ঢাকা, ১৯ মে ২০২৪, রবিবার, ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১০ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিঃ

প্রথম পাতা

সিপিডি’র সংবাদ সম্মেলন

অনৈতিক, টাকা পাচারকারীদের জয়

অর্থনৈতিক রিপোর্টার
১১ জুন ২০২২, শনিবার
mzamin

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সিনিয়র রিসার্চ ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান বলেছেন, অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে যারা সম্পদশালী, টাকা-পয়সা আছে ধনিক শ্রেণি, উদ্যোক্তা-ব্যবসায়ী, যারা টাকা পাচার করে তাদের জয়টাই বেশি দেখা যাচ্ছে। গরিবের জন্য বাজেটে তেমন কিছু নেই। সবচেয়ে বেশি উপেক্ষিত  হয়েছে মধ্যবিত্ত।

গতকাল শুক্রবার রাজধানীর গুলশানের লেকশোর হোটেলে ‘জাতীয় বাজেট ২০২২-২৩, সিপিডির পর্যালোচনা’ শীর্ষক মিডিয়া ব্রিফিংয়ে এ তথ্য জানান তিনি। সংবাদ সম্মেলনে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন। এ সময় সিপিডির বিশেষ ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান, গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম, সিনিয়র গবেষক তৌফিকুল ইসলাম খান, সিনিয়র রিসার্চ ফেলো মুনতাসির কামাল এবং রিসার্চ ফেলো সৈয়দ ইউসুফ সাদাতসহ আরও অনেকে উপস্থিত ছিলেন। বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ কর দিয়ে বৈধ করার যে সুযোগ নতুন অর্থবছরের বাজেটে দেয়া হচ্ছে, তা কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য হতে পারে না বলে মনে করছে সিপিডি।

প্রস্তাবিত বাজেটে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণসহ ৬টি ‘রোগ’ চিহ্নিত করতে পারলেও সেগুলো সারাতে ওষুধ ঠিকমতো দেয়া হয়নি বলে মন্তব্য করেছে সিপিডি। সংস্থাটি বলছে, বাজেটে বিশেষ কিছু মানুষকে সুবিধা দেয়া হয়েছে। এতে সৃজনশীলতার মারাত্মক ঘাটতি রয়েছে। সংবেদনশীলতার অভাব রয়েছে। বাস্তবতা বিবেচনায় বাজেটে আরও সৃজনশীলতা দরকার ছিল বলেও মনে করে সিপিডি।

তৌফিকুল ইসলাম খান বলেন, প্রস্তাবিত বাজেটে সম্পদশালী, ধনিক শ্রেণি আর অর্থ পাচারকারীরাই জিতেছেন।

বিজ্ঞাপন
সে অর্থে গরিবদের জন্য সুবিধা দেয়া হয়নি। তিনি বলেন, এ বাজেটে সবচেয়ে বেশি উপেক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি। মধ্যবিত্তের জন্য বাজেটে কিছু দেখা গেল না। ল্যাপটপের ওপর কর হার বাড়ানো ঠিক হয়নি। এতে বোঝা যাচ্ছে যারা বাজেট তৈরি করেন, তাদের বর্তমান বাজারের সঙ্গে কোনো সংযোগ নেই। বক্তব্য দেয়ার সময় নিজের মন খারাপের কথা উল্লেখ করে তৌফিকুল ইসলাম খান বলেন, এমন একটি বাজেট দেয়া হলো যেখানে পাচারকারীদের দেশে টাকা ফিরিয়ে আনার সুযোগ দেয়া হলো। অথচ কর ফাঁকি রোধে কঠোর কোনো পদক্ষেপের কথা বলা হলো না। প্রাতিষ্ঠানিক পদক্ষেপের কথাও উল্লেখ নেই। তিনি বলেন, সরকার ধরেই নিয়েছে করোনা চলে গেছে। করোনার সামগ্রীর ওপর কর আরোপ করা হয়েছে। এটা ঠিক হয়নি। কোনো কারণে করোনা মহামারি আবার ফিরে এলে ব্যবসায়ীরা অধিক মুনাফা করবেন।

সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন এ সময় বলেন, নিত্যপণ্যের দাম কমাতে বাজেটে পর্যাপ্ত পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। চাল, ডালসহ ২৯টি নিত্যপণ্যের দাম কমানোর দরকার ছিল, কিন্তু করা হয়নি। সিপিডির পক্ষ থেকে নিত্যপণ্যের দাম কমাতে কর কমানোর সুপারিশ করা হয়েছিল। কিন্তু সেটিও রাখা হয়নি। তিনি বলেন, বর্তমানে মূল্যস্ফীতি রয়েছে ৬.২৯ শতাংশ। এ অবস্থায় প্রস্তাবিত বাজেটে মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় ৫.৬ শতাংশ। আগামী এক বছরে মূল্যস্ফীতি কীভাবে কমবে? কারণ, পৃথিবীর অনেক দেশ অর্থনৈতিক মন্দায় চলে যাবে। তাহলে কীভাবে মূল্যস্ফীতি কমবে, এটাই বড় প্রশ্ন।

