শরীর ও মন
রোগের নাম ‘বডি শেমিং’
অধ্যাপক ডা. আবদুল হাই
৭ আগস্ট ২০২৩, সোমবারআমার গ্রামে আব্দুস সামাদ নামে তিন জন ব্যক্তি ছিলেন। গ্রামবাসী নিজেদের সুবিধার্থে তিন জনের নামের কিছুটা পরিবর্তন করে ফেলেছিলেন। আব্দুস সামাদ নাম্বার ওয়ান ছিলেন একটু রোগা মানুষ। উনার পরিবর্তিত নামকরণ হলো ‘হুটকি (শুঁটকি) সামাদ’। আব্দুস সামাদ নাম্বার টু ছিলেন গা গতরে একটু মোটা। তিনি নাম পেলেন ‘আত্তি (হাতি) সামাদ’। আব্দুস সামাদ নাম্বার থ্রি শারীরিক গঠনে মানানসই থাকলেও তার ত্বকে একটু সমস্যা ছিল, হাত-পায়ের ত্বক শুষ্ক হয়ে ফেটে যেতো। তার পরিবর্তিত নাম হলো ‘ফাটা সামাদ’। এ ধরনের নামকরণের সঙ্গে সহজ সরল গ্রামবাসীর ঠাট্টা-মশকরা ও বিনোদনের সম্পর্ক ছিল। এ ধরনের নামকরণের ফলে আব্দুস সামাদদের মানসিক কোনো কষ্ট বা বিকারকে কেউই আমলে নিতেন না।
দেশের বাইরেও যে এ ধরনের ঠাট্টা-মশকরা নাই তা বলা যাবে না। অনেক দেশের সংস্কৃতিতেও এ বিকারগুলো ঢুকে গেছে। আমার খুবই ঘনিষ্ঠ একজন গ্রিক বন্ধু আছেন। কিংস কলেজ লন্ডনে তিনি আমার সহপাঠী ছিলেন। তার বিশাল একটি লম্বা নাম ছিল- ডেভিড কাউরোইওতুওটি। নামের অর্থ জিজ্ঞেস করায় সে জবাব দিলো, নামের শেষটুকু একটা বংশীয় টাইটেল, যার সহজ অর্থ- বেকাতেড়া কান।
বছর দুয়েক আগে হলিউডে অস্কার নাইট অনুষ্ঠানে মাথায় টাক পড়ে যাওয়া স্ত্রীকে নিয়ে মশকরা করায়
সঞ্চালককে সপাটে থাপ্পড় মেরেছেন হলিউড অভিনেতা উইল স্মিথ (ডরষষ ঝসরঃয)। অস্কার মঞ্চে সাড়া জাগানো এ ঘটনার পর বডি শেমিং (ইড়ফু ঝযধসরহম) নিয়ে চারদিকে হইচই শুরু হয়েছিল।
বডি শেমিং কি?
