ঢাকা, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, শুক্রবার, ৬ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

প্রথম পাতা

পমপম চক্রের কব্জায় ২০,০০০ তরুণীর নগ্ন ভিডিও

স্টাফ রিপোর্টার
২৩ মে ২০২৩, মঙ্গলবার
mzamin

পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) ভয়ঙ্কর এক সাইবার অপরাধী চক্রের সন্ধান পেয়েছে। চক্রের অধিকাংশ সদস্য প্রকৌশলী। দীর্ঘদিন ধরে তারা হাজার হাজার কিশোরী-তরুণীদের গোপন ভিডিও সংগ্রহ করে ব্ল্যাকমেইল করে আসছিল। তাদের কব্জায় প্রায় ২০ হাজার আপত্তিকর ভিডিও পাওয়া গেছে। এসব ভিডিও দিয়ে তৈরি করা ৩০ হাজার কন্টেন্টও রয়েছে। আপত্তিকর ভিডিও চক্রের সদস্যরা বিভিন্ন কৌশলে ও ভুক্তভোগীদের আইডি হ্যাক করে সংগ্রহ করে। পরে ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্ন পর্নোগ্রাফি সাইটে ছড়িয়ে ভাইরাল করার ভয় দেখিয়ে হাতিয়ে নিয়েছে কোটি কোটি টাকা। এছাড়া আপত্তিকর ভিডিও দেশে-বিদেশে বিক্রি করেও বড় অংকের টাকা আয় করেছে। তাদের ফাঁদে পড়ে হাজার হাজার তরুণীর রাতের ঘুম হারাম হয়েছিল। মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়েছিলেন তাদের অভিভাবকরা।

বিজ্ঞাপন
রাত-দিন কান্নাকাটি ও আকুতি-মিনতি করেও চক্রের সদস্যদের দিয়ে কন্টেন্ট সরাতে পারেনি তরুণীরা। উপায়ন্তর না পেয়ে বিভিন্ন তরুণী অভিযোগ নিয়ে আসেন সিআইডি’র সাইবার পুলিশের কাছে। অভিযোগের তদন্ত করে সত্যতা পায় সিআইডি। পরে আন্তর্জাতিক একটি টেলিগ্রাম চক্রের মূলহোতাসহ ৯ জনকে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও ঢাকা থেকে গ্রেপ্তার করে সিআইডি। 

গ্রেপ্তারকৃতরা হলো- চট্টগ্রামের শ্যামলী পলিটেকনিক ইন্সটিটিউটের ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী মো. আবু সায়েম ওরফে মার্ক সাকারবার্গ (২০), বেসরকারি চাকরিজীবী মো. মশিউর রহমান শুভ (২৬), সিলেট পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থী মো. সাহেদ খান (২২), নর্থসাউথ বিশ^বিদ্যালয়ের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থী কেতন চাকমা (২০), ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগের শিক্ষার্থী মো. নাজমুল হাসান সম্রাট (২২), তেজগাঁও কলেজের ফাইন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী মো. মারুফ হোসেন (৩৪), চট্টগ্রাম সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী জুনাইদ বোগদাদী শাকিল (২০), বেসরকারি চাকরিজীবী মো. জসিম উদ্দিন (৩৮) ও শাহরিয়ার আফসান অভ্র (২৪)। 