প্রস্তাবিত বাজেটে বিশেষ কিছু মানুষকে সুবিধা দেয়া হয়েছে বলে মনে করে সিপিডি। সংস্থাটি বলছে, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বাজেটে সুনির্দিষ্ট কোনো পদক্ষেপ নেই। সামাজিক সুরক্ষা খাতে বরাদ্দ বাড়েনি। সিপিডি বলছে, বাজেটে সৃজনশীলতার মারাত্মক ঘাটতি রয়েছে। সংবেদনশীলতার অভাব রয়েছে। ফাহমিদা খাতুন বলেন, প্রস্তাবিত বাজেটে মূল্যস্ফীতির হার ৫.৬ শতাংশের মধ্যে রাখার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবতার সঙ্গে এর কোনো মিল নেই। বাজারে গেলে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের যে দাম, তার সঙ্গে সরকারের তথ্যের মিল পাওয়া যাচ্ছে না। অর্থমন্ত্রী হয়তো ভাবছেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, করোনা মহামারিসহ বর্তমান সংকট দ্রুত কেটে যাবে। কিন্তু কোন জাদুর কাঠি দিয়ে মূল্যস্ফীতি কমানো হবে, সে পথ দেখাননি অর্থমন্ত্রী।

বর্তমানে জনজীবনের ওপর চাপ রয়েছে। বাজেটে প্রত্যাশা ছিল নিম্ন ও মধ্য আয়ের মানুষকে স্বস্তি দেয়া হবে। কিন্তু দেয়া হয়নি। উল্টো বিত্তবানদের কর কমানো হয়েছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট যে লক্ষ্য নিয়ে প্রণয়ন করা হয়েছে তা পূরণে নেয়া পদক্ষেপগুলো পরিপূর্ণ নয়। নীতি-কৌশলের ক্ষেত্রে পদক্ষেপ অসম্পূর্ণ এবং বিদ্যমান চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় তা অপর্যাপ্ত।

সিপিডির নির্বাহী পরিচালক বলেন, মূল্যস্ফীতি ও বৈশ্বিক অর্থনীতির নানা চাপ রয়েছে। চাপ মোকাবিলায় ৬টি লক্ষ্যের কথা বলেছেন অর্থমন্ত্রী। যার মধ্যে রয়েছে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগ বৃদ্ধি, বর্ধিত ভর্তুকির জন্য অর্থায়নের সংস্থান, বৈদেশিক অর্থের ব্যবহার নিশ্চিত করা, টাকার বিনিময় মূল্য স্থিতিশীল রাখা এবং রিজার্ভ সন্তোষজনক রাখা। আমরা দেখেছি বাজেটে মূল্যস্ফীতি কথাটি অনেকবার এলেও এটি নিয়ে অর্থমন্ত্রীর পদক্ষেপ পর্যাপ্ত নয়। কর কাঠামোতে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যে কর প্রত্যাহারের প্রস্তাবনা যথেষ্ট নয়। অনেক পণ্যেই কর রয়ে গেছে। বাজেটে গম ছাড়া নিত্যপ্রয়োজনীয় অনেক পণ্যে কর-ছাড় নেই। মূল্যস্ফীতির এ সময়ে করমুক্ত আয়সীমা বৃদ্ধি করা হয়নি, ভর্তুকি ও সামাজিক সুরক্ষার আওতা ওই অর্থে বাড়েনি।

ড. ফাহমিদা বলেন, বিদেশ থেকে অর্থ আনার বিষয়টি সম্পূর্ণ অনৈতিক। আর একটি বিষয় হচ্ছে, এটা কখনই বাস্তবায়নযোগ্য নয়। তারচেয়ে বড় কথা হলো, এটা অনৈতিক। একদিকে অর্থপাচারের সুযোগ দিয়ে আবার অর্থ ফিরিয়ে আনার সুযোগ করে দেব; অন্যদিকে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য কর ছাড় থাকবে না, এটা সামাজিক ন্যায় বিচারের জন্য গ্রহণযোগ্য নয়।

সিপিডির বিশেষ ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, বাজেটে মূল্যস্ফীতির চাপ সহনীয় রাখার জন্য যে উদ্যোগ ও উদ্যম আছে, তার চেয়ে বেশি আগ্রহ বিশেষ কিছু মানুষকে, যারা দেশের প্রচলতি আইন-কানুন ভঙ্গ করে টাকা নিয়ে গেছেন বাইরে, তাদের নিয়ে। মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, এ প্রস্তাব নৈতিকভাবে গ্রহণযোগ্য না, অর্থনৈতিকভাবে যৌক্তিক না এবং রাজনৈতিকভাবেও এটা জনগণের কাছে উপস্থাপন করা যাবে না। সিপিডি সব সময় এই ধরনের পদক্ষেপের বিরোধিতা করে মন্তব্য করে তিনি বলেন, এখন আরও জোরালোভাবে বিরোধিতা করার সময় এসেছে। তিনি বলেন, অনেকে দেশে অবৈধ উপায়ে টাকা আয় করে সেটা বিদেশে নিয়ে গেছেন। 

