ঢাকা, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, শনিবার, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

প্রথম পাতা

‘দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে’

অর্থনৈতিক রিপোর্টার
২৮ জানুয়ারি ২০২৩, শনিবার
mzamin

বাবলী আক্তার। স্কুল শিক্ষিকা। ৮ বছর আগে বিয়ে করেছেন। রয়েছে দুই সন্তান। স্বামী, সন্তান আর পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ভালোভাবেই দিন পার করছিলেন। কিন্তু এখন আর পারছেন না। বাবলী বলেন, জিনিসপত্রের দাম হু হু করে বাড়ছে। কেউ দেখার নেই। নিত্যপণ্যের দাম যত বাড়ছে, ততই টান পড়ছে উপার্জনে। সংসারের ফর্দও ছোট হচ্ছে।

বিজ্ঞাপন
চাহিদা থাকলেও আগের চেয়ে বড় করা যাচ্ছে না; বরং কোনো ক্ষেত্রে ছোট হচ্ছে। কিন্তু ইনকাম আগের জায়গায় স্থির। এমন অবস্থায় বাধ্য হয়ে সংসারের চাহিদার তালিকা থেকে অনেক আইটেম বাদ দিতে হচ্ছে। আগে কেনাকাটা করতে যা মন চাইতো তাই কিনতাম। এখন আর পারি না। ইলিশ মাছ, মাংস কিনতে গেলে অনেক ভাবতে হয়। আগে মাসে কয়েকবার গরু বা খাসির মাংস কিনলেও এখন তা একবারও সম্ভব হচ্ছে না। মাসিক খাবারের পেছনে সংসারের সব টাকা ব্যয় হচ্ছে। সস্তা পুষ্টি ডিমও মাঝে মাঝে বাদ দিতে হয়। এর বাইরে বাচ্চার স্কুল, যাতায়াত, বাইকের তেল খরচ, বুয়ার মাসিক বেতন, চিকিৎসা, মোবাইল ফোনের বিল ইত্যাদি খরচে টান পড়ে যায়। ধারও করতে হয়। তিনি বলেন, বাজারে ১ হাজার টাকার একটা নোট নিয়ে গেলে খুচরা টাকা ফেরত আসে না। যেমন; ২ কেজি চাল, ১ লিটার তেল, আধা কেজি ডাল, ১ কেজি চিনি, ১ কেজি পিয়াজ, ২ কেজি আলু, আদা, রসুনসহ মসলা কেনার পর ১ হাজার টাকার নোট দিলে দোকানি ফেরত দেন ২৫৫ টাকা। এর পর ১২০ টাকায় এক কেজি তেলাপিয়া আর একটি লাউ ও এক কেজি বেগুন কেনার পর বাকি রইলো ৩০ টাকা। দুই আঁটি লালশাক কিনতেই শেষ হাজার টাকা। অথচ দরকারের তালিকায় থাকা কাপড় কাঁচার সাবান, কলা, নারিকেল তেল, আর বিস্কুটের মতো পণ্য কেনাই হয় না। এভাবে আর কতো দিন চালানো যায়? কারণ বাঁধা আয়ে সংসার প্রায় অচল। আমাদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। আগে কিছু সঞ্চয় করা যেতো। এখন সে সঞ্চয় ভেঙে পারিবারিক ব্যয় নির্বাহ করতে হচ্ছে। 

উচ্চশিক্ষা শেষে সরকারি চাকরি না পেয়ে এখন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আলী হোসেন। কথা হয় তার সঙ্গে। বৃদ্ধ মা, স্ত্রী ও ছেলে-মেয়েসহ পরিবারের ৬ সদস্যকে নিয়ে কীভাবে টিকে আছেন, তার চিত্র তুলে ধরলেন তিনি। অফিস করেন রাজধানীর মৌচাকে। বেতন ৩০ হাজার টাকা। বিয়ে করেছেন। আছে দু’টি সন্তান। খরচ কমানোর জন্য রাজধানীর বনশ্রীর শেষ সীমান্ত এলাকার ২ রুমের বাসায় থাকেন। ভাড়া প্রায় ১১ হাজার টাকা। গ্রামের বাড়িতে মা-বাবার জন্য প্রতি মাসে পাঠাতে হয় কমপক্ষে ৪ হাজার টাকা। বাকি ১৫ হাজার টাকায় চালাতে হয় পুরো মাস। তার হিসাবের মতে, পানির বিল ৫০০, গ্যাস ৯৭৫, ডিশ বিল ৪০০, ইন্টারনেট ৭০০, বিদ্যুৎ গড়ে ১০০০, ময়লা ফেলার জন্য ১২০, ওষুধ ১০০০, ২ সন্তানের লেখাপড়া বাবদ ৭ হাজার, অফিস যাতায়াত বাবদ ৩ হাজার টাকা। সবমিলিয়ে সাড়ে ২৯ হাজার টাকার মতো খরচ। বাকি টাকা দিয়ে সারা মাসের চাল, ডাল, তেল, নুন, আটা ও সবজি কেনার পর আরও ধার করতে হয় তাকে। তিনি বলেন, টানা ১০ বছর একই প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছেন। এ সময়ে পরিবারের খরচ বেড়েছে। একইসঙ্গে বাসা ভাড়া থেকে শুরু করে নিত্যপণ্যের দামসহ কয়েকগুণ বেড়ে গেছে দৈনন্দিন জীবনযাত্রার ব্যয়। কিন্তু বেতন বেশি বাড়েনি। সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। বাজার কাটছাঁট করেই চলতে হচ্ছে তাকে। 

