ঢাকা, ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, বৃহস্পতিবার, ২৮ ভাদ্র ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ৮ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিঃ

বাংলারজমিন

অনিয়ম অব্যবস্থাপনায় ইস্পাতের সেই দুই লাভজনক প্রতিষ্ঠানও ডুবছে এখন

জালাল রুমি, চট্টগ্রাম থেকে
২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩, শনিবার

বাংলাদেশ ইস্পাত ও প্রকৌশল করপোরেশন (বিএসইসি)। শিল্প মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণাধীন এই সংস্থার অধীনে এক সময় ছিল ৬৩টি প্রতিষ্ঠান। তবে কমতে কমতে এখন মাত্র ৯টি প্রতিষ্ঠান চালু আছে। এরমধ্যে বন্দরনগরী চট্টগ্রামে অবস্থিত গাড়ি নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান ‘প্রগতি ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড’ ও সুপার এনামেল কপার উৎপাদনকারী ‘গাজী ওয়্যার্স লিমিটেড’ ছাড়া বাকি প্রতিষ্ঠানগুলো দীর্ঘদিন ধরে লোকসানের তালিকায় আছে। আর এখন অনিয়ম-অব্যবস্থাপনা ও ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের স্বেচ্ছাচারিতায় লাভজনক এই দুইটি প্রতিষ্ঠানও ডুবতে বসেছে। 

আবুল কালাম আজাদ। তিনি বিএসইসি’র অধীন প্রগতি ইন্ডাস্ট্রির ব্যবস্থাপনা পরিচালক। ৪ মাস ধরে প্রতিষ্ঠানটির এমডি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। কমার্স ব্যাকগ্রাউন্ডে পড়াশোনা মানে ননটেকনিক্যাল ব্যক্তি হয়েও তাকে দেশের এই গুরুত্বপূর্ণ অটো মোবাইল সেক্টরের দায়িত্ব দেয় ইস্পাত করপোরেশন। আর ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব লাভের কয়েক মাসের মধ্যেই গাড়ি বিক্রির চুক্তি করে প্রগতির প্রায় ১০ কোটি টাকার ক্ষতি করেছেন তিনি। অথচ এই পদে দায়িত্ব পালনের জন্য প্রতিষ্ঠানটিতে ২৫ জন উচ্চপদস্থ ডিজিএম ও জিএম মানের অভিজ্ঞ প্রকৌশলী ছিলেন। 

সূত্রমতে, ২০২২ সালের ২২শে জুন প্রগতির ৩২৫তম বোর্ড সভায় ডাবল কেবিন পিকআপ গাড়ির মূল্য পুনর্নির্ধারণের জন্য এজেন্ডা উপস্থাপিত হয়। সেই এজেন্ডায় মিতসুবিশি ডাবল কেবিন পিকআপের বিক্রয়মূল্যও নির্ধারণ করা হয়। পরে এটি অনুমোদনের জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করা হয়। অর্থমন্ত্রণালয় প্রতিটি গাড়ির মূল্য (সরঞ্জাম, রং, হুট-ইনস্ট্রাকচার ও রেজিস্ট্রেশন মূল্যসহ) নির্ধারণ করে ৫৫ লাখ টাকা। কিন্তু বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবুল কালাম আজাদ বোর্ড সভার অনুমোদনকে উপেক্ষা করার পাশাপাশি অর্থ মন্ত্রণালয় কর্তৃক নির্ধারিত গাড়ির মূল্য তালিকা আমলে নেননি। নিজের মতো করে মূল্য (সরঞ্জামাদি ছাড়া) নির্ধারণ করেন ৪৫ লাখ টাকা। এতে ১০০ গাড়ির জন্য প্রগতির আর্থিক ক্ষতি হয়েছে প্রায় ১০ কোটি টাকা। 

শুধু এটি নয়, তার তৈরিতে ব্যবহৃত দামি কপার টেপ চুরির মতো ঘটনাও ঘটেছে আবুল কালাম আজাদের আমলে। ২০২২ সালে আবুল কালাম আজাদ চট্টগ্রামের পতেঙ্গায় অবস্থিত বিএসইসি’র আরেক প্রতিষ্ঠান ইস্টার্ন ক্যাবলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক থাকা অবস্থায় আড়াই টন কপার টেপ চুরির ঘটনা ঘটে। এই তারের বর্তমান বাজার মূল্য এক কোটি ২০ লাখ টাকা। ওই ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটি কপার টেপ চুরির বিষয়টির সত্যতা পায়।

