প্রথম পাতা
বাজেট বৈষম্যহীন অঙ্গীকারের সঙ্গে সাংঘর্ষিক
স্টাফ রিপোর্টার
৪ জুন ২০২৫, বুধবার
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের মধ্যদিয়ে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম বাজেট বৈষম্যহীন সমাজ গঠনের মূল অঙ্গীকারের সঙ্গে চরমভাবে সাংঘর্ষিক বলে জানিয়েছেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন। তিনি বলেছেন, প্রস্তাবিত বাজেটে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ জুলাই চেতনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ নতুন বাজেট প্রস্তাবের পরদিন গতকাল রাজধানীর লেক শোর হোটেলে সংবাদ সম্মেলনে ফাহমিদা খাতুন এসব কথা বলেন। আবাসন খাতে টাকা সাদা করার সুযোগ দেয়ার সমালোচনা করে তিনি বলেন, সিপিডি সব সময়ই বলে এসেছে-অপ্রদর্শিত অর্থ, অর্থাৎ কালোটাকা বৈধ করার সুযোগ পুরোপুরি বন্ধ করা উচিত। এটি নৈতিকভাবে সমর্থনযোগ্য নয়। যারা সৎ করদাতা তাদের জন্য এটা অনুৎসাহ হিসেবে কাজ করে এবং এটা সৎ করদাতাদের জন্যও নৈতিকতার ওপর একটি আঘাত বলে আমরা মনে করি। কালোটাকা সাদা করার সুযোগ একেবারে বন্ধ করে দেয়ার দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, এটা বৈষম্য সৃষ্টির একটা হাতিয়ার। আবাসন খাতের মূল্য অত্যন্ত বেশি। বিভিন্নভাবে অবৈধভাবে উপার্জিত অর্থ সেই খাতে যেয়ে সেটার দাম বাড়িয়ে তুলে। যার ফলে সাধারণ জনগণ, যারা বৈধভাবে অর্থ উপার্জন করে, তাদের জন্য একটা অ্যাপার্টমেন্ট বা একটা বসত-বাড়ি কেনা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। যার ফলে সমাজে বৈষম্য হয়। এই যে জুলাই আন্দোলন হলো, সেটা তো বৈষম্যহীন সমাজের জন্য আন্দোলন হয়েছিল।
বাজেটেও বলা হচ্ছে যে, বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা করার। সেটার সঙ্গে এটা (টাকা সাদা করার সুযোগ) চরমভাবে সাংঘর্ষিক। করমুক্ত আয়সীমা প্রসঙ্গে ফাহমিদা খাতুন বলেন, করমুক্ত আয়সীমা ৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩ লাখ ৭৫ হাজার টাকা করা হয়েছে। এটা ভালো পদক্ষেপ। কিন্তু এই আয়সীমা কার্যকর হবে ২০২৬-২৭ এবং ২০২৭-২৮ অর্থবছর থেকে। কিন্তু আমরা যদি এখনই এটা বাস্তবায়ন করতে পারতাম, তাহলে সাধারণ মানুষের ওপরে আরও বেশি ইতিবাচক প্রভাব পড়তে পারতো। কেননা, ইতিমধ্যেই মূল্যস্ফীতির চাপ অনেক বেড়েছে। এটা যখন বাস্তবায়ন হবে তখন মূল্যস্ফীতি আরও বেড়ে যাবে। তিনি বলেন, বার্ষিক ৬ লাখ টাকা পর্যন্ত আয়ের মানুষকে কর দিতে হবে সাড়ে ১২ শতাংশ, বার্ষিক ১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত যারা আয় করেন তাদের দিতে হবে ১৬ দশমিক ৭ শতাংশ। কিন্তু ৩০ লাখ টাকার বেশি যারা আয় করবেন, তাদের কর দিতে হবে মাত্র ৭ দশমিক ৬ শতাংশ। অর্থাৎ যারা মধ্যম এবং নিম্ন আয়ের মানুষ, তাদের ওপরেই বেশি কর চাপানো হয়েছে। বাজেটে বৈষম্য দূরীকরণের কথা বলা হলেও বৈষম্যটা দূর হচ্ছে না। বরং এটা বাড়ার দিকেই আমরা দেখছি। এবারের বাজেটে মূল্যস্ফীতি ৬.৫%-এর মধ্যে রাখার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে, যা উচ্চাকাঙ্ক্ষী উল্লেখ করে ফাহমিদা বলেন, বছরের বিগত মাসের মূল্যস্ফীতির হার দেখে মনে হচ্ছে না এটি ৬.৫%-এর মধ্যে রাখা সম্ভব। বার্ষিক মূল্যস্ফীতি ৬.৫% রাখা সরকারের জন্য চ্যালেঞ্জিং হবে। বাজেটে শুল্ক হারের পুনর্বিন্যাসের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য আলোচনার বিষয়টি ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, যদি যুক্তরাষ্ট্রকে শুল্কে ছাড় দেয়া হয়, তাহলে অন্য দেশকেও দিতে হবে। নাহলে ডব্লিউটিওর নিয়ম লঙ্ঘন হবে। পাশাপাশি এনবিআর রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত হবে।
ফাহমিদা খাতুন বলেন, ২০২৫-২৬ অর্থবছরে শিক্ষা খাতে জিডিপি’র অনুপাতে বরাদ্দ কমে দাঁড়িয়েছে ১ দশমিক ৫৩ শতাংশ। এটি এলডিসিভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে তৃতীয় সর্বনিম্ন। আবার স্বাস্থ্য খাতে উন্নয়ন বরাদ্দ কমানো হয়েছে ১৩ শতাংশ। মানব উন্নয়নে এ দু’টি খাতে আরও বেশি বরাদ্দ প্রয়োজন। এ ছাড়া ভৌত অবকাঠামো খাতের মধ্যে পরিবহন ও বিদ্যুৎ খাতে ভালো বরাদ্দ হয়েছে বলেও জানান তিনি। ফাহমিদা খাতুন বলেন, বাজেটে শুধুমাত্র প্রবৃদ্ধিতে নজর না দিয়ে সামগ্রিক উন্নয়ন এবং জনগণের উপর নজর দেয়ার কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু বাজেটারি যে পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে, সেটার মাধ্যমে এটি প্রতিফলিত হয়নি। তিনি বলেন, বাজেটে অনেক ধরনের ইতিবাচক পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। বিভিন্ন খাতে বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে, অনেক ক্ষেত্রে কর কমানো হয়েছে এবং কর অবকাশ দেয়া হয়েছে, যেগুলো আমরা অস্বীকার করছি না। এগুলোকে আমরা ভালো পদক্ষেপ বলে মনে করছি। কিন্তু বিভিন্ন খাতে অর্থনৈতিক যে চ্যালেঞ্জগুলো রয়েছে, সেগুলো সামগ্রিকভাবে দেখার প্রয়োজন রয়েছে। শুধুমাত্র খণ্ডিতভাবে বিভিন্ন জায়গায় বরাদ্দ বাড়িয়ে বা কমিয়ে না, সামগ্রিক যে উদ্দেশ্য রয়েছে, সেটার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। বাজেটের ডকুমেন্টস-এর নামই দেয়া হয়েছিল বৈষম্যবিহীন। তবে বৈষম্যবিহীন স্পিরিটের সঙ্গে বাজেটের পদক্ষেপগুলো সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। আমরা আশা করি, অর্থ উপদেষ্টা বাজেটের প্রস্তাবগুলো বিবেচনা করে জনমুখী করবেন এবং বিশেষ করে কালোটাকা সাদা করার মতো নেতিবাচক পদক্ষেপগুলো বিবেচনা করবেন।
