ঢাকা, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, বুধবার, ১১ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

মত-মতান্তর

সীতাকুণ্ড বিএম ডিপো এবং হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড কেমিক্যাল

গাজী মিজানুর রহমান

(১ বছর আগে) ৮ জুন ২০২২, বুধবার, ১১:২৮ পূর্বাহ্ন

সর্বশেষ আপডেট: ১০:৩৭ পূর্বাহ্ন

mzamin

মানব জীবনে আগুনও দরকার, পানিও দরকার। পাথরে পাথরে ঘঁষা দিলে আগুন তৈরি হয়, তা আদিম মানুষের আবিষ্কার। সেই থেকে সভ্যতার উন্মেষ।  গ্রীক কিংবদন্তীতে আছে যে, মানুষের আগুনহীন জীবন দেখে প্রমিথিয়াস নামের এক মানব-দরদী দেবতার  প্রচন্ড মায়া হয়েছিল।  তিনি   দেবতাদের নিজস্ব এলাকা থেকে আগুন চুরি করে মানুষকে দিয়েছিলেন। গ্রীক সাহিত্যে  তাকে মানুষের বড় বন্ধু হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া  হয়েছে। তবে এর  জন্য প্রমিথিয়াসকে  সীমাহীন শাস্তি ভোগ করতে  হয়েছিল, কারণ তখন আগুন ছিল কেবল অলিম্পাস পর্বতের দেবতাদের জন্য সীমাবদ্ধ। কিন্তু মানুষ আগুনের সঠিক  রক্ষণাবেক্ষণ কি নিশ্চিত করতে পেরেছে ? 

আগুন তো  মানুষের কাছে  সমীহ চায়। তাকে  সমীহ দেখানো  মানে, প্রয়োজনের সময় অতি সাবধানে ব্যবহার এবং প্রয়োজনের সময় পেরোলে  সঠিকভাবে সংরক্ষণ। এভাবে  আগুনের সঠিক মর্যাদা মানুষ দেয় না বলে আগুন  ক্ষুব্ধ হয়ে মাঝে মাঝে সব  গ্রাস করে ফেলে।

বিজ্ঞাপন
অবহেলা করলেই প্রতিশোধ নেয়। ২০২১ সালের ডিসেম্বর মাসের  ২৪ তারিখে  ঢাকা থেকে ছেড়ে যাওয়া  বরগুনাগামী এমভি অভিযান-১০ সুগন্ধা নদীতে  পৌঁছালে আগুনে  লঞ্চটির সবকিছু পুড়ে গিয়েছিল। মৃত্যু হয়েছিল  ৪০  জন মানুষের। সেসময় জানা গিয়েছিল যে ইঞ্জিন রুমের কাছে রাখা কয়েক হাজার লিটার তেল থেকে আগুন ছড়িয়ে পড়তে সহায়ক হয়েছিল। একই বছর জুলাই মাসের ৯ তারিখে রূপগঞ্জের একটা খাদ্য ও পানীয় কারখানায় আগুনের ছোবলে  ৫২   জন মানুষের মৃত্যু হয়।  কারখানার উপমহাব্যবস্থাপক তখন সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘‘গ্যাস লাইন লিকেজ কিংবা বিদ্যুতের শর্টসার্কিট থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়ে থাকতে পারে।’’ ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি ঢাকার চকবাজার এলাকায় আগুনকে হেলাফেলা  করায় ৭৮ জন মানুষ  দগ্ধ হয়ে মারা  গিয়েছিল। জানা গিয়েছিল যে একটি ভবনের সুগন্ধী কারখানায় থাকা তরল দাহ্য পদার্থের কারণে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। প্রতিটি ঘটনায় দাহ্য পদার্থের সঠিক সংরক্ষণের অভাব পরিলক্ষিত হয়েছে। 

