খেলা
কলকাতা মোহামেডানের স্বর্ণযুগের অধিনায়ক হবীবুল্লাহ বাহারের গল্প
ইকবাল বাহার চৌধুরী
১৭ মার্চ ২০২৩, শুক্রবার
বিশিষ্ট সাহিত্যিক, সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ ও ফুটবল খেলোয়াড় মুহাম্মদ হবীবুল্লাহ বাহার চৌধুরীর জন্ম ১৯০৬ সালে ফেনীর পরশুরামের গুথুমা গ্রামে। মাত্র ২/৩ বছর বয়সে তাঁর পিতা মুহাম্মদ নূরুল্লা চৌধুরী ইন্তেকাল করেন। ফলে শিশুপুত্র হবীবুল্লাহ বাহার ও একমাত্র ছোট বোন শামসুন নাহারকে নিয়ে তাঁদের মা আসিয়া খাতুন চৌধুরী গুথুমা গ্রাম থেকে তাঁর পিতা বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ খান বাহাদুর আবদুল আজিজের চট্টগ্রামের বাড়িতে যান ও সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। হবীবুল্লাহ বাহার চট্টগ্রামে মিউনিসিপ্যাল স্কুল আর চট্টগ্রাম কলেজে পড়াশোনা করেন। সেই বৃটিশ শাসনামলে স্কুল- কলেজেই তাঁর খেলাধুলা এবং সাহিত্য-সংস্কৃতির চর্চার সূচনা। স্কুলে তিনি ছিলেন ফুটবল টিমের ক্যাপ্টেন। হবীবুল্লাহ বাহার চৌধুরীর আমন্ত্রণে কাজী নজরুল ইসলাম চট্টগ্রামে যান দু’বার- ১৯২৬ ও ১৯২৯ সালে। তাঁদের বাড়িতে বসে বহু বিখ্যাত কবিতা লিখেছেন নজরুল সেই সময়। প্রবেশিকা পরীক্ষা পাস করার পর তিনি চট্টগ্রাম কলেজে ভর্তি হন এবং সেই সময় তাঁর ফুটবল খেলার পূর্ণ বিকাশ ঘটে। তিনি ছিলেন কলেজ ফুটবল টিমের অধিনায়ক। তিনি যখন চট্টগ্রাম কলেজ টিমে খেলেন তখন অন্য কোনো টিম চট্টগ্রামের লীগ চ্যাম্পিয়ন হয়নি বা অন্য কোনো শিল্ড কিংবা কাপ পায়নি। চট্টগ্রাম কলেজ দল প্রতিটি প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়েছে। পরবর্তীকালের কলকাতা ইস্ট বেঙ্গল ক্লাবের কর্ণধার দুলাল তখন বাহার সাহেবের সহপাঠী ছিলেন। চট্টগ্রামে তখন প্রবাদ ছিল- ‘দুলালের শট, বাহারের হেড আর অমনি গোল।’ আইএসসি পাস করার পর তিনি কিছু সময় কলকাতা মেডিকেল কলেজে অধ্যয়ন এবং বিখ্যাত ইস্ট বেঙ্গল টিমে খেলা শুরু করেন তাঁর সহপাঠী ও ঘনিষ্ঠ বন্ধু দুলালসহ। সেই সময় মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের দুর্দিন। জনসমর্থনবিহীন দলটি কোনো রকমে টিকে আছে দ্বিতীয় বিভাগে। শিক্ষিত খেলোয়াড় ছিল না। পরিচালকমণ্ডলীদের মধ্যে তেমন যোগ্য কেউ ছিল না। এ সময় দলের সেক্রেটারি ছিলেন কে. আজিজ। তিনি উপলব্ধি করেন দলে যদি ভালো খেলোয়াড় না থাকে তবে এই ক্লাব কিছুতেই প্রথম বিভাগে উঠতে পারবে না আর জনসমর্থনও পাবে না। সবকিছু ভেবে তিনি বাহার সাহেবকে বিশেষভাবে অনুরোধ জানান মোহামেডান স্পোর্টিংয়ে খেলার জন্য। বাহার সাহেব মেডিকেল কলেজ ছেড়ে তখন ইসলামিয়া কলেজে পড়েন আর খেলেন কলেজ টিমে ও ইস্ট বেঙ্গল টিমে। ইস্ট বেঙ্গল তখন প্রথম বিভাগের শীর্ষস্থানীয় ক্লাবগুলোর একটি। প্রথম বিভাগ ছেড়ে দ্বিতীয় বিভাগে আসতে তিনি ইতস্ততবোধ করছিলেন। তবে পরে মুসলিমদের সমর্থনপুষ্ট দলটিকে দাঁড় করানোর কথা ভেবে মোহামেডান স্পোর্টিংয়ে যোগদান করেন ১৯৩০ অথবা ১৯৩১ সালের দিকে। হবীবুল্লাহ বাহারের অধিনায়কত্বে সেই যুগে যাঁরা মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবে খেলেছেন- তাঁদের মধ্যে ছিলেন আব্বাস মির্জা, হাফেজ রশীদ, কালু খান ও অন্যান্যরা। তিনি সবসময় দলের খেলোয়াড়দের মধ্যে কঠোর নিয়মানুবর্তিতা রক্ষার জন্য সচেষ্ট ছিলেন। তবু দলের সকলের কাছে তিনি ছিলেন সমাদৃত। এক পর্র্যায়ে তিনি ও ক্লাবের