অনলাইন
মর্মস্পর্শী দৃশ্য
মা-বাবাহারা বাচ্চাকে বাঁচাতে মাঝরাতে এক হিজড়ার দৌড়ঝাঁপ
ইমরান আলী
২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩, শনিবারবামে- আমেনার কোলে হোসাইন, মাঝে বৃষ্টি রায়, ডানে বস্তিবাসীর আহাজারি
শুক্রবার সন্ধ্যা। মিরপুর কমার্স কলেজ-সংলগ্ন ঝিলপাড় বস্তির সামনে দেখা গেল এক মর্মস্পর্শী দৃশ্য। অন্তত শ’ দুয়েক বস্তিবাসী করুণচোখে তাকিয়ে। ভেতর থেকে ভেসে আসছে কান্না। কয়েকজন হিজড়া বিলাপ করছেন।বলছেন, আমাদের ছেড়ে চলে গেলিরে ভাই! ডুকরে ডুকরে কাঁদছেন তারা। কারো সান্ত্বনায় তা থামছে না। সে বস্তিরই বাসিন্দা অনিকের জন্য কষ্ট পাচ্ছেন।
কিন্তু হৃদয়বিদারক দৃশ্যের পুরো অংশ এটি নয়। অনিকের পাশাপাশি আরও তিনজনের জন্য কাঁদছেন তারা। এর আগে বৃহস্পতিবার রাতে ঢাকা সাক্ষী হয় অবর্ণনীয় ভোগান্তির। প্রায় পুরো ঢাকা কার্যত অচল তখন তুমুল বৃষ্টি, জলাবদ্ধতায়। জল ও যানজটে পড়েন নগরবাসী। আর এই ভোগান্তির পাশাপাশি ঘটে যায় আরেকটি বেদনাদায়ক ঘটনা।
সেদিন রাত ৯টার পর মিরপুর কমার্স কলেজ-সংলগ্ন ঝিলপাড় বস্তির বিপরীত পাশে রাস্তায় মিজান, তার স্ত্রী মুক্তা ও লিমা (৭) বিদ্যুতায়িত হয়ে মারা যান। তাদের উদ্ধার করতে গিয়ে বিদ্যুতায়িত হয়ে প্রাণ হারান একই এলাকার বাসিন্দা মোহাম্মদ অনিক নামের এক যুবক।
শুক্রবার সন্ধ্যা ফুরিয়ে এলেও হিজড়াদের কান্না বেড়েই চলেছে। সাথে বস্তিবাসীদের আর্তনাদ। গতরাতে জলাবদ্ধ পানিতে বিদ্যুতায়িত হয়ে মিজান-মুক্তা, লিমা মারা গেলেও ভাগ্যক্রমে বেঁচে যায় শিশু হোসাইন। বয়স মাত্র সাতমাস। অবুঝ এই বাচ্চাটা পানিতে ভাসছিল। তার গেঞ্জি ধরে বাঁচানোর চেষ্টা করে এক যুবক। সে ছুড়ে দেয় আরেক যুবকের কাছে। সেখান থেকে আমেনা নামের এক নারী (যিনি ঝিলপাড় বস্তিতে থাকেন) বাচ্চাটাকে কোলে তুলে নেন। এই উদ্ধারে হাত লাগান একই বস্তির হিজড়া বৃষ্টি রায়।
মা-বাবা হারানো মাসুম বাচ্চাকে নিয়ে কোথায় কোথায় দৌড়ালেন বৃষ্টি রায় সে বর্ণনা দিলেন মানবজমিনকে শুক্রবার সন্ধ্যায়।