বিগত ৩-৭-২০২২ তারিখে শনিবার রাত নয়টায় সীতাকুণ্ড এলাকার বি এম ডিপোতে আগুন লাগে  এবং সেখানে রক্ষিত কন্টেইনার  বিস্ফোরণে  ৪৯ জন মানুষের প্রাণহানি হয়। আরও  অনেকে হাসপাতালে সংকটাপন্ন অবস্থায় আছে। এখানেও  অবহেলার ছাপ বিদ্যমান। হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড নামের রাসায়নিক পদার্থ ছিল এই বিশালায়তন গুদামে  রক্ষিত কন্টেইনারে। দাহ্য পদার্থ  সম্বলিত কন্টেইনার ব্লাস্ট হয়ে ভয়ংকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। আগুন নেভানোর সময়  ৯  জন দমকল-কর্মী নিহত হওয়ায় ভিন্ন এক বাস্তবতার  সৃষ্টি হয়। 

হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড ব্যবহৃত হয় টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রিতে। আমাদের বৈদেশিক অর্থ উপার্জনের বড় দুইটি খাত হচ্ছে শ্রমিকদের পাঠানো টাকা এবং রফতানি আয়। ২০২০-২১ সালে ৩৬৮ বিলিয়ন জিডিপি এর ৪৬ বিলিয়ন অবদান ছিল  রফতানি বাণিজ্যের।  এর  ৮০ ভাগ আসে টেক্সটাইল সেক্টর থেকে।  এই ইন্ডাস্ট্রিতে কাপড়ের রঙ উজ্জ্বল ও পাকাপোক্ত করার জন্য ব্লিচিং নামের একটি পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়। এ কাজে হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড  ব্যবহৃত হয়। ইদানীং দেশের মধ্যে  হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড   উৎপাদিত হচ্ছে। দেশের চাহিদা পূরণের সাথে সাথে এই রাসায়নিক পদার্থ বিদেশে রফতানি করা হয় এবং বৈদেশিক মুদ্রা আসে। বি এম ডিপোতে রক্ষিত হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড  রফতানির জন্য অপেক্ষমান ছিল।

আগুন লাগার পর পানি দিলে হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড   কয়েকগুন বেশি তীব্রতা নিয়ে দাহ্যবস্তুর দিকে ছুটে যায়। এটা ওর সৃষ্টিগত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। যারা আগুন নেভাবেন তারা  এই আগুনকে পানি নয়,অন্য কৌশলে নিয়ন্ত্রণ করেন। সাধারণত এই আগুন নেভাতে শুকনো পাউডার এর  ধুম্র স্প্রে করা হয়। কিন্তু ফায়ার ফাইটারদের তো জানতে হবে যে, অকুস্থলে  কি আছে বা ছিল। যখন কোথাও আগুন লাগে তখন সেখানকার মানুষ খুঁজে পাওয়া যায় না, পাওয়া গেলে তাদের মাথা ঠিক থাকে না। তাই দর্শনযোগ্য স্থানে সতর্কবার্তা রাখা হয়। এখানে কি  লেখা ছিল যে, মারাত্মক দাহ্য পদার্থ এই এই স্থানে আছে ? কিংবা হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড রাখা  স্থানগুলো  কি গুদামের অন্য  এলাকা থেকে আলাদা করা ছিল ? শুনেছি তদন্ত কমিটি হয়েছে। তাদের কাছ থেকে জানা যাবে  আসল  ঘটনা। জানতে পারার পর  প্রশাসনকে  ৪৯ জন মানুষের মৃত্যু  ও হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদের ক্ষতি করার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের উপর শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। তা না হলে প্রমিথিয়াস কাহিনী মানুষের জন্য অভিশাপ বয়ে আনতে থাকবে। 

গাজী মিজানুর রহমান: লেখক  এবং  সাবেক সিভিল প্রশাসন কর্মকর্তা

মত-মতান্তর থেকে আরও পড়ুন

   

মত-মতান্তর সর্বাধিক পঠিত

নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী সবদলই সরকার সমর্থিত / ভোটের মাঠে নেই সরকারি দলের প্রতিদ্বন্দ্বী কোনো বিরোধীদল

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status