পরিচালকদের মধ্যে কেউ কেউ এ কথা উপলব্ধি করেছিলেন যে, কয়েকজন বুট পরিহিত খেলোয়াড় যদি আমদানি করা না হয়, লীগ খেলায় সফলতা অর্জন প্রায় অসম্ভব। এর ফলে টিমে কয়েকজন বুট পরিহিত খেলোয়াড় আমদানি করা হয়। এইসব খেলোয়াড় যোগদানের পর পরই বর্ষাকাল এসে পড়ে। ফলে খালি পায়ের কয়েকজন খেলোয়াড়কে বাদ দিতে হয়। অধিনায়ক হবীবুল্লাহ বাহার অবশ্য শুকনো আর ভিজা উভয় মাঠেই খেলতে সমান পারদর্শী ছিলেন। ফলে দলকে নিম্নভাবে পুনর্গঠন করা হয়- গোলরক্ষক: কালু খান (নাসিরাবাদ) বা আগা সিরাজি (স্থানীয়) ফুল ব্যাক: আবদুর রহমান (কোয়েটা) এবং গোলাম নবি (কোয়েটা) বা মিরজা জাফর (কোয়েটা) হাফ ব্যাক: সফি (স্থানীয়), শেখ ইব্রাহিম (কোয়েটা), হবীবুল্লাহ বাহার (স্থানীয়) অধিনায়ক পুরো ভাগ: রাইট আউট: আমির (ব্যাঙ্গালোর) রাইট ইন: ইমতিয়াজ (দিল্লি) সেন্টার ফরোয়ার্ড: ইয়াসিন (রাওয়ালপিন্ডি) লেফট ইন: হাফিজ রশীদ লেফট আউট: আব্বাস মির্জা (স্থানীয়) খেলার মৌসুমের শেষভাগে হাফিজ রশীদ আর ইয়াসিন মাঠে তাদের খেলার স্থান পরিবর্তন করেন। হাফিজ সেন্টার ফরোয়ার্ড হন- আর এই স্থানে খেলেই তিনি পরবর্তী বছরগুলোতে ফুটবল জগতে নিজের জন্য সৃষ্টি করেন এক গৌরবময় ইতিহাস। বেশ কয়েকটা খেলার পর হবীবুল্লাহ বাহার হাঁটুতে আঘাত পান। এরপর তিনি নিজেই খেলা থেকে অবসর নেন। দলের রিজার্ভ থেকে তিনি আমীর মির্জাকে নিজের স্থলাভিষিক্ত করেন। মোহামেডান স্পোর্টিং প্রথম বিভাগে উন্নীত না হওয়া পর্যন্ত এই দলই খেলতে থাকে। হবীবুল্লাহ বাহারের মধ্যে যে নতুনত্ব ছিল আর সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয় ছিল তা হলো তিনি বলে কিক মারার চেয়ে হেড করাতেই ছিলেন সম্পূর্ণ নির্ভুল ও নিশ্চিত। অনেক সময় কিক না মেরে বসে পড়েই হেড করতেন যেহেতু তাঁর নিশ্চিত ধারণা ছিল যে, ওখানে তাঁর ভুল করার কোনো সম্ভাবনা নেই। আবার কখনো দেখা যেত তিনি কোমর বরাবর বলকেও হাঁটুর সাহায্যে ভূমির প্রায় সমান্তরালে অতি বিচক্ষণ এবং নির্ভুলভাবে পাঠিয়ে দিতেন তাঁর দলের খেলোয়াড়দের কাছে। তাঁর এই নতুন কলাকৌশল বিপক্ষ খেলোয়াড়দের করে দিতো দিশাহারা। কেননা, খেলায় এমনি ধরনের কৌশল ছিল তাদের কল্পনারও অতীত। বাহার সাহেব স্থানীয় আর বহিরাগত দলের প্রত্যেকটি খেলোয়াড়ের কাছেই ছিলেন সমাদৃত। পরে ১৯৩৪ সালে দলের অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেন আব্বাস মির্জা। হবীবুল্লাহ বাহার মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের সঙ্গে ম্যানেজার হিসেবে বার্মা ও সিংহল সফর করেন। ১৯৩৬ সালের লীগ ও আই এফ এ (ও. ঋ. অ) শিল্ড বিজয়ী ফুটবল দলের সঙ্গে তৎকালীন অবিভক্ত বাংলার বিভিন্ন জেলা সফর করেন। কলকাতা মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের অধিনায়ক ও সংগঠক হিসেবে এই ক্লাবের ইতিহাসে যে ক’জন মুষ্টিমেয় ব্যক্তির নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে হবীবুল্লাহ বাহার চৌধুরী নিঃসন্দেহে তাঁদের মধ্যে অন্যতম। ১৯৪৭ সালে বৃটিশদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার পর তাঁর নেতৃত্বেই জন্মলাভ করে পূর্ব পাকিস্তান স্পোর্টস ফেডারেশন। এই ফেডারেশনের প্রথম প্রেসিডেন্ট হিসেবে তিনি পূর্ব পাকিস্তানের খেলাধুলার মান উন্নয়নে বিশেষ অবদান রেখেছিলেন। লেখক: হবীবুল্লাহ বাহার চৌধুরীর সন্তান- ভয়েস অব আমেরিকার বাংলা বিভাগের সাবেক প্রধান।