শরীর ও মন
মাংসপেশির টান (Muscle Pool)
ডা. মো. বখতিয়ার
৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, বৃহস্পতিবার
মাংসপেশির টানকে চিকিৎসা পরিভাষায় মাসল পুল, মাসল সোরনেস, স্ট্রেইন, ঘেএজতইন, ক্র্যাম্প, স্প্যাজম ইত্যাদি বলা হয়ে থাকে। মাংসপেশিতে অতিরিক্ত টান খেলে বা টিস্যু ছিঁড়ে যাওয়ার কারণে এমনটা হয়ে থাকে। এতে শরীরের টানজনিত অংশটিতে ভীষণ ব্যথা হয়। এ সময় ল্যাকটিক অ্যাসিড নিঃসরণের জন্য জ্বালাপোড়া করে। এ কারণে মাংসপেশি নাড়াচাড়া করা যায় না।
কারণসমূহ
১. শরীরের যেকোনো একটি মাংসপেশি অনেকক্ষণ ধরে ব্যবহৃত হলে। ২. ব্যায়াম, খেলাধুলা বা যেকোনো শারীরিক অনুশীলনের আগে ওয়ার্মআপ বা শরীর গরম না করলে। ৩. পেশি ক্লান্ত থাকা অবস্থায় হঠাৎ নড়াচড়া করলে। ৪. হঠাৎ অতিরিক্ত ভারী কিছু ওঠালে। ৫. পেশির অতিরিক্ত ও অনুপযুক্ত ব্যবহার। ৬. মানসিক চাপ ও দুশ্চিন্তা।
লক্ষণসমূহ
১. যদি পেশিতে অনেক ব্যথা হয়। পেশি অনেক দুর্বল হয়ে যায়। ২. আঘাতপ্রাপ্ত স্থানটি যদি ফুলে ওঠে বা লালচে দাগ পড়ে যায়। ৩. যদি আঘাতপ্রাপ্ত স্থানে স্বাভাবিক ওজন নিতে কষ্ট হয়। ৪. মাংসপেশি আপনা আপনি অনেক শক্ত হয়ে পড়লে।
করণীয়
মাংসপেশিতে টান লাগলে প্রথম কয়েকদিন চারটি ধাপে এর চিকিৎসা করতে হবে। যাকে সংক্ষেপে রাইস থেরাপি বলা হয়। যার মাধ্যমে ব্যথা অনেকটাই কমিয়ে আনা যায়।
রাইস থেরাপির ৪টি ধাপ হলো:
রেস্ট, আইস, কমপ্রেশন ও এলিভেট। ১. রেস্ট বা বিশ্রাম: সব ধরনের শারীরিক ব্যায়াম বন্ধ রাখতে হবে। আঘাতপ্রাপ্ত স্থানে কখনও কোনো ওজন নেয়া যাবে না। ২. আইস বা বরফ- আঘাতের স্থানে দুই থেকে তিন ঘণ্টা পরপর ২০ মিনিটের জন্য বরফের ব্যাগ দিয়ে রাখুন। ৩. কমপ্রেশন বা সংকোচন: আঘাত প্রাপ্ত স্থানটি নাড়াচাড়া নিয়ন্ত্রণে একটি ব্যান্ডেজ দিয়ে মুড়িয়ে নিতে হবে। ৪ এলিভেট বা উঁচু করা: আঘাতের স্থানটি যতটা সম্ভব বালিশের উপরে উঠিয়ে রাখতে হবে।
যা করতে মানা
মনে রাখতে হবে মাংসপেশির ফুলে ওঠা প্রতিরোধে কোনো অবস্থাতেই আঘাতপ্রাপ্ত স্থানে গরম স্যাঁক বা গরম পানি দেয়া যাবে না। এছাড়া আঘাতের স্থানে কোনো অবস্থাতেই মালিশ করা যাবে না। যখন আপনি ক্ষতস্থানটি স্বাভাবিকভাবে নাড়াচাড়া করতে পারবেন। খুব বেশি ব্যথা নেই তখন ধীরে ধীরে স্বাভাবিক কাজ করার চেষ্টা করুন। নাড়াচাড়া করার চেষ্টা করুন যাতে জয়েন্ট বা পেশি শক্ত না হয়ে যায়।