গতকাল মালিবাগের নিজ কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে সিআইডি প্রধান ও অতিরিক্ত আইজিপি মোহাম্মদ আলী মিয়া বলেন, ভুক্তভোগীরা আমাদের কাছে অভিযোগ করেন, তাদের ফেসবুক, ইন্সটাগ্রাম আইডি হ্যাক করে পমপম নামের একটি টেলিগ্রাম গ্রুপ গোপন ছবি ও ভিডিও হাতিয়ে নিয়ে ব্ল্যাকমেইল করে মোটা অংকের টাকা দাবি করছে। টাকা দিতে না পারলে ভিডিও কলে এসে আপত্তিকর কর্মকাণ্ড করতে বাধ্য করছে। আর কোনো প্রস্তাবেই সাড়া না দিলে নাম-পরিচয় আর ব্যক্তিগত তথ্যসহ লাখ লাখ সাবস্ক্রাইবারের টেলিগ্রাম গ্রুপগুলোতে ভাইরাল করে দিচ্ছে। এই অভিযোগের ভিত্তিতে সিআইডি’র সাইবার পুলিশের একটি দল কাজ শুরু করে। আমরা দেখতে পাই, গ্রুপটি আপত্তিকর ভিডিও ভাইরাল করে দেয়ার ভয় দেখিয়ে ভিকটিমের কাছ থেকে যে কেবল টাকা আয় করে তা নয়, চক্রটি ওইসব ভিডিও দেশে-বিদেশে বিক্রি করেও কোটি টাকা আয় করেছে। মাসে এক থেকে দুই হাজার টাকা সাবস্ক্রিপশন ফি দিয়ে মধ্যপ্রাচ্য, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, পর্তুগাল, কানাডা, আমেরিকা এবং ইংল্যান্ডের মতো দেশের অসংখ্য ক্রেতা গ্রুপটির সদস্য হয়েছেন। তারা অল্পবয়সী মেয়েদের আপত্তিকর ওইসব কন্টেন্ট ক্রয় এবং সংরক্ষণ করে থাকেন।

তিনি বলেন, চক্রটির নেতৃত্ব দেয় মার্ক-সাকারবার্গ নামের এক ব্যক্তি। তার আসল নাম আবু সায়েম। বেকার সায়েম থাকে চট্টগ্রামে। তার বিভিন্ন একাউন্টে কোটি কোটি টাকা লেনদেনের তথ্য পাওয়া যায়। পরে আরাফাত নামের এক ভুক্তভোগী ও তার প্রেমিকার অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ছবি পমপম গ্রুপে ছড়িয়ে দেওয়ায় ডিএমপি’র তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানায় মার্ক-সাকারবার্গ চক্রের বিরুদ্ধে পর্নোগ্রাফি এবং ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনে একটি মামলা দায়ের করেন। পরে সিআইডি’র একটি টিম চট্টগ্রামের লালখান বাজার এলাকায় অভিযান চালিয়ে মার্ক ওরফে সায়েমকে গ্রেপ্তার করে। মার্কের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, তার ঘনিষ্ঠ দুই বন্ধু শাহরিয়ার আফসান অভ্রকে চট্টগ্রামের হাউজিং এলাকা থেকে এবং বোগদাদী শাকিলকে উখিয়া থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। 
সিআইডি জানায়, মার্ক ওরফে সায়েমের মোবাইল ফোন তল্লাশি করে মার্ক-সাকারবার্গ আইডিটি লগইন করা অবস্থায় পাওয়া যায় এবং নিশ্চিত হওয়া যায় যে, আবু সায়েমই মার্ক সাকারবার্গ। তাকে জিজ্ঞাসাবাদে পমপম গ্রুপের যতগুলো চ্যানেল এবং গ্রুপ আছে তার এডমিনদের আসল নাম-পরিচয় পাওয়া যায়। এডমিনদের কাজ ছিল সায়েমের হয়ে নতুন নতুন কন্টেন্ট যোগাড় করা। নতুন কন্টেন্ট পেতে তারা ফেইক এনআইডি বানিয়ে ভুক্তভোগী তরুণীদের সাবেক প্রেমিকেরাই নতুন নতুন কন্টেন্ট দিচ্ছে। 

সম্পর্ক চলাকালীন প্রেমিকার যেসব অন্তরঙ্গ মুহূর্ত প্রেমিকরা ক্যামেরাবন্দি করেছে, প্রতিশোধের নেশায় সেগুলো তুলে দেয় চক্রের কাছে। সায়েম তার এডমিনদের দিয়ে সেগুলোতে মিউজিক বসিয়ে, ফেসবুক আইডি থেকে ছবি নিয়ে ৩০-৪০ সেকেন্ডের প্রমো বানিয়ে আপলোড করে তার গ্রুপগুলোতে। প্রমো দেখে যারা ফুল-ভার্সন দেখতে চায়, তাদের ১ থেকে ২ হাজার টাকার পুরোটা কিনতে হয়।  

