ঢাকা, ৯ মে ২০২৫, শুক্রবার, ২৬ বৈশাখ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, ১০ জিলক্বদ ১৪৪৬ হিঃ

শেষের পাতা

ডেঙ্গু আগ্রাসী, ছয় মাসে আক্রান্ত সাড়ে ৮ হাজারের বেশি

ফরিদ উদ্দিন আহমেদ
৩ জুলাই ২০২৩, সোমবার
mzamin

রাজধানীসহ সারা দেশে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। চলতি বছরে ইতিমধ্যেই দেশের ৫৪ জেলায় ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে। গত ছয় মাসেই দেশে সাড়ে ৮ হাজারের বেশি রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এই সময়ে প্রাণহানি হয়েছে অর্ধশতাধিক।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেঙ্গু আক্রান্তের প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি হবে। কারণ অনেক ডেঙ্গু রোগী আছেন যারা হাসপাতালে ভর্তি হন না। তাদের হিসাব স্বাস্থ্য বিভাগের কাছে নেই। তারা বলছেন, ডেঙ্গু রোগী এই মাসেই আরও দ্রুত বাড়বে। এখনই কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে জুলাই থেকে পরবর্তী তিন মাসে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে।

কীটতত্ত্ববিদ ও গবেষক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার এ ব্যাপারে মানবজমিনকে বলেন, বছরের শুরু থেকেই ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বেশি। এবছর ৬৪ জেলায় ডেঙ্গু রোগী ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই ডেঙ্গু রোগী আরও বাড়বে। কারণ হিসেবে তিনি বললেন, ছুটি থাকার কারণে সব কিছু বন্ধ ছিল। এতে মশার বিস্তার বেশি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তাতে আমাদের ঝুঁকিও বেড়ে যাবে। তিনি বলেন, ঘরে ফিরে অবশ্যই পরিষ্কার-পরিছন্ন কার্যক্রম চালাতে হবে। সংশ্লিষ্টদের মশা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম জোরদার করতে হবে। কারও জ¦র হলে দ্রুতই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। 

তিনি বলেন, গত পাঁচ বছরে ডেঙ্গু রোগীর পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এ বছরের জুন পর্যন্ত মোট রোগী গত পাঁচ বছরের হিসাব টপকে বেশ বিপজ্জনক মাত্রায় অবস্থান করছে। ভর্তি রোগীদের মধ্যে ঢাকার রোগী প্রায় ৮৮ শতাংশ এবং ঢাকার বাইরের ১২ শতাংশ। আমাদের গবেষণাগারে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা, বৃষ্টিপাত, তাপমাত্রা, আর্দ্রতা ও এডিস মশার ঘনত্বের তথ্য-উপাত্ত কম্পিউটারে মাল্টিভেরিয়েন্ট অ্যানালিসিস করে ফোরকাস্টিং মডেল তৈরি করে ডেঙ্গু পরিস্থিতির পূর্বাভাস দেয়ার চেষ্টা করা হয়। এর আগে আমরা যেসব পূর্বাভাস দিয়েছি তার প্রতিটি মিলে গেছে। আগামী মাসে ডেঙ্গু পরিস্থিতি খারাপ হতে পারে। বর্তমান সময়ের মডেল বলছে, ঈদ-পরবর্তী সময়ে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা হঠাৎ অনেক বেড়ে যাবে। 

এই বিশেষজ্ঞ বলেন, দেশের প্রতিটি জেলায় আমরা এর আগে এডিস মশার অস্তিত্ব পেয়েছি। বৃষ্টির কারণে বিভিন্ন জেলায়ও ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশার প্রজনন বাড়বে এবং ঘনত্ব বৃদ্ধি পাবে। ঢাকা থেকে ডেঙ্গু ভাইরাস বহনকারী এডিস মশার কামড় খেয়ে হয়তো অনেকেই তার নিজ জেলায় বেড়াতে গেছে। সেখানে গিয়ে তার জ্বর আসতে পারে। আবার কেউ কেউ হয়তো জ্বর নিয়েই প্রিয়জনের সঙ্গে ঈদ কাটাতে গেছে। ঢাকা থেকে সংক্রমণ নিয়ে ভ্রমণ করা মানুষের মাধ্যমে বিভিন্ন জেলায় ডেঙ্গুর সংক্রমণ ঘটবে। একজন গবেষক হিসেবে আমি বলতে পারি, আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসে বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি জেলায় ডেঙ্গু সংক্রমিত হবে। ঢাকার পর চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, গাজীপুর, চাঁদপুর, ফরিদপুর, যশোর, বরিশাল ও পটুয়াখালী জেলায় ডেঙ্গুর সংক্রমণ বেশি ঘটবে। এফডিএমএন বা রোহিঙ্গা ক্যাম্পে এডিস মশার ঘনত্ব বেশি থাকার কারণে সেখানে ডেঙ্গুর সংক্রমণ বাড়বে এবং সেখান থেকে কক্সবাজারে সংক্রমণ বৃদ্ধি পাবে। এই সময়ে ডেঙ্গুর সংক্রমণ ঠেকাতে বিজ্ঞানভিত্তিকভাবে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন। আর এই নিয়ন্ত্রণ প্রক্রিয়ায় সিটি করপোরেশন, পৌরসভা ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন অঙ্গ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জনসাধারণকেও সরাসরি সম্পৃক্ত হতে হবে। যেসব এলাকায় ডেঙ্গু শুরু হয়েছে এবং নিয়মিত রোগী পাওয়া যাচ্ছে, সেসব এলাকার রোগীর ঠিকানা সংগ্রহ করে সেখানে হটস্পট ম্যানেজমেন্ট করে উড়ন্ত মশাগুলো মেরে ফেলতে হবে। কারণ এখানকার উড়ন্ত মশাগুলো ভাইরাস বহন করেছে। এরা যতদিন বেঁচে থাকবে, ততদিন জ্যামিতিক হারে ডেঙ্গু ছড়াতে থাকবে। হটস্পট এলাকায় জনসচেতনতা ও জনগণকে সম্পৃক্ত করার জন্য বিভিন্ন ধরনের কার্যক্রম হাতে নিতে হবে। এলাকায় মাইকিং, পোস্টারিং ও লিফলেট বিতরণ করে জনগণকে ডেঙ্গু পরিস্থিতি সম্পর্কে জানাতে হবে এবং তাদের সম্পৃক্ত করতে হবে। এই কাজে সিটি করপোরেশনের পাশাপাশি সেবামূলক সামাজিক সংগঠনগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। 

চলতি বছরের ডেঙ্গুর সামগ্রিক চিত্র: দেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ছেই। ডেঙ্গু মৌসুম আসার আগেই এবছরে ইতিমধ্যে সর্বোচ্চ রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে ৫০৯ রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এ নিয়ে সারা দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৩৮৮ জনে। ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে আরও দু’জনের মৃত্যু হয়েছে। চলতি বছরে এ পর্যন্ত ডেঙ্গু জ্বরে মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫২ জনে। গতকাল সারা দেশের পরিস্থিতি নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের নিয়মিত ডেঙ্গু বিষয়ক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়েছে।  প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ৫০৯ জনের মধ্যে ঢাকার বাসিন্দা ২২৪ জন এবং ঢাকার বাইরে ২৮৫ জন। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, নতুন ৫০৯ জনসহ বর্তমানে দেশের বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে সর্বমোট ভর্তি থাকা ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৩৮৮ জনে। ঢাকার বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি আছেন ৯৬৬ জন এবং ঢাকার বাইরে ৪২২ জন। চলতি বছরের এ পর্যন্ত ৮ হাজার ৭৫৭ ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন ৭ হাজার ৩১৭ জন। অধিদপ্তরের তথ্য মতে, চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৫৬৬ জন এবং মারা গেছেন ৬ জন, ফেব্রুয়ারিতে আক্রান্ত ১৬৬ জন এবং মারা গেছেন ৩ জন, মার্চে ভর্তি রোগীর সংখ্যা ১১১ জন এবং এপ্রিলে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১৪৩ জন এবং মারা গেছেন ২ জন। মে মাসে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১ হাজার ৩৬ জন এবং মারা গেছেন ২ জন। জুন মাসে ৫ হাজার ৯৫৬ জন এবং মারা গেছেন ৩৪ জন।

এ বছর ডেঙ্গুর ধরন (ভ্যারিয়েন্ট) ডেন-২-এ বেশি মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে। সীমিতসংখ্যক নমুনা বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ৬২ শতাংশ রোগী ডেঙ্গুর ধরন ডেন-২-এ আক্রান্ত হয়েছেন। বাকি ৩৮ শতাংশ আক্রান্ত হয়েছেন অন্য ধরন ডেন-৩-এ। সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা  প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) ডেঙ্গুর ধরন সম্পর্কে এ তথ্য জানিয়েছে। রোগতত্ত্ববিদেরা জানিয়েছেন, ডেঙ্গুর চারটি ধরন: ডেন-১, ডেন-২, ডেন-৩ এবং ডেন-৪। ডেঙ্গুর একটি ধরনে আক্রান্ত হলে সেই নির্দিষ্ট ধরনের প্রতিরোধক্ষমতা শরীরে গড়ে ওঠে, পরবর্তী সময়ে সেই ধরনটিতে মানুষ আর আক্রান্ত হয় না। তবে অন্য ধরনে মানুষ আক্রান্ত হতে পারে। এভাবে মোট চারবার আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে। প্রথমবার আক্রান্ত হওয়ার চেয়ে দ্বিতীয়বার আক্রান্ত হলে রোগের তীব্রতা ও জটিলতা দুটিই বাড়ে। আইইডিসিআরের পরিচালক অধ্যাপক ডা. তাহমিনা শিরিন গণমাধ্যমকে বলেন, আইইডিসিআর ঢাকার একাধিক হাসপাতালে ভর্তি থাকা রোগীর নমুনা সংগ্রহ করেছে। গত  জুন মাসে এসব নমুনা বিশ্লেষণ করা হয়েছে। ৬২ শতাংশ নমুনায় ডেন-২ শনাক্ত হয়েছে। আর ৩৮ শতাংশ নমুনায় ডেন-৩ শনাক্ত হয়েছে। তাহমিনা বলেন, ২০২২ সালে নমুনা বিশ্লেষণে প্রাধান্য ছিল ডেন-৩-এর। ৯০ শতাংশ রোগী আক্রান্ত হয়েছিল ডেন-৩-এ। বাকি প্রায় ১০ শতাংশ ছিল ডেন-৪। সম্প্রতি ব্রিফিংয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা.  আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম বলেছিলেন, হাসপাতালে আসা রোগীদের মধ্যে ডেঙ্গুর ‘শক সিনড্রোম’ বেশি দেখা যাচ্ছে। শক সিনড্রোমের অর্থ ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর রক্তের অণুচক্রিকা দ্রুত কমে যায়। রোগীর পরিস্থিতি খারাপ হয়ে পড়ে, রোগী অনেক ক্ষেত্রে অজ্ঞান হয়ে যায়।

শেষের পাতা থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

শেষের পাতা সর্বাধিক পঠিত

   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2025
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status