তিনি বলেন, অনেক সময় মাস শেষ হয়ে আরেক মাসের মাঝামাঝি সময়ে বেতন হওয়ায় হাত পাততে হয় বন্ধু বা সহকর্মীদের কাছে। টানাটানির সংসারে কোথাও বেড়ানোর সুযোগ নেই। খরচ কমাতে ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও ঈদে বাড়ি যাওয়াও বাদ দেন তিনি। বলেন, অনেক দিন পর গ্রাম থেকে ঢাকায় মা এসেছেন। মাকে ভালোমন্দ খাওয়াবেন। এক কেজি মাংস কিনলেন ৭১০ টাকা দিয়ে। এক হাজার টাকার নোটের বাকি ২৯০ টাকা দিয়ে আদা, রসুন, মসলা আর আলু কিনতেই শেষ। তিনি বলেন, বেতন এক টাকাও বাড়েনি। হিসাবের টাকার সংসারে আজ এটা নাই তো কাল ওটা নাই। বাড়িভাড়া, ছেলেমেয়ের স্কুলের খরচ সবকিছু মিলিয়ে বারবার হিসাব করতে হচ্ছে বেতনের টাকায়। দেশে খাবারসহ নিত্যপণ্যের দাম বাড়ছে। সেই হিসাবে আয় বাড়েনি। তাই হিসাব মেলানো কঠিন হয়ে পড়েছে। আলী হোসেন জানালেন, মাস শেষের আগেই বেতনের টাকা ফুরিয়ে যায়। পরের মাসে বেতন পাওয়ার আগ পর্যন্ত অন্যের কাছ থেকে ধার করে চলতে হয়। ভোজ্য তেল, চাল-ডালসহ বাজারের অধিকাংশ পণ্যের দাম চড়া হওয়ায় শুধু কম দামি সবজি খেয়ে দিন পার করতে হচ্ছে তাকে। মোট কথা দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে।

উত্তম দাস। জুতা পলিশের কাজ করেন। বসেন মধুবাগ বাজারের ফুটপাথে। আগে এখানে তার বাবা বসতেন। সংসারে ৫ সদস্য। জুতা সেলাই করে যা জুটে তা দিয়েই চলে সংসার তার। তিনি বলেন, বর্তমানে যা আয় হয় তা দিয়ে সংসার চলে না। সারা দিনে ২০০ টাকার কাজ করাও কঠিন হয়ে যায়। তিনি বলেন, বিদ্যুৎ, তেল আর গ্যাসের দাম বাড়লো, আমাদের মতো গরিবদের জন্য এগুলোর খরচ দেয়া অনেক কঠিন। বিল না দিলেই তো লাইন কেটে দেয় তারা। এটা তো আমাদের কাছে বোঝা। আমাদের ইনকামই বা কতো? কীভাবে চলবো আমরা? তিনি জানান, খাওয়া-দাওয়া আর সন্তানদের লেখাপড়ার খরচ দিতেই হিমশিম খেতে হচ্ছে। এখন পলিশ করতে ৩০ টাকা নিই। আগে ৫০০ টাকা আয় করলে দিব্যি সংসার ভালো চলতো। এখন সংসারের খরচ হাজার টাকায়ও কুলোয় না। আয় এমন অবস্থায় চলে এসেছে যে গ্রামের বাড়িতেও যেতে পারি না। বাড়িতে গেলেই আয় বন্ধ হয়ে যায়। তিনি বলেন, সকালে মোড়ে বসি। থাকি রাত ৮-৯টা পর্যন্ত। এ সময়ের মধ্যে গড়ে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা আয় হয়। মাঝে মধ্যে হাজার টাকাও আয় হয়। এ ছাড়া আগে মানুষ বাইরে বের হলে জুতা পলিশ করাতেন। এখন অনেকেই নিজেরাই দামি কালি দিয়ে পলিশ করেন। বাইরে পলিশ করান না। এতেও তো আমাদের আয় কমছে। যা আয় করি তা দিয়ে এখন আর কোনোভাবেই সংসার চলছে না! তাই কাজ শেষে বাসায় যাওয়ার সময় রাস্তায় কম দামে যে সবজি পাই তা-ই কিনে নিই। তিনি বলেন, এই পেশা আর ভালো লাগছে না। এই কাজ ছেড়ে ভাবছি বাড়ি গিয়ে মানুষের ক্ষেত-খামার দেখবো। কষ্ট হলেও বাড়িতে তো থাকতে পারবো! এভাবে চলতে থাকলে ছেলের পড়াশোনা করাতে পারবো না। ভাবছি ছেলেকে কোনো গ্যারেজের কাজে পাঠাবো।

