প্রথম পাতা
উত্তপ্ত ফরিদপুর, পিটিয়ে দুই সহোদরকে হত্যা
ফরিদপুর প্রতিনিধি
২০ এপ্রিল ২০২৪, শনিবারউত্তপ্ত মধুখালী। এ উত্তাপ ছড়িয়ে পড়েছে গোটা ফরিদপুরে। টানটান উত্তেজনা সর্বত্র। মোতায়েন করা হয়েছে পুলিশ ও বিজিবি। ঘটনা তদন্তে গঠন করা হয়েছে দু’টি তদন্ত কমিটি। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় সন্দেহের বশে ক্ষুব্ধ জনতা গণপিটুনি দেয় একটি বিদ্যালয়ে কাজ করা নির্মাণ শ্রমিকদের। এতে নিহত হন দুই সহোদর। এ ঘটনায় গুরুতর আহত হন আরও ৫ শ্রমিক। খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে ছুটে যান পুলিশ ও উপজেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা। ক্ষুব্ধ জনতা পুলিশ ও প্রশাসনের কর্মকর্তাসহ নিহত ও আহতদের ৬ ঘণ্টা অবরুদ্ধ করে রাখে। পরে ফরিদপুর জেলা সদর ও রাজবাড়ী জেলা থেকে অতিরিক্ত পুলিশ গিয়ে তাদের উদ্ধার করে। ঘটনাটি ঘটেছে মধুখালী উপজেলার ডুমাইন ইউনিয়নের পঞ্চপল্লী গ্রামে। ওই গ্রামের বারোয়ারী মন্দিরে আগুন দিয়েছে কে বা কারা। এ ঘটনায় বিক্ষুব্ধ স্থানীয়রা সন্দেহবশত হামলা চালায় পাশের স্কুলে কর্মরত নির্মাণ শ্রমিকদের ওপর। গণপিটুনিতে ঘটনাস্থলে নিহত হন নির্মাণ শ্রমিক মো. আশরাফুল খান (২১) ও মো. আরশাদুল খান (১৫)। খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে ছুটে যান আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। এ সময় তাদের ওপরও হামলা চালায় লোকজন। পরে অবরুদ্ধ করে রাখা হতাহত নির্মাণ শ্রমিকদের উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠায় পুলিশ। এদিকে ঘটনার পরপরই সেখানে পুলিশ ও বিজিবি মোতায়েন করা হয়। জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপারসহ প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে ছুটে যান। এছাড়া ঘটনা তদন্তে দু’টি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়।
ফরিদপুরের জেলা প্রশাসক মো. কামরুল আহসান তালুকদার জানান, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার পর হিন্দু অধ্যুষিত পঞ্চপল্লী গ্রামের বারোয়ারী মন্দিরের কালী প্রতিমায় অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় স্থানীয় হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। তারা মন্দির থেকে ২০ গজ দূরের পঞ্চপল্লী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ওয়াশ ব্লক নির্মাণ কাজে নিয়োজিত ৭ শ্রমিককে সন্দেহ করে স্কুলের শ্রেণিকক্ষে অবরুদ্ধ করে গণপিটুনি দেয়। খবর পেয়ে মধুখালী থানা পুলিশ ও উপজেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে গেলে বিক্ষুব্ধরা তাদেরও অবরুদ্ধ করে রাখে। শ্রমিকদের নসিমনটি আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ফেলে। পরে ফরিদপুর জেলা সদর ও রাজবাড়ী জেলা পুলিশের সহযোগিতায় ছয় ঘণ্টা পর অবরুদ্ধদের উদ্ধার করা হয়। তিনি জানান, আহত অবস্থায় সাত শ্রমিককে উদ্ধার করা হলেও তাদের মধ্যে চারজন অচেতন ছিল। আহতদের উদ্ধার করে দুইজনকে মধুখালী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এবং ফরিদপুরের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।