সোজা বাংলায় ‘বডি শেমিং’য়ের অর্থ, কারও শারীরিক ত্রুটি নিয়ে হাসি-মশকরা। মনোবিদরা বলছেন, স্কুল জীবন থেকেই অনেককে ‘বডি শেমিং’য়ের শিকার হতে হয়। মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের ব্যাখ্যায়, ক্রমাগত কারও শারীরিক ত্রুটি নিয়ে বিদ্রুপ মারাত্মক। গভীর ডিপ্রেশনে (Depression) চলে যান সেই ব্যক্তি। আত্মবিশ্বাস কমতে কমতে তলানিতে ঠেকে। তখন চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া ছাড়া উপায় নেই।
গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতি বছর সরকারি মেডিকেল কলেজে সাইকিয়াট্রিক বিভাগে অগুনতি রোগী আসেন বডি শেমিংয়ের শিকার হয়ে।
আন্তর্জাতিক ল্যানসেট (Lancet) ম্যাগাজিনের সমীক্ষা বলছে, বিশ্বে প্রতি ১০ জন আত্মহত্যাকারী মহিলার মধ্যে ৪ জনই এই উপমহাদেশের। এই আত্মহত্যার নেপথ্যে অন্যতম যে পাঁচটি কারণ তার মধ্যে দু’নম্বরে বডি শেমিং। শারীরিকভাবে বিদ্রুপ করার ফলে অনেকেই আত্মহত্যাকে বেছে নেন। নানা শারীরিক ত্রুটির কারণে মানুষ বডি শেমিং-এর শিকার হচ্ছে, কারও গায়ের রং কালো, কারও মাথায় চুল কম, কিংবা কান দুটো বড়, কেউ হয়তো একেবারে রোগা।
এমন মানুষদের অনেকেই ‘ডিসমরফিক ডিসঅর্ডারে’ আক্রান্ত। এই অসুখের উপসর্গ কী? কেউ দিনের সিংহভাগ সময় আয়নার সামনে কাটান। বারবার দেখেন তার চেহারাটা পাঁচ জনের সামনে কেমন লাগছে। লজ্জায় অনেকে সামাজিক মেলামেশা এড়িয়ে যান। নিজেকে লুকিয়ে রাখেন।
ত্বক রোগ বিশেষজ্ঞদের চেম্বারেও এ ধরনের রোগীদের ভিড়-ভাট্টা কম নয়। মুখ, নাক, চোখ ও যৌনাঙ্গের সামান্য সমস্যাই তাদের কাছে বিরাট উদ্বিগ্নতার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। মুখের ব্রণের মতো কোনো রোগও অনেকের ক্ষেত্রে মেজর ডিপ্রেশনের কারণ হয়।
মনে রাখতে হবে, ডিসমরফিক ডিসঅর্ডারে যারা আক্রান্ত, তাদের বিদ্রƒপ করা হলে ফল হতে পারে মারাত্মক। গভীর ডিপ্রেশনে (Depression) চলে যান মানুষটি। আত্মহত্যা তো অহরহই করছে।
‘বডি শেমিং’ নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ সমীক্ষা রয়েছে লন্ডনের মেন্টাল হেলথ ফাউন্ডেশনের। তাতে চোখ বোলালেই টের পাওয়া যায় পরিস্থিতি কতোটা ভয়ঙ্কর। সে দেশে সাড়ে চার হাজার মানুষের ওপর সমীক্ষা চালিয়ে দেখা যায়, প্রতি তিন জনে একজন শারীরিক ত্রুটি নিয়ে চিন্তাগ্রস্ত। এদের আট জনের মধ্যে একজন এই কারণে আত্মহত্যাও করতে চায়।
মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি হলো অন্যের দোষ-ত্রুটি নিয়ে হাসি তামাশা করা। এটা সুপ্রবৃত্তি নয়, বরং কুপ্রবৃত্তি। জীবনকে সুন্দর করে সাজিয়ে তোলার জন্য ও সুন্দর রাখার জন্য কিছু প্রবৃত্তিকে দমন করতে হয়। বডি শেমিং মানুষের এক ধরনের অসচেতনতা ও কুশিক্ষার ফল।
এ রোগ মূলত একটি সামাজিক ব্যাধি। চিকিৎসা শুরু হওয়া উচিত পরিবার থেকেই। মনোবিদদের কথায়, বহিরঙ্গ দিয়ে মানুষকে বিচার করা অনুচিত। অভিভাবকদের উচিত ছোট থেকেই সন্তানকে এ বিষয়ে শেখানো ও সচেতন করে তোলা। স্কুল কলেজ ও গণমাধ্যমে এ বিষয়ে প্রচার-প্রচারণা করা উচিত। ওষুধ নয়, সমাজের মানবিক মূল্যবোধ সম্পন্ন মানুষই শুধু প্রতিকার করতে পারে কষ্টকর এ রোগটি।
লেখক: (চর্ম, যৌন ও এলার্জি রোগ বিশেষজ্ঞ) জালালাবাদ রাগীব-রাবেয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল।
চেম্বার: ১২, স্টেডিয়াম মার্কেট, সিলেট।
ফোন: ০১৭১২-২৯১৮৮৭