মগবাজারের মধুবাগ এলাকার শেরে-বাংলা স্কুল অ্যান্ড কলেজের সামনে ঝালমুড়ি বিক্রি করেন খালেক মিয়া। তিনি বলেন, এক বছর আগে দৈনিক গড়ে আয় ছিল ৭-৮শ’ টাকা। এখনো তাই। মাঝে মধ্যে কমও হয়। তবে এই টাকায় গত বছর ঠিকমতো চলতে পারলেও এ বছর নুন আনতে পানতা ফুরায় অবস্থা। তিনি জানান, গত বছর যেই মুড়ি প্রতি কেজি কিনেছেন ৬৫ টাকায়, এবার তার দাম ৮০ টাকা। ১৮০ টাকার সরিষার তেল এখন ২৮০ টাকা। চানাচুর, পিয়াজ, কাঁচামরিচ, লেবু সবকিছুর দামই বাড়তি। এমনকি ঝালমুড়ি পরিবেশনের যে ঠোঙ্গা, তার দামও ৬০ টাকা থেকে বেড়ে ১০০ টাকা কেজি হয়ে গেছে। সবমিলিয়ে ঝালমুড়িতে আর আগের মতো লাভ নেই। তিনি বলেন, সংসার, বাসা, বাজার নিয়ে একদম নরক যন্ত্রণায় পড়ে গেছি।

অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, সরকারের পরিসংখ্যানের চেয়ে বাস্তব চিত্র আরও করুণ। দেশে জীবনযাত্রার ব্যয় যে হারে বেড়েছে, আনুষ্ঠানিক বা অনানুষ্ঠানিক কোনো খাতেই সে হারে মজুরি বাড়েনি। ফলে মানুষের আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের চাহিদার একটা বড় ব্যবধান রয়ে যাচ্ছে। আয় বৈষম্য বেড়েই চলেছে। কেউ কেউ বিকল্প পথে বাড়তি আয়ের চেষ্টা করছেন। তাও সম্ভব না হলে সঞ্চয় ভেঙে খাচ্ছেন কিংবা ধারদেনা করছেন। আর এসব কিছুই সম্ভব না হলে কম খেয়ে পরিস্থিতি সামাল দেয়ার চেষ্টা করছেন। অনেক পণ্যের ব্যবহার কমিয়ে ফেলছেন।

কনজুমার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, পণ্যমূল্য যৌক্তিকভাবে নির্ধারণ হচ্ছে না। হঠাৎ করে একেকটি পণ্যের দাম বেড়ে যাচ্ছে। এটি কারসাজি। সরকারও শক্ত অবস্থান নিতে পারছে না। কিন্তু সাধারণ মানুষকে এর মূল্য দিতে হচ্ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ার কারণে সাধারণ মানুষের কষ্ট হচ্ছে। কারণ তাদের আয় সীমিত। এটি নিয়ন্ত্রণে চাহিদা অনুযায়ী সকল পণ্যের সরবরাহ বাড়ানোর পাশাপাশি সরকারকে ভর্তুকি দিতে হবে। অত্যাবশ্যকীয় জিনিসপত্রে ভর্তুকি না দিলে সাধারণ মানুষের কষ্ট হবে।

প্রথম পাতা থেকে আরও পড়ুন

   

প্রথম পাতা সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status