বাংলাদেশ থেকে বৈধভাবে টাকা বাইরে নিয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। পিকে হালদারের বিপুল অর্থ পাচারের প্রসঙ্গ ধরে তিনি বলেন, কিছুদিন আগেও বহুল আলোচিত একটি কেইস সম্পর্কে আপনারা ভালো জানেন। সেই ঘটনা নিয়ে যদি তখন আলোচনা না হয়ে এখন আলোচনা হতো, তাহলে দেখা যেত যে তার কোনো অপরাধই হয়নি। তিনি বাইরে যে সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকার মতো নিয়ে গেছেন, সেটা তিনি ডিক্লেয়ার করে ৭, ১০ বা ১৫ শতাংশ দিয়ে এটাকে বৈধ করে দেশে আসতে পারতেন। এই ধরনের সুযোগ আমাদের নীতি এবং নৈতিকতার সঙ্গে খাপ খায় না। এর আগেও আমরা দেখেছি বিভিন্ন ধরনের সুযোগ দিয়ে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেয়া হয়েছে। 

কিন্তু দেখা গেছে, ওই প্রক্রিয়াও আমাদেরকে তেমন রাজস্ব দেয়নি। এটা রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও নৈতিক তিনভাবেই অগ্রহণযোগ্য। মোস্তাফিজ বলেন, এ ধরনের সুযোগ দিলে ভবিষ্যতে যারা বাইরে টাকা পাচার করার চিন্তা করতেন না, তারাও কিন্তু মনে করবেন যে আমি এখানে ২৫ শতাংশ আয়কর বা ৪২ শতাংশ করপোরেট ট্যাক্স দিয়ে লাভ কী? আমিতো এটাকে বাইরে নিয়ে গেলে সর্বোচ্চ ১৫ শতাংশ কর দিয়ে বৈধ করে নিয়ে আসতে পারবো। সরকারের এই সিদ্ধান্তে ভবিষ্যতে ‘দেশের টাকা উল্টো বাইরে নিয়ে যাওয়ার একটা প্রবণতা’ সৃষ্টি হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন সিপিডির সম্মানীয় ফেলো। এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, সরকারি পেনশন এবং সরকারি বিভিন্ন ইনস্ট্রুমেন্টে যে ভর্তুকি দেয়া হয়, এই দুটি বাদ দিলে নতুন বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা খাতের প্রকৃত বরাদ্দ আসলে ৩ হাজার কোটি টাকা কমে গেছে।

খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, পাচার হওয়া টাকা দেশে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ সৎ করদাতাদের জন্য চপেটাঘাত। এটি শুধু সুযোগই নয়, ওই ব্যক্তির জন্য দায়মুক্তিরও সুযোগ। সরকার এই সিদ্ধান্ত নেবে না এবং এখান থেকে সরে আসবে বলে প্রত্যাশা করেন খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। প্রস্তাবিত বাজেটে মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির প্রবৃদ্ধির যে লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছে, তা অর্জিত হবে না বলে মনে করে সিপিডি। এ বছর জিডিপির লক্ষ্য ধরা হয়েছে ৭.৫ শতাংশ। এ ছাড়া রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য উচ্চাভিলাষী বলছে সিপিডি। এ লক্ষ্যও অর্জিত হবে না। সিপিডির ৪ সুপারিশ: সুপারিশগুলো হলো- নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ওপর থেকে কর তুলে দেয়া কিংবা কর কমিয়ে ফেলার সুপারিশ, আমদানির ক্ষেত্রে এবং দেশের ভেতরের পর্যায়েও। মধ্যম ও নিম্নমধ্যম আয়ের মানুষকে করের বোঝা থেকে কিছুটা অব্যাহতি দেয়া। ভর্তুকির জন্য পর্যাপ্ত অর্থ রাখা, যাতে গ্যাস-বিদ্যুতের মূল্য সহনীয় পর্যায়ে রাখা যায় এবং কিছুদিনের জন্য সেখানে ভর্তুকি চালিয়ে যাওয়া। জনগণের জন্য বিশেষ করে দরিদ্র জনগণের জন্য প্রয়োজন সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর প্রসার, এর আওতা বাড়ানো এবং পরিমাণও বাড়ানো।

প্রথম পাতা থেকে আরও পড়ুন

   

প্রথম পাতা সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status