ফরিদপুরের পুলিশ সুপার মো. মোরশেদ আলম জানান, শত শত মানুষ এই হামলায় অংশ নেয়ায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে ফাঁকা গুলি বর্ষণ করা হয়েছে। বিক্ষুব্ধদের ছোড়া ইট-পাটকেলের আঘাতে পুলিশের বেশ কয়েকজন সদস্য আহত হয়েছে। তিনি আরও জানান, এই ঘটনায় কাউকে আটক করা সম্ভব হয়নি। পরিস্থিতি বর্তমানে পুলিশের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। পরিস্থিতি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত পুলিশ মোতায়েন থাকবে বলে জানান পুলিশ সুপার। এদিকে গতকাল সকালে ওই এলাকায় তিন প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন করা হয়।
ঘটনার বর্ণনা দিয়ে ডুমাইন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আসাদুজ্জামান তপন সাংবাদিকদের বলেন, মাগরিবের নামাজ পড়ে আমি মাঠে বসেছিলাম। কিছু সময় পরে ১ নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার অজিত বাবু আমাকে ফোন দেন। বলেন, আপনি দ্রুত আসেন, এখানে মন্দিরে আগুন দিয়েছে। কে বা কারা? বললেন, এখানে লেবাররা আগুন দিয়েছে। তাদেরকে ধরে রাখছি। আমি তাৎক্ষণিকভাবে এখানে এলাম। এসে দেখি হাজার হাজার মানুষ। আমি জনগণকে শান্ত করার চেষ্টা করি। কিন্তু দেখলাম যে পরিস্থিতি বেগতিক। এখানে আসলে প্রশাসন ছাড়া কোনোভাবেই সম্ভব না। চেয়ারম্যান বলেন, আমি প্রশাসনকে ফোন দিই, ইউএনওকে ফোন দেই। স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পুলিশ ও প্রশাসনের লোকজন আসার পর তারাও জনতার বাধার মুখে পড়ে। পরে জেলা পুলিশ এসে তাদের উদ্ধার করে। জেলার সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি-মধুখালী সার্কেল) মিজানুর রহমান বলেন, মন্দিরে কে বা কারা আগুন দিয়েছে। বিক্ষুব্ধ লোকজন নির্মাণ শ্রমিকদের ওপর হামলা করেছে, মারপিট করেছে।
আহত শ্রমিক লিটন মোল্লা জানান, আগুন দেখার পর এলাকাবাসীর সঙ্গে আমরা নেভানোর কাজে অংশ নেই। কিন্তু বিক্ষুব্ধরা শ্রমিকদের সন্দেহ করে আটক করে গণপিটুনি দেয়। বিক্ষুব্ধ বিপুলসংখ্যক মানুষ লাঠি রড ইট দিয়ে হামলা চালিয়ে বেধড়ক মারধর করে।
এদিকে আহত শ্রমিকদের ফরিদপুর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়ার পর কর্তব্যরত চিকিৎসক এক শ্রমিককে মৃত ঘোষণা করেন। চিকিৎসাধীন অবস্থায় আরও এক শ্রমিকের মৃত্যু হয় রাত দুইটার দিকে। নিহতরা ফরিদপুরের মধুখালী উপজেলার নওপাড়া ইউনিয়নের চোপেরঘাট গ্রামের শাহজাহান খানের পুত্র।
এদিকে ঘটনার মূল তথ্য উদ্ঘাটনের জন্য জেলা প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসনের পক্ষ থেকে দু’টি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তারা আগামী তিন কর্ম দিবসের মধ্যে প্রকৃত ঘটনার প্রতিবেদন দেবেন। তাদের প্রতিবেদনের আলোকেই পরবর্তী ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জেলা প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসন জানিয়েছেন।
জেলা প্রশাসনের তদন্ত কমিটিতে অতিরিক্ত ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ আলী সিদ্দিকীকে আহ্বায়ক করে মধুখালী সার্কেল মিজানুর রহমান ও আনসার কমান্ডারকে সদস্য করে তিন সদস্যের কমিটি করা হয়। অপরদিকে পুলিশের তরফ থেকে ফরিদপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ইমদাদ হোসেনকে প্রদান করে মধুখালী সার্কেল মিজানুর রহমান ও মধুখালী থানার পুলিশ পরিদর্শক তদন্ত সফিউল আলমকে সদস্য করে তিন সদস্যর একটি কমিটি করা হয়।
পাঠকের মতামত
