ত্রি আবুল, মিস্ত্রি রুবেল ও জামাল সিএনজি অটোরিকশার রেজিস্ট্রেশন দালালিতে জড়িত বলে জানান সিএনজি মালিকরা। সরাইলে রেজিস্ট্রেশন বাণিজ্যে জড়িত আলমগীর। তিনি সেখানকার অন্নদা স্কুল মোড় সিএনজি অটোরিকশা স্ট্যান্ডের শ্রমিক সংগঠনের নেতা। তিনি রেজিস্ট্রেশন করায় জড়িত নন জানিয়ে বলেন- নিজের ৪টি গাড়ি রেজিস্ট্রেশন করিয়েছেন। বিআরটিএ অফিসে মোত্তাকিন নামে একজনের সঙ্গে যোগাযোগ করার পরামর্শ দিয়ে বলেন- তার মাধ্যমে সহজে রেজিস্ট্রেশন করতে পারবেন। উচালিয়াপাড়ার আল-আমিন রেজিস্ট্রেশন করে বলেও জানান। আলমগীর জেলার নেতা কুদ্দুস মিয়া ও বাহারের সঙ্গে যোগাযোগ করারও পরামর্শ দেন। 

তবে সরাইলের কয়েকজন সিএনজি অটোরিকশা মালিক জানান, নেতা আলমগীরের কাছে অনেক চালক ও মালিক টাকা দিয়েছেন। ৪২-৪৫ হাজারের নিচে তিনি নিচ্ছেন না। আর সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে আরও ২ জন অনেকের কাছ থেকে কাগজ আর টাকা নিচ্ছেন বলেও জানান তারা। বিআরটিএ কর্মকর্তার দপ্তর  থেকে ৫০-৬০টি গাড়ি রেজিস্ট্রেশন করার ভাগ নিয়েছেন তারা সাংবাদিক পরিচয়ে। এরপর উপজেলার বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে তারা নম্বর দেয়ার কথা বলে চালক ও মালিকদের কাছে টানেন। পরে দর কষাকষি করে গাড়ির কাগজপত্র হাতে নেন। প্রতি নম্বরের মূল্য ৪০-৪৫ হাজার টাকা জানিয়ে তারা গ্রাহকদের বলেন, ১৬-১৮ হাজার টাকার কাগজ পাবেন। বাকি টাকার কোনো কাগজ পাবেন না। কারণ সেই টাকাটা হচ্ছে বিভিন্ন খরচ। ব্রাহ্মণবাড়িয়া বিআরটিএ কার্যালয়ে আরেক সাংবাদিকের নাম লেখা ফাইলের স্তূপ দেখা গেছে। 

তবে জেলা সিএনজি অটোরিকশা মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক  কুদ্দুস মিয়া এবং সভাপতি মিজানুর রহমান দু’জনই রেজিস্ট্রেশন তাদের মাধ্যমে হচ্ছে না দাবি করে বলেন-তারা রেজিস্ট্রেশনের অনুমতি এনে দিয়েছেন। টাকা নেয়ার অভিযোগ মিথ্যা। যেসব গাড়ি রেজিস্ট্রেশন হচ্ছে সেগুলো বাইরে থেকে আনা বলেও জানান তারা। বলেন- ব্রাহ্মণবাড়িয়া বুকিংয়ের শতকরা দুটি গাড়িও নেই। ব্রাহ্মণবাড়িয়া বিআরটিএ’র সহকারী পরিচালক প্রকৌশলী আশরাফ সিদ্দিকী বলেন-আমার অফিসের কাউকে টাকা দিয়ে থাকলে তারা আমার কাছে অভিযোগ করতে পারে। আমাদের ঊর্ধ্বতন কর্র্তৃপক্ষ আছে তাদের জানাতে পারে। আমাদের নামে কারা টাকা পয়সা নিচ্ছে এর একটা বিহীত হওয়া উচিত। জেলা প্রশাসক মো. শাহগীর আলম বলেন- আমার উদ্দেশ্য সিএনজিগুলো রেগুলারাইজ করা এবং সরকারের রেভিনিউ অর্জন করা। কেউ এসে অতিরিক্ত টাকা নেয়ার অভিযোগ করলে তা অবশ্যই শক্তভাবে দেখা হবে।

শেষের পাতা থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

শেষের পাতা সর্বাধিক পঠিত

   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2025
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status