মত-মতান্তর
'রাষ্ট্র ভাষা' আন্দোলন 'জাতীয়তাবাদী চেতনার' উন্মেষ
গালিব ইমতিয়াজ নাহিদ
(৭ মাস আগে) ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, শনিবার, ১২:১০ পূর্বাহ্ন

দীর্ঘ ঔপনিবেশ শেষে ধর্মীয় খন্ডতার ভিত্তিতে র্যাডক্লিফের ভারতবর্ষ ভাগ মূলত ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের ভীত রচিত হয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীতে সময়ে পুরো পৃথিবীতেই জাতীয়তাবাদের বসন্ত শুরু হয়েছিল। জাতি সত্তার ভিত্তিতে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অনেক রাষ্ট্র গঠিত হয়।
একই ভৌগলিক সীমানায় বসবাসরত সমগ্র জনগণের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় মূল্যবােধের ওপর অন্যকোনাে ভৌগােলিক সীমানারেখায় অবস্থিত মানুষের আধিপত্যবাদী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে জনমতকে ঐক্যবদ্ধ করে সংগ্রাম পরিচালনা করার মানসিকতা হল জাতীয়তাবাদ। অর্থাৎ যখন কোন জনসমষ্টির মধ্যে ভাষাগত ঐক্য, সাংস্কৃতিক ঐক্য, জীবনধারণগত ঐক্য দেখা দেয় তখন তাদের মধ্যে জাতীয়তাবােধের সৃষ্টি হয়।
জাতীয়তাবাদ বিষয়টি এমন একটা অনুভূতি যেটা মানুষকে শেখাতে হয় না, যেটা মানুষ তার প্রয়োজনে পরিবার ও সমাজ থেকেই শিখে থাকে। এককথায় বলা যায়, একটা জাতির নিজস্ব যা কিছু সেটাই জাতীয়তাবাদের অংশ। ভাষা, ধর্ম, সংস্কৃতি, ভালোলাগা, মন্দ ললাগা সকল কিছুই জাতীয়তাবাদের অংশ। যুগে যুগে বলপ্রয়োগ, দমন-পীড়নের মাধ্যমে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর উপর চাপিয়ে দেওয়া তত্ত্ব থেকে মুক্তির চেষ্টা থেকে জাতীয়তাবাদের অনুভূতি বা প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়েছে। ১৯৫২সালের ভাষা আন্দোলন ঠিক তেমনই একটা অনুভূত অনুভূতি এবং সুপ্ত জাতীয়তাবাদের সফল বহিঃপ্রকাশ।
পোস্টকার্ড, এনভেলাপ, মানি অর্ডারের ফর্ম, মরেলটিকিট, সরকারি বিভিন্ন বিজ্ঞপ্তি এমনকি টাকায় শুধু উর্দু ও ইংরেজি ব্যবহার করতে হবে এমন সরকারি আদেশের বিরুদ্ধে প্রথম আন্দোলনের সূচনা করেন সচিবালয়ের কর্মচারীরা। তাদের আহুত পথসভায় একজন কর্মচারী তার বক্তব্যে বলেন, এনভেলাপাদিতে বাংলা থাকলেই চলবে না, বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করতে হবে। ১৯৪৭ সালের ১৩ই ডিসেম্বর সচিবালয়ের কর্মচারীরা সকাল-সন্ধ্যা হরতাল পালন করেন যেটা কিনা রাষ্ট্রভাষার দাবিতে বিশ্বের প্রথম হরতাল।
ধারাবাহিক আন্দোলন ও বীর শহীদদের আত্মত্যাগে কিংকর্তববিমূঢ় হয়ে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হন বাংলাভাষাকে। উন্মেষ ঘটে একটা নিষ্পেষিত জাতির বহুদিনের লালিত বাঙালি জাতীয়তাবাদের চেতনা।যদিও ধর্মকে প্রাধান্য দিয়ে একটি ভূখণ্ডের মানচিত্র রচিত তবু্ও জাতীয়তাবাদের প্রশ্নে কোন প্রকার ধর্মীয় বিভেদ তৈরি হয়নি রাষ্ট্রভাষার সংগ্রামের ক্ষেত্রে। সকল ধর্ম-বর্ণ-গোত্রের মানুষ সংগঠিত হয়েছিল জাতীয়তাবাদের চেতনায়। মাতৃভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পেতে ধর্মীয় কোন বিষয়ই প্রাধান্য পায়নি এই আন্দোলনে। সনাতন ধর্মালম্বী মানুষের সৃষ্ট সংস্কৃত ভাষা থেকে উৎপত্তি বাংলা ভাষার জন্য শহীদ হতে লেশমাত্র কার্পণ্যবোধ করেনি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ।