তার ভাষায়, বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ৯টা। সারাদিন বৃষ্টি। আমি ঘরে ছিলাম তখন। শুনতে পেলাম বাইরে চারটা লোকের দুর্ঘটনা ঘটেছে। সাথে সাথে আমি চলে যাই। দেখি চারজন মারা গেছে অলরেডি। এক পিচ্চি ছেলে একটা বাচ্চাকে পানি থেকে উঠিয়ে নিয়ে আসছে। বাচ্চাটাকে মহিলারা সবাই ঘরে নিয়ে বুক-পিঠে তেল, রসুন মালিশ করলো। বাচ্চাটার নিঃশ্বাস এলো। নাক-মুখ দিয়ে ব্লেডিং হচ্ছিল। সবাই বলছিল- বেঁচে যাবে। কিন্তু মেডিকেলে নেয়ার মতো কেউ নেই। সবাই লাশ নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করছে। শেষে বললাম, আমাকে দাও(বাচ্চাকে), আমি যাচ্ছি। প্রচুর বৃষ্টি। আমি ভিজে নিয়ে গেলাম। আমার সাথে এক আন্টি গেল। প্রথমে নিলাম মিরপুর শিশু হাসপাতাল দুই নম্বরে। কিন্তু তারা বলল, আমাদের এখানে সম্ভব নয়। সোহরাওয়ার্দীতে নিয়ে যাও। নিয়ে গেলাম। ওরাও রাখেনি। বলল, ঢাকা মেডিকেলের সাথে একটা মেডিকেল আছে ওখানে নিয়ে যাও। ওখানেও আমাকে রাখেনি। তারা বলল, বাচ্চাতো সুস্থ। পুড়ে যায়নি। পুড়ে গেলে আমরা ট্রিটমেন্ট দিতাম। তুমি ঢাকা মেডিকেল নিয়ে যাও। ঢাকা মেডিকেলে নিলাম। ওখানে পুলিশ আমাকে হেল্প করলো। আমার কাছে বিস্তারিত শুনলো। টিকিট কাউন্টারে নিয়ে গেল। টিকিট কাটলাম। ভর্তি করলাম। ডাক্তার চেকআপ করলো। ওরা বলল, তুমি টেনশন করো না। ওর শ্বাস বেড়ে গেছে। স্যালাইন দিলো, সুই দিলো। সারা রাত আমি ওখানে ছিলাম। সকালে রিলিজ দেয়। তারপর নিয়ে এসেছি।
বৃষ্টি রায় রাত সাড়ে ১২টায় ঢামেকে নিয়ে যায় শিশু হোসাইনকে। তার আগে যখন বৃষ্টি রায় শিশু হাসপাতালে নিয়ে যান হোসাইনকে তখন প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছিল । বললেন, ওখান থেকে বের হয়ে আর সিএনজি বা কিছুই পাচ্ছিলাম না। আমি বাচ্চাটাকে নিয়ে একটা ব্রীজের নিচে দাঁড়িয়ে ছিলাম। তারপর একজন এসে জিজ্ঞাসা করলেন- কোথায় যাবে? মেডিকেলে যাবো। কিন্তু আমি গাড়িও পাচ্ছি না, সিএনজিও পাচ্ছি না। রিকশাও পাচ্ছি না। কীভাবে যাবো। প্রচুর জ্যাম। তারপর আরও একটা রোগী এলো ঢাকা মেডিকেলের। এ্যাম্বুলেন্স এলো। দু’জন মিলে দু’হাজার টাকায় কন্ট্রাক্ট করে তারপর নিয়ে গেছি।
বৃষ্টি রায় বললেন, সেখানে(দুর্ঘটনাস্থলে) বাচ্চাটা পানি খেয়ে ভাসছিল। এই বাচ্চা, বাচ্চার বাবা(মিজান), মা (মুক্তা) ও লিমাকে বাঁচাতে গিয়েই অনিক মারা গেছে।
কথাগুলো শেষ করেই কাঁদতে লাগলেন বৃষ্টি রায়। তখন সাতমাস বয়সী বেঁচে ফেরা হোসাইন ঘুমাচ্ছিল সে বস্তিতে আমেনার কোলে। এ রিপোর্ট লেখার সময় হোসাইনের মা-বাবার লাশের অপেক্ষায় বস্তিবাসী।