মত-মতান্তর
রম্য
নম্বর নিয়ে খুচরো আলাপ
গাজী মিজানুর রহমান
(১১ মাস আগে) ২০ এপ্রিল ২০২২, বুধবার, ১২:৪২ অপরাহ্ন

আমরা অনেক সময় গর্ব করে বলি, আমাদের বংশের লোক এই জেলার প্রথম গ্রাজুয়েট। ‘প্রথম’ কথাটার মধ্যে যে একটা জাদুকরী আকর্ষণ আছে, তার ভাগীদার হতে চাই সকলে। কিন্তু বাস্তবে অনেককিছুর প্রথম হওয়া ভালো নয়। এসব ক্ষেত্রে ‘প্রথম’ বললে সাথে সাথে ‘দ্বিতীয়’ ধারণা এসে হাজির হয়, তাতে প্রথমের মূল্য যায় কমে। তাই তো প্রথম জেনারেশনের কম্পিউটার বা মোবাইলের চেয়ে দ্বিতীয়, তৃতীয় বা পরবর্তী জেনারেশনের কম্পিউটার ও মোবাইলের কদর বেশি। আবার যা-কিছু একটা নিয়ে জীবন অতিবাহিত করলে মর্যাদা বাড়ে, তার দ্বিতীয় বা তৃতীয় নম্বরের অস্তিত্ব মানুষের পছন্দ নয়। কোনো ভদ্রমহিলার প্রাক্তন স্বামীকে সমাগত সুধীজনের সামনে ‘প্রথম স্বামী’ বলে পরিচিত হতে হলে ব্যাপারটার মধ্যে একটা ছাড়াছাড়ির আবহ চলে আসে। ‘প্রথম’ শব্দটা এখানে স্বামিত্বের দাবিকে একেবারেই খারিজ করে দেয় ।
তাই অনেককিছুতে নম্বর দিতে গেলে কেউ না কেউ বিব্রত হতে পারেন।
আগে যখন বোর্ডে স্ট্যান্ড করার পদ্ধতি চালু ছিল, তখন ফার্স্ট স্ট্যান্ড করতে পারার একটা আলাদা গুরুত্ব ছিল। এখনো বিশ্ববিদ্যালয় সমূহে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হলে সকলে বাহবা দেয়। তবে প্রথম হওয়া তো সকলের ভাগ্যে জোটে না।
এক নম্বরের পরে দুই নম্বরের অবস্থান হলেও কেউ যদি কাউকে ‘দুই নম্বর’ বলে অভিহিত করেন, তাহলে তিনি মনে মনে অসন্তুষ্ট হতে পারেন। সারি যখন দুটো প্রথম আর দ্বিতীয়, তখন দুই নম্বর লাইনে কে যেতে চায় ? সেকেন্ড ডিভিশন ফুটবল খেলেন যারা, তারা কি আর বলে বেড়ান যে, দ্বিতীয় বিভাগে ফুটবল খেলি? অন্যদিকে, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষার ফলাফলে তিনটি ক্লাস থাকে ফার্স্ট ক্লাস, সেকেন্ড ক্লাস এবং থার্ড ক্লাস। এখানে থার্ড ক্লাস কেউ পেতে চায় না। ফেল করবে তাও ভালো, কিন্তু থার্ড ক্লাস পাওয়া চলবে না। তাই পরীক্ষার ফলাফলে থার্ড ক্লাস পাওয়ার আশঙ্কা থাকলে অনেকে পরীক্ষায় এক-দুই পেপার ড্রপ দিয়ে ফেল করার বন্দোবস্ত করেন। থার্ড ক্লাস হচ্ছে একটা খারাপ ব্রান্ড। তাই তো অনেককে বলতে শুনি, থার্ড ক্লাস কথাবার্তা বলো না তো ! কিংবা বলে, থার্ড ক্লাস মানসিকতা পরিহার করো ! ফোর্থ ক্লাসের কথা কমই শোনা যায়।
বেশিরভাগ খেলাধুলায় শেষপর্যন্ত টিকে থাকা খেলোয়াড়ই প্রথম হন। বেলুন ফাটানো খেলায় যার বেলুন আগে ফাটবে, তিনি আউট। তিন উলটো দিক দিয়ে প্রথম। উলটো দিক দিয়ে প্রথম হওয়ায় গৌরব না থাকলেও চলন আছে। বিশ্বের বসবাস-অযোগ্য শহরের একটা তালিকা আছে। এ তালিকায় আমাদের ঢাকার নাম প্রথমদিকে থাকলেও এতে আমাদের গৌরব নেই। প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়Ñ এই বিবেচনার পরে আসে ১০ এর মধ্যে, ২০ এর মধ্যে বা ৫০ এর মধ্যে থাকার ব্যাপারটা। প্রতিযোগিতা যখন বিশ্বব্যাপী তখন ১০০ জনের মধ্য থাকাও কঠিন। তাই শত শত নানা ধরনের তালিকা পাওয়া যায়, যেমনÑ ১০০ সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম, ১০০ সেরা প্রভাবশালী নারীর নাম, ১০০ সেরা ধনীর নাম, ১০০ সেরা অভিনেতার নাম- এমন আরো অনেক। ইন্টারনেট দুনিয়ার এই সময়ে কেউ যদি বেশি মানুষ হত্যার বিবেচনায় পৃথিবীর ১০০ সেরা খুনির নাম চান , তাও পাবেন ।
যখন সোভিয়েত ইউনিয়নের অস্তিত্ব ছিল, তখন সোভিয়েত ব্লকের দেশগুলিকে বলা হত ‘দ্বিতীয় বিশ্ব’। প্রথম বিশ্ব ছিল পাশ্চাত্যের দেশগুলি । আর তৃতীয় বিশ্ব ছিল উন্নয়নশীল দেশগুলি, যারা প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বের বাইরের দেশ। এইