ঢাকা, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, শুক্রবার, ৬ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

শেষের পাতা

মামলার চাপ কমানোর কৌশল খুঁজছে বিএনপি

নুরে আলম জিকু
১০ জুন ২০২৩, শনিবার
mzamin

সারা দেশে বিএনপি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে জমেছে মামলার পাহাড়। গ্রেপ্তার, জামিন ও আদালতে হাজিরা দিতে দিতে তারা গলদঘর্ম। এখানেই শেষ নয়। জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে বিএনপি নেতাকর্মীরা ফের মামলা আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন। 

অবশ্য মামলার এ চাপ মোকাবিলায় কৌশল খুঁজছে বিএনপি। ইতিমধ্যে উচ্চ পর্যায়ের একটি কমিটি করা হয়েছে বিএনপির পক্ষ থেকে। এ কমিটি সারাদেশের হওয়া এসব মামলার বাদী, অতিউৎসাহী পুলিশ কর্মকর্তাদের তালিকা করছে। ওদিকে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের দাবিতে অনড় বিএনপি। সরকারের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলনে মাঠে তারা। ইতিমধ্যে বেশ কয়েক জায়গায় গায়েবি, অজ্ঞাত ও পেন্ডিং মামলায় নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তারের ঘটনা ঘটেছে। সম্প্রতি মার্কিন ভিসা নীতির পর রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন হাওয়া বইছে।

বিজ্ঞাপন
কিন্তু মামলা আতঙ্ক পিছু ছাড়ছে না বিএনপির। 

এরই মধ্যে ওয়ান ইলেভেন থেকে শুরু হওয়া বিভিন্ন মামলায় সাজা হয়েছে বিএনপির শীর্ষ কয়েক নেতার। এতেই উদ্বিগ্ন দলটির নেতাকর্মীরা। বিএনপির অভিযোগ, সরকার ক্ষমতায় টিকে থাকতে বিএনপির নেতাকর্মীদের নামে নতুন নতুন মামলা দিচ্ছে। গায়েবি, অজ্ঞাত ও পেন্ডিং মামলা দেখিয়ে গ্রেপ্তার করছে। আদালত জামিন দিলেও পেন্ডিং কিংবা পুরাতন মামলা দেখিয়ে নীরব গ্রেপ্তার চালাচ্ছে সরকার। আবার কখনো কখনো আগে গ্রেপ্তার, পরে মামলা দেখানো হচ্ছে। গ্রেপ্তারকৃতদের সহসাই মিলছে না জামিন। উচ্চ আদালতের নির্দেশনা মানছে না আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এরই প্রেক্ষিতে বিএনপি উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠন করেছে। পাশাপাশি তাদের দলীয় আইনজীবীদের পরামর্শ নিচ্ছে। 

বিএনপি শীর্ষ নেতারা বলছেন, ১/১১ থেকে শুরু হওয়া এসব রাজনৈতিক মামলায় দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য, মধ্যসারি ও তৃণমূলের অসংখ্য গুরুত্বর্পূণ নেতাই আসামি। বিচারে অনেকের সাজাও হতে পারে। এসব নিয়ে দল সমর্থিত আইনজীবীদের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করছেন বিএনপির সিনিয়র নেতারা। করণীয় নির্ধারণে নেয়া হচ্ছে নানা পরিকল্পনা। 

বিএনপি’র দপ্তর বলছে, ২০০৯ সাল থেকে গত ২২শে আগস্ট পর্যন্ত সারা দেশে বিএনপি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে ১ লাখ ১১ হাজার ৫৬৭টি মামলায় ৩৯ লাখ ৮০ হাজার ৮২৬ জনকে আসামি করা হয়েছে। এর মধ্যে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা রয়েছে ২ হাজার ৮৩০টিরও বেশি। ঢাকাতেই ১ হাজার ৫০০ মামলা হয়েছে। এ সময়ের মধ্যে হত্যার শিকার হয়েছে ১ হাজার ৫৩৭ জন। চলতি বছরের গত ১৯শে মে বিএনপি’র কেন্দ্র ঘোষিত জনসমাবেশকে কেন্দ্র করে সারা দেশে মামলা হয়েছে ১৬১টি। এসব মামলায় ৬ই জুন পর্যন্ত গেপ্তার হয়েছে ৭২০ জনেরও বেশি নেতাকর্মী। আর মামলার আসামি হয়েছেন ৫৯০০ জন নেতাকর্মী।

চলতি মাসের প্রথম দিকে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, বিরোধী দলের সাড়ে ১৩শ’ মামলা নিয়ে সরকার মাঠে নেমেছে। আগামী নির্বাচনের আগে মামলাগুলো দ্রুত শেষ করে বিএনপি নেতাদের সাজা দিয়ে কারাগারে পাঠানোর অপকৌশল চালাচ্ছে। তালিকা ধরে বিভিন্ন জেলায় গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা দ্রুত শেষ করতে চাইছে সরকার। সরকার বিরোধী দল নির্মূলে পোড়ামাটি নীতি অবলম্বন করেছে। এরই মধ্যে ওয়ান ইলেভেনের মামলায় বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকুর ৯ বছরের কারাদণ্ড এবং চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আমান উল্লাহ আমানের ১৩ বছর এবং তার স্ত্রী সাবেরা আমানের ৩ বছরের সাজার রায় বহাল রেখেছেন হাইকোর্ট। 

বিএনপি’র অভিযোগ তাদের নেতাকর্মীর উপর হামলার ঘটনা ঘটলেও উল্টো তাদেরই আসামি করা হচ্ছে। গত এপ্রিলে তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানায় বিএনপি-জামায়াত নেতাকর্মীদের নামে করা ২টি বিস্ফোরক ও পুলিশের কাজে বাধা দেয়ার মামলায় দুই শতাধিক নেতাকর্মীকে আসামি করা হয়। আসামির তালিকায় মৃত, কারাবন্দি এবং প্রবাসীরাও রয়েছে। গত ২০শে মে রাজশাহী সমাবেশ থেকে প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে জেলা বিএনপির আহ্বায়ক আবু সাঈদ চাঁদের বক্তব্যকে কেন্দ্র করে একাধিক মামলা করা হয়েছে। সেসব মামলায় চাঁদ বর্তমানে কারাগারে রয়েছেন। 

অন্যদিকে ওই একই ঘটনাকে উল্লেখ করে ওইদিন জামালপুরে অনুষ্ঠিত সমাবেশে উপস্থিত নেতাকর্মীদের নামে মামলা করেছে আওয়ামী লীগ। সেখানে আবু সাঈদ চাঁদ ছাড়াও বিএনপির কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, সাংগঠনিক সম্পাদক সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স, সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক ওয়ারেস আলী মামুন, জলবায়ু পরিবর্তন-বিষয়ক সহ-সম্পাদক মোস্তাফিজুর রহমান বাবুল, জামালপুর জেলা বিএনপি’র সভাপতি ফরিদুল কবীর তালুকদার শামীম এবং জামায়াতের জেলা সেক্রেটারি হারুন অর রশিদকেও আসামি করা হয়েছে। গত এক মাসে সারা দেশে কয়েক শতাধিক মামলা হয়েছে। এসব মামলার বেশিরভাগই গায়েবি। 

এসব মামলায় প্রায় ৯ হাজার জনকে আসামি এবং  অজ্ঞাত আসামি করা হয়েছে কয়েক হাজার জনকে। গত ২ মাস ধরে গ্রেপ্তারকৃত দায়িত্বশীল নেতাদের কারগারে আটকে রাখা হয়েছে। কারান্তরীণ নেতাদের মধ্যে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপি’র সদস্য সচিব রফিকুল আলম মজনু, যুবদলের সাবেক সভাপতি সাইফুল আলম নীরব, বর্তমান সাধারণ সম্পাদক মোনায়েম মুন্না, সাবেক সহ-সভাপতি এস এম জাহাঙ্গীর, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবদলের আহ্বায়ক গোলাম মাওলা শাহীন, বিএনপি’র নির্বাহী কমিটির সদস্য শেখ রবিউল আলম, ঢাকা মহানগর উত্তর স্বেচ্ছাসেবক দলের সাধারণ সম্পাদক আজিজুর রহমান মোসাব্বিরসহ আরও অনেকে রয়েছেন। বিএনপি নেতাদের অভিযোগ, সরকার বিরোধী চলমান আন্দোলনে যারাই সক্রিয় ভূমিকা পালন করছেন তাদের টার্গেট করে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। তারা যেনো সহজভাবে জামিনে মুক্তিলাভ করতে না পারেন সেজন্য একের পর এক পেন্ডিং মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হচ্ছে।

বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা বলছেন, আদালত কারাগারে আটক নেতাকর্মীদের জামিন দিলেও অনেকেই বের হতে পারছেন না। জামিন নিয়ে কারাগার থেকে বের হলে পুরাতন মামলায় তাদের ফের আটক করে কারাগারে রাখা হচ্ছে। যুবদল নেতা মোনায়েম মুন্নাকে এক মামলা থেকে জামিন পেলে আরেক মামলায় আটক দেখানো হচ্ছে। গোলাম মাওলা শাহীনকে নতুন কোনো মামলায় আটক না করতে উচ্চ আদালতের নির্দেশনার পরও পুরাতন পেন্ডিং মামলায় আটক করা হচ্ছে। আজিজুর রহমান মোসাব্বির ৩ বারের বেশি জামিন পেলেও মুক্তি মিলছে না। কারা ফটক থেকে আটক করে পেন্ডিং মামলায় ফের কারাগারে নেয়া হচ্ছে। রফিকুল আলম মজনুকে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়া গ্রেপ্তার না করতে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা থাকলেও গোয়েন্দা পুলিশ পেন্ডিং মামলায় আটক করে কারাগারে পাঠিয়েছে। 

গোলাম মাওলা শাহীনের আইনজীবী জানান, গত ৯ই ফেব্রুয়ারি গোলাম মাওলা শাহীনকে একটি গায়েবি মামলায় আটক করে পুলিশ। ওই মামলায় তার জামিন হলে এরপর আরও ৪টি পেন্ডিং মামলায় তাকে আটক দেখানো হয়। গত ২৩শে মে উচ্চ আদালতের এক রিটে গোলাম মাওলা শাহীনকে সুনির্দিষ্ট মামলায় নাম না থাকলে এবং কোনো আদালতের ওয়ারেন্ট না থাকলে গ্রেপ্তার না করতে নির্দেশনা দেয়া হয়। কিন্তু ৩০শে মে নিম্ন আদালত তাকে রমনা ও শ্যামপুর থানার পুরাতন মামলায় গ্রেপ্তার দেখায়। যে মামলায় তার নাম ছিল না, ওয়ারেন্টও ছিল না। একইভাবে মোনায়েম মুন্নার ক্ষেত্রেও উচ্চ আদালতের নির্দেশনা অমান্য করে একের পর এক মামলা দিয়ে আটক রাখা হচ্ছে। 
ওদিকে গত একমাসে ৬ শতাধিক নেতাকর্মীর জামিন বাতিল করে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। হঠাৎ করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতায় মামলা দায়ের, গ্রেপ্তার ও জামিন নামঞ্জুর করে কারাগারে পাঠানোর ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় উদ্বিগ্ন বিএনপির হাইকমান্ডও। দলটির তৃণমূলের নেতাকর্মীদের মাঝেও আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। 

সূত্রমতে, দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ও পরে আন্দোলনে ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও হত্যাকাণ্ডের অভিযোগে রাজনৈতিক মামলার বিচার কার্যক্রম দ্রুতগতিতে চলছে। দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের আগে এমনকি আগামী কয়েক মাসের মধ্যে কয়েকটি মামলার রায় হতে পারে। আইনি জটিলতায় বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে পারেননি। আগামী নির্বাচনেও বিএনপি’র শীর্ষ এই দুই নেতার পাশাপাশি দলের অনেক সিনিয়র নেতা আইনি বাধার সম্মুখীন হতে পারেন। নেতারা বলছেন, বিএনপিকে বেকায়দায় ফেলতে কিংবা নির্বাচনের আগে আপস-রফা করার জন্য এসব মামলাকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে চাইছে সরকার। তাদের সাজানো নির্বাচনে অংশ না নিলে অনেক নেতাকেই কারাগারে যেতে হবে। 

বিএনপি’র সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আহমেদ বলেন, সরকার বিএনপিকে চাপে রাখতে গায়েবি ও পেন্ডিং মামলার ঝড় তুলেছে। ২০১৮ সালের ন্যায় সরকার পুরনো খেলা শুরু করেছে। নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছে ততই বিএনপি নেতাকর্মীদের নামে গায়েবি মামলার হিড়িক পড়েছে। বিনা পরোয়ানায় শত শত নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। কিন্তু এভাবে আর পার পাওয়া যাবে না। বিএনপি যখন নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার দাবিতে আন্দোলনে রয়েছে তখনই মামলার বিচার কার্যক্রমে গতি আনা হয়েছে। কার্যত, আন্দোলনকে বাধাগ্রস্ত করে বিএনপি নেতাদের ভয়ভীতি দেখাতেই এসব করা হচ্ছে। তবে সেই সুযোগ বেশিদিন পাবে না। এই সরকারের সময় শেষ। এবার বিদায় নেয়ার জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে। 
 

শেষের পাতা থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

   

শেষের পাতা সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status