ঘটনার পারিপার্শ্বিকতা ও পরবর্তী প্রক্রিয়া দেখে মনে হচ্ছে কলকাতা কিংবা গুজরাটের কোন ঘটনা। বাংলাদেশে দুইজন মুসলিমকে এভাবে নৃসংশভাবে হত্যা নিঃসন্দেহে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের উপর আঘাত বলা যায়। দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।যাতে আর কেউ এমন সাম্প্রদায়িক হত্যাকাণ্ডের অপচেষ্টায় লিপ্ত না হয়।
আমি এর তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছি, সেই সাথে দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করছি,,কতটা নির্মম কতটা জঘন্য
প্রশাসনের ভুমিকা রহস্যময়। এখন পর্যন্ত কোন মামলা করেনি পুলিশ। তারাও তো মার খেয়েছে নাকি এটা তাদের গায়ে লাগেনি।সত্যমিথ্যা বাছ-বিচার না করেই পিটিয়ে ৩ জনকে মেরে ফেলল,অথচ আমাদের সরকার ৩ দিন পার করার পরও হত্যাকারী একজনকেও গ্রেফতার করেনি।
অন্যায়ভাবে শ্রমিকদের হত্যা করার তীব্র নিন্দা জানাই। দোষী ব্যক্তিদের গ্রেফতার করে সঠিক বিচার করা হোক।
মধুখালী উপজেলার ডুমাইন ইউনিয়নের পঞ্চপল্লী গ্রামে গিয়ে জানা যায়, গত ১৮ই এপ্রিল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় এলাকার বারোয়ারী কালী মন্দিরে পূজা দিচ্ছিলেন পাশের বাড়ির তপতি মণ্ডল নামের এক গৃহবধূ। মন্দিরটিতে তিনি প্রতিদিন একই সময়ে একাই পূজা-অর্চনা করেন। ওইদিন পূজা দেয়া শেষে বাড়ি যাওয়ার সময় দেখছিলেন মন্দির সংলগ্ন পঞ্চপল্লী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের উন্নয়ন কাজের শ্রমিকরা ভবনের ছাদে রড তুলছিলেন। তিনি বাড়ি যেতে না যেতেই মন্দিরে আগুন লাগার খবর শুনে এসে দেখেন কালীর কাপড়ে আগুন। এমনও হতে পারে, কেউ পূজা দেওয়ার সময়, আগরবাতি অথবা মোমবাতির আগুন থেকেও ত হতে পারে,
ঘটনাস্থলে নিহত দুইজন, হাসপাতালে নিহত হয়েছে কয়জন এবং নিহত এর সঠিক সংখ্যা কত প্রকাশ করুন।
এদেশে কেউ সংখ্যালঘু নয়। খুনিদেরকে রক্ষা করতে কোনো নাটক সাজানো হলে এদেশের জনগণ মেনে নেবে না।
Don't believe msllu,
খুনিদের সর্বাত্মক বয়কট করুন।এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের বিচার নৃশংস পদ্ধতির মাধ্যমেই করা হোক।
এত বড় ঘটনা মসজিদ হলো তো গ্রেপ্তারের বন্যা বয়ে যেত উগ্রবাদী হিন্দুদের কেউ এখনো গ্রেপ্তার হল না কেন
এখন পর্যন্ত কেউ গ্রেফতার হলো না , এখন পর্যন্ত !কোন মামলা হলো না ! মসজিদে হলে অনেক লোক গ্রেফতার হয়ে যেত.
ক্ষুব্ধ জনতা? নাকি উগ্র হিন্দু জনতা? লেখনি ঠিক করেন আপনারা। পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচন সামনে। নাটক সাজিয়ে সাধারণ মুসলিম মেরে ফায়দা নেওয়া। জনগণ এতটা বেকুব নাই এখন আর।
মন্দিরে আগুন দেওয়ার কারণে কোন রকম সাক্ষ্য প্রমাণ ব্যতিরেকে নিরীহ শ্রমিকদের নৃশংসভাবে পিটিয়ে মারা হয়েছে যা চরম দুর্ভাগ্যজনক। অবিলম্বে তদন্ত পুরবক দোষীদের বিরুদ্ধে কঠিন শাস্ত্রীমূলক ব্যবস্থা ব্গ্রহণ করা উচিত।
দেশের সকল উপাসনালয়ে সিসিক্যামেরা লাগানো হোক, যাতে অকাজ করে কেউ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টি করতে না পারে।
সঠিক তদন্ত করা হোক
বন্ধু দেশে নির্বাচন চলিতেছে!
বর্বর নিকৃষ্ট। মন্দিরে কে বা কারা আগুন দিলো তা যাচাই না করেই এ কেমন নৃশংসতা ?
পশ্চিম বঙ্গে নির্বাচনের আগে আগে একটা ঘটনা ঘটেছিল মনে আছে.... সামনেই ওদের লোকসভা নির্বাচন..... যা বুঝার বুঝে নেন...
কেবল মাত্র সন্দেহের বশে বিধর্মী কাউকে খুন করতে হবে - এটা মেনে নেয়া যায় না। আমরা সুষ্ঠ তদন্তের আশা করি।