চিকিৎসা
মাংস পেশিতে টান পড়লে সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া উচিত। বিশেষ করে, মাংসপেশিতে অতিরিক্ত ব্যথা হলে, ব্যথায় জ্বর উঠে গেলে, কয়েকদিন পরও সেই ব্যথা না কমলে, মাংসপেশির ফুলে ওঠা না কমলে বা বাড়লে, শ্বাস নিতে কষ্ট হলে, মাথা ঘুরতে থাকলে, শরীর ভীষণ দুর্বল হয়ে কাঁপতে থাকলে। মাসল পুল হওয়ার পর পেশির ওই অংশ যদি টান টান করতে গিয়ে ব্যথা পান, তাহলে সেই চেষ্টা আর করা যাবে না। এতে পরিস্থিতি হিতে বিপরীত হতে পারে। অনেক সময় মচকানোর প্রভাব সাতদিন থেকে শুরু করে ছয় মাস পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে। পরিস্থিতি গুরুতর হলে অস্ত্রোপচারের প্রয়োজনও হতে পারে। পরিস্থিতি সাপেক্ষে ব্যথানাশক ওষুধ খাওয়ার পরামর্শ দেয়া হতে পারে। মাংসপেশির টানের অবস্থা জানতে বিভিন্ন পরীক্ষার মাধ্যমে মাসল পুলের কারণ ও মাত্রা নির্ণয় করে থাকেন জানার চেষ্টা করেন চিকিৎসকরা। প্রাথমিকভাবে রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে শরীরে ইলেক্ট্রোলাইটের ভারসাম্য অর্থাৎ সোডিয়াম ও পটাশিয়ামের মাত্রা ঠিক আছে কিনা সেটা পরীক্ষা করা হয়। সেখানে সমস্যা থাকলে রোগীকে চিকিৎসকরা বিশ্রামের পাশাপাশি ডাবের পানি, স্যালাইন, কিশমিশ এবং মিনারেল জাতীয় খাবার খাওয়ার পরামর্শ দেন। এছাড়াও আলট্রাসাউন্ড ইমেজিং এক ধরনের শব্দ তরঙ্গের মাধ্যমে সারা শরীরের পেশি, রগ, লিগামেন্ট, স্নায়ু এবং জয়েন্টের ছবি ধারণ করেও চিকিৎসা হয়। যা মূলত পেশিতে আচমকা টান খাওয়া, মচকানো টিস্যু ছিঁড়ে যাওয়া, স্নায়ুতে বাধা, বাত বা পেশি সংক্রান্ত অন্যান্য যেকোনো সমস্যা নির্ণয়ে ব্যবহৃত হয়। মাসলপুল বা এ সমস্যা ফিজিওথেরাপির মাধ্যমেও চিকিৎসা করলে রোগী ভালো হয়।
প্রতিরোধ ১. যেকোনো শারীরিক অনুশীলনের বা ভারী কিছু তোলার আগে অবশ্যই ওয়ার্মআপ করে মাংসপেশিগুলোকে সচল করে নিতে হবে। ২. নিয়মিত ব্যায়াম করতে হবে। ৩. দীর্ঘক্ষণ না বসে, এক ঘণ্টা পর পর কয়েক মিনিট কিছুক্ষণ পাঁয়চারি করতে হবে। ৪. প্রচুর পানি পান করতে হবে।
লেখক: জনস্বাস্থ্য বিষয়ক লেখক ও গবেষক ব্যবস্থাপনা পরিচালক, খাজা বদরুদজোদা মডার্ন হাসপাতাল, সফিপুর, কালিয়াকৈর, গাজীপুর।