এদিকে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট সামষ্টিক অর্থনৈতিক প্রাক্কলনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও প্রত্যাশা পূরণ করেনি বলে মন্তব্য করেছেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি বলেন, বিভিন্ন সংস্কার কমিশনের সুপারিশ বাজেটে প্রতিফলিত হয়নি। সুতরাং সামগ্রিক বাজেট যদি বিবেচনা করি তাহলে অনুমানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ, কিন্তু প্রত্যাশার সঙ্গে কিছুটা হতাশাজনকও বটে। তিনি বলেন, যেহেতু জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে কর্মসংস্থান ও বৈষম্য হ্রাস করা বড় ধরনের দাবি ছিল। কিন্তু এটির জন্য বাজেটে সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি আমরা দেখিনি। রাজস্ব আয়ের বিষয়ে অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, আয় বৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ৮ দশমিক ৯ শতাংশ ধরা হয়েছে। কিন্তু এটি আগের বাজেটের ভিত্তিতে নির্ধারিত, বাস্তব আয় বিবেচনায় নয়। ফলে প্রকৃত রাজস্ব আয় বাড়াতে হবে ১৭-১৮ শতাংশ হারে। প্রস্তাবিত বাজেটে রাজস্ব আয় ৮ দশমিক ৯ শতাংশ বাড়ানোর লক্ষ্যমাত্রা নেয়া হলেও সরকারি ব্যয় বৃদ্ধির হার ৬ দশমিক ২ শতাংশ। মোট ব্যয় জিডিপি’র ১২ দশমিক ৭ শতাংশ ধরা হয়েছে, যা সংশোধিত ২০২৪-২৫ বাজেটে ছিল ১৩ দশমিক ৪ শতাংশ। অন্যদিকে রাজস্ব আয় জিডিপি’র ৯ শতাংশ ধরা হয়েছে, যা আগের ৯ দশমিক ৩ শতাংশের চেয়ে কম। ভ্যাট অব্যাহতি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এলএনজি আমদানি করে সরকার ও বেসরকারি খাত। সরকার নিজের ওপর ভ্যাট চাপায় না। তাই বেসরকারি খাত ভ্যাট কমানোর দাবি করেছে। তবে এলএনজি আমদানিতে ভ্যাট অব্যাহতি এবং ভর্তুকি বৃদ্ধি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে সিপিডি।
সংস্থাটি জানায়, ২০২৫-২৬ অর্থবছরে এলএনজি’র ভর্তুকি ৬ হাজার কোটি টাকা থেকে বেড়ে ৯ হাজার কোটি টাকা হওয়ায় স্থানীয় গ্যাস অনুসন্ধান এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানির প্রসার ব্যাহত হতে পারে। মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ভারত ও ভুটানের মতো দেশ যেখানে বেশি রাজস্ব আয় করে, সেখানে আমাদের লক্ষ্য আরও বড় হওয়া উচিত। রাজস্ব সংগ্রহ ব্যবস্থা ডিজিটালাইজ করতে হবে। তবে এই লক্ষ্য অর্জন সম্ভব নয়। রেমিট্যান্স প্রসঙ্গে অধ্যাপক মোস্তাফিজুর বলেন, হুন্ডির মাধ্যমে অর্থ পাচার হয়ে যায়। এটা বাজেটে উল্লেখ করতে হতো। তবে নতুন করে টাকা পাচার বন্ধ করা হয়েছে এটার জন্য সাধুবাদ জানাতে হবে। এই যে রেমিট্যান্স প্রবাহ ৭ বিলিয়ন ডলার বেশি আসবে, এটার পেছনে একটি বড় কারণ হলো যে টাকাটা হুন্ডির মাধ্যমে চলে যেত সেটা অনেকটা বন্ধ হয়েছে। এটা মনে রাখতে হবে, যে এক বছরে ৩০ শতাংশের মতো রেমিট্যান্স হঠাৎ করে কিন্তু আসছে না। তিনি বলেন, এটাও মনে রাখতে হবে আমাদের জিডিপি হলো ৪৬০ বিলিয়ন ডলার। বাজেট হলো ৭০-৮০ বিলিয়ন ডলার। এর বাইরে একটা বড় অর্থনীতি আছে। সেই সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনাকে আমরা যদি ভালো করতে পারি, বিনিয়োগ চাঙ্গা করতে পারি, ভালো পরিবেশ তৈরি করতে পারি, প্রতিষ্ঠানিক সক্ষমতা তৈরি করতে পারি তাহলে বৈষম্য কমানো সম্ভব। বৈষম্য কমানোর হাতিয়ার বাজেটই একমাত্র না। এটার সঙ্গে আরও অনেক কিছু জড়িত।