একজন শিশুর জন্মের পর থেকেই তার পরিবার ও পার্শ্ববর্তী সমাজ থেকে ভাষা ও ধর্মীয় শিক্ষা গ্রহণ করে থাকে সেটিই মূলত জাতীয়তাবাদের প্রথম শিক্ষা। প্রথমে সে তার জন্মদাতা মা-বাবার জীবনাদর্শে বিশ্বাসী হতে থেকে এবং প্রগাঢ় টান অনুভব করে, যার ফলে তার আত্মিক সত্তার বিকাশ হতে থাকে যা রুপ নিয়ে থাকে জাতি সত্তায়। ধারাবাহিকভাবে সে তার পরিবার, সমাজ, স্বজাতির প্রতি এবং সর্বশেষে তার রাষ্ট্রের উপর প্রগাঢ় টান অনুভব করে থাকে। স্বজাতির উপর এই অনুভূতি তৈরি হওয়ার পুরো প্রক্রিয়াটাই হলো জাতীয়তাবাদের চেতনার উন্মেষ প্রক্রিয়া।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের বীর সেনানীরাও ভাষা আন্দোলনের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন যা বীর মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম নেতৃত্বদানকারী সম্মুখ যোদ্ধা জিয়াউর রহমানের 'একটি জাতির জন্ম' প্রবন্ধে তিনি উল্লেখ করে গিয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার যে বুলিটি এখন সর্বদা ব্যবহার করা হয় সেটাও মূলত জাতীয়তাবাদের চেতনা। জাতীয়তাবাদের চেতনা একটি জাতি গঠনের মূলমন্ত্র। স্বাধীনতা অর্জনের পরবর্তী সময়ে জাতীয়তাবাদের চেতনাকে বিতর্কিত করতে সাম্প্রদায়িকের তকমা লেপন করে সেকুলারারিজমের পথে হাটা শুরু করে রাষ্ট্র। কিন্তু জাতীয়তাবাদ কখনোই সাম্প্রদায়িকতায় বিশ্বাস করে না। জাতীয়তাবাদ ধর্মের ভিত্তিতে সমাজ গঠনকে অনুপ্রাণিত করে না,তবে ধর্মকে বাদ দিয়ে সমাজ গঠনের পক্ষে রায় দেয়না। কোন ধর্মই বেপরোয়া সমাজ গঠনকে উৎসাহিত করে না। ধর্মীয় অনুশাসন সমাজকে সকল ক্ষেত্রে সুশৃঙ্খল করে এবং সুস্থ ধারার জীবন-যাপনের দিকে পরিচালনা করে।
সেকুলারিষ্টরা রাষ্ট্রকে একনায়কতন্ত্রে উৎসাহিত করে থাকে এবং তারা তাদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিল করার জন্য বিভিন্ন ধর্মীয় উন্মাদনা তৈরিতে উস্কানি প্রদান করে থাকে এবং জাতি গঠনের মনোযোগ ব্যহত করতে তৎপর থাকে।
সেকুলারিজম হলো শিক্ষিত সমাজের কুষ্ঠ রোগ। আর এই রোগ থেকে মুক্তির পাওয়ার একমাত্র প্রতিশোধক হলো জাতীয়তাবাদ।বস্বাধীনতা পরবর্তী সরকার জাতীয়তাবাদের চেতনাকে পাশ কাটিয়ে সেকুলার রাষ্ট্র গঠনের পথে হাটতে থাকে যার কারণে সরকার স্বাভাবিক গতি হারিয়ে লাইনচ্যুত হয়ে পরে এবং জাতীয় স্বার্থ ভূলন্ঠিত হয়ে থাকে।ঠিক তখনই আবার মুক্তিযুদ্ধে বীর উত্তম খেতাবধারী মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান জাতীয়তাবাদী চেতনার শক্তি দিয়ে লাইনচ্যুত রাষ্ট্রকে পুনরায় সঠিক পথে পরিচালনা করতে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের প্রতিষ্ঠা করেন এবং তার ভিত্তিতে রাষ্ট্র পরিচালনা করেন।আধুনিক বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ভীত তার সময়কালেই স্থাপিত হয়।
বাংলাদেশে জাতীয়তাবাদী চেতনার ধারক, বাহক ও প্রতিনিধিত্বকারী রাজনৈতিক দল হলো বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল(বিএনপি)। বিএনপি জাতীয়তাবাদের চেতনায় বিগত সময়ের মতো আজও রাজপথে সক্রিয় আছে জাতির অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে। একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠার অব্যাহত চেষ্টায় দমন পীড়নের স্বীকার হচ্ছে জাতীয়তাবাদের প্রতিনিধিত্বকারী দলটি।
যেহেতু জাতীয়তাবাদের শক্তির উৎস জাতি,সেহেতু জাতীয়তাবাদের উপচে পড়া ঢেউ ভেসে যাবে সকল অপশক্তি। আবারও ১৯৫২সালের ভাষা আন্দোলনে যেভাবে জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ ঘটেছিল ঠিক তেমনই অধিকার আদায়ের সকল সংগ্রামে জেগে উঠবে জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী জনগণ।
লেখক: সাবেক সহ সাংগঠনিক সম্পাদক( খুলনা), স্বেচ্ছাসেবক দল, কেন্দ্রীয় সংসদ।
মন্তব্য করুন
মত-মতান্তর থেকে আরও পড়ুন
মত-মতান্তর সর্বাধিক পঠিত

জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]