ইস্টার্ন ক্যাবলের একজন কর্মকর্তা মানবজমিনকে বলেন, এই টেপ চুরির ঘটনায় আবুল কালাম আজাদ দায়িত্ব এড়াতে পারেন না। কারণ ওই সময় তিনি ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন। প্রাথমিক তদন্তে তাকে দোষী সাব্যস্তও করা হয়েছিল। কিন্তু তখনো তিনি বেঁচে যান নিরীহ কর্মকর্তাদের ফাঁসিয়ে দিয়ে। এসব বিষয়ে জানতে প্রগতির ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবুল কালাম আজাদকে বারবার ফোন দেয়া হলেও তিনি সাড়া দেননি। তার হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে ক্ষুদে বার্তা দেয়া হলেও কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি। 
এদিকে আবুল কালাম আজাদের আগে প্রগতি ইন্ডাস্ট্রিজ এর এমডি ছিলেন মোহাম্মদ তৌহিদুজ্জামান। তার বিরুদ্ধে নিয়োগে অস্বচ্ছতা, টেন্ডার ছাড়া মালামাল কেনা, অনুমোদনহীন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেয়া, প্রকল্পের কাজ না করেই অর্থব্যয়, সরকারি তেল ব্যবহারে অনিয়মসহ নানা অভিযোগ আছে। এরমধ্যে আছে পাবলিক প্রকিউরমেন্ট রুল্‌স (পিপিআর) লঙ্ঘন করে টেন্ডার ছাড়াই ২২ কোটি ৭০ লাখ টাকার বেশি ব্যয়ে ডাবল কেবিন পিকআপ গাড়ি কেনার অভিযোগ। বাণিজ্যিক অডিট অধিদপ্তরের সংশ্লষ্টিরাও তার বিরুদ্ধে নানা অনিয়মের সত্যতা তুলে ধরেছে। বেশ কয়েকটি খাতে এমডির ব্যয় নিয়ে আপত্তির কথা জানিয়েছে সরকারের বাণিজ্যিক অডিট অধিদপ্তর। এরমধ্যে চাকরিতে তার নিয়োগও ছিল অবৈধ। 

জানা যায়, তৌহিদুজ্জামানের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগের প্রেক্ষিতে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে তদন্তের জন্য শিল্প সচিবকে নির্দেশ দেয়া হয়। এমনকি অনিয়মের প্রমাণ পাওয়ায় তৌহিদুজ্জামানের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনের ঢাকার সহকারী পরিচালক মাহবুবুল আলম বাদী হয়ে মামলা করেন। কিন্তু শিল্পমন্ত্রীর পিএস আব্দুল ওয়াহেদের হস্তক্ষেপের কারণে এখনো পর্যন্ত তৌহিদুজ্জামানের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করননি শিল্প সচিব। দুদকের মামলারও কোনো গতি নেই এখন।

ইস্পাত করপোরশেনের আরেকটি লাভজনক প্রতিষ্ঠান গাজী ওয়্যার্স লিমিটেড। চট্টগ্রামের কালুরঘাটে অবস্থিত প্রতিষ্ঠানটির বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মনিরুজ্জামান। তিনি ভুয়া অভিজ্ঞতা সনদ দেখিয়ে ২০১১ সালে ইস্পাত করপোরশেনের ব্যবস্থাপক পদে নিয়োগ পান। ১০ বছর পর ২০২১ সালে বিষয়টি নিয়ে তদন্ত করে সত্যতা পায় প্রতিষ্ঠান। কিন্তু ইস্পাত করপোরেশন তার বিরুদ্ধে কোনো বিভাগীয় ব্যবস্থা নেননি। মনিরুজ্জামানসহ বিএসইসি’র ৩ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্তে উচ্চ পর্যায়ের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয় ২০২১ সালে। ওই তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন বিএসইসি’র হিসাব নিয়ন্ত্রক এএম রিজওয়ান হোসেন এবং ব্যবস্থাপক (সমন্বয় ও আইন) এসএম মুসলিম উদ্দিন।

তদন্ত রিপোর্টে বলা হয়, নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী ব্যবস্থাপক (প্রশাসন/বাণিজ্য) পদে কেবল যাদের স্নাতকোত্তর ডিগ্রিসহ ১০ বছরের বাস্তব অভিজ্ঞতা আছে- এমন প্রার্থীদের আবেদন করার সুযোগ ছিল। তবে মো. মনরিুজ্জামানের সে ক্ষেত্রে ৮ বছর ১১ মাসের অভিজ্ঞতা ছিল।
এ ব্যাপারে তদন্তের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এসএম মুসলিম উদ্দিন বলেন, রিপোর্টে সবকিছু উল্লেখ করে প্রতিবেদন জমা দেয়া হয়েছে। এরচেয়ে বেশিকিছু আর বলতে পারবো না।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, চলতি বছরে মনিরুজ্জামান গাজী ওয়্যার্সের ১৯৬ টন তামার তার বর্তমান বাজার দর থেকে অনেক কম দামে বিক্রি করেন। এই ১৯৬ টনের মধ্যে ৪৭ টন ইস্টার্ন ক্যাবলকে দিয়ে বাকিগুলো বিভিন্ন বেসরকারি কোম্পানির কাছে বিক্রি করা হয়। অভিযোগ রয়েছে, ইর্স্টান ক্যাবলকে সামনে রেখে বেসরকারি কোম্পানি থেকে অবৈধ সুবিধা নিয়ে এত কম দামে তামার তার বিক্রি করে প্রতিষ্ঠানের প্রায় ১০ কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি করেন মনিরুজ্জামান।

এদিকে অভিযোগের বিষয়ে যোগাযোগ করার পরও মনিরুজ্জামান কথা বলতে রাজি হননি। তিনি প্রতিষ্ঠানের জনসংযোগ কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলে ফোন কেটে দেন। অফিসে গেলে কর্মচারী মনিরুজ্জামান মিটিংয়ে আছেন বলে ব্যস্ততা দেখান।

 

বাংলারজমিন থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

বাংলারজমিন সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status