সংবাদ সম্মেলনে সিআইডি প্রধান বলেন, সায়েম, অভ্র এবং শাকিলকে জিজ্ঞাসাবাদ এবং তাদের ডিভাইস তল্লাশি করে সায়েমের বিভিন্ন পেজের এডমিনদের আসল পরিচয় উদ্ধার করা হয়। তার সবচেয়ে বিশ্বস্ত এবং গুরুত্বপূর্ণ সহযোগী ডিটিআর শুভ ওরফে মশিউর রহমান। মশিউরের দায়িত্ব ছিল গ্রুপ থেকে কৌশলে কন্টেন্ট সেভ করে রাখা এবং নানা প্রলোভনে তরুণীদের অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ভিডিও হাতিয়ে নেয়া। মশিউর চট্টগ্রামের একটি ফিশিং কোম্পানিতে চাকরি করে। অবস্থান নিশ্চিত হয়ে তাকে কর্ণফুলী এলাকা থেকে তার সহযোগী জসীমসহ গ্রেপ্তার করা হয়। সায়েম এবং মশিউরকে জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায় এই এডাল্ট গ্রুপগুলোর এডমিনদের অনেকেই ঢাকায় অবস্থান করছে। ফলে তাদের বেইলী রোড এলাকার একটি রেস্টুরেন্টে গেটটুগেদারের ফাঁদ পাতা হয়। ফাঁদে পা দিয়ে একে একে গ্রেপ্তার হয় গুরুত্বপূর্ণ এডমিন ক্যাকটাস ওরফে কেতন চাকমা, এল ডোরাডো ওরফে শাহেদ, তূর্য ওরফে মারুফ এবং মিঞা ভাই ওরফে নাজমুল সম্রাটকে।  

সিআইডি আরও জানায়, সায়েম এবং তার সহযোগীদের গ্রুপ ও চ্যানেলগুলোয় সাবস্ক্রাইবের সংখ্যা প্রায় সোয়া চারলাখ। আর সেগুলোতে ২০ হাজার আপত্তিকর ভিডিও এবং প্রায় ৩০ হাজার কন্টেন্ট রয়েছে। মাসিক ফি দিয়ে তাদের প্রিমিয়াম গ্রুপের সদস্য হয়েছেন দেশ-বিদেশের ৭৫০ জন ব্যক্তি। তাদের সম্পর্কে তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বিস্তারিত তথ্য পেয়েছেন। তরুণীদের আপত্তিকর কন্টেন্ট কেনা-বেচার সঙ্গে জড়িত সবাইকে আইনের আওতায় আনা হবে।

সিআইডি প্রধান মোহাম্মদ আলী মিয়া বলেন, এই কাজটি ছিল ভীষণ স্পর্শকাতর একটি কাজ। ফলে তদন্ত চলাকালে ভুক্তভোগী কিশোরী মেয়েদের কান্না, তাদের আপত্তিকর ভিডিও গ্রুপগুলো থেকে সরিয়ে নিতে এডমিনদের প্রতি করুণ আকুতি, আমাদের হৃদয় ছুঁয়ে গেছে। আমরা জেনেছি ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পর অনেকে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছে। বোনের ভিডিও সরিয়ে নিতে ভাইয়ের কান্নাও আমাদের চোখে পড়েছে। ভুক্তভোগী কিশোরীদের অনেকেই এই অসহায়ত্বের কথা কাউকেই বলতে না পেরে ক্রমেই মানসিক অবসাদে আক্রান্ত হয়েছে। এই চক্রে যারা জড়িত তারা সমাজের জঘন্য এবং ঘৃণিত মানুষ। তাদের কঠোর শাস্তির ব্যবস্থার কোনো বিকল্প নেই। ফলে আমরা এ ঘটনায় মানিলন্ডারিং তদন্ত করারও পরিকল্পনা করেছি। তাহলে কেবল টেলিগ্রাম চক্রের হোতারাই নয়, তাদের দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে থাকা সহযোগীদেরও আইনের আওতায় আনা যাবে।

প্রথম পাতা থেকে আরও পড়ুন

   

প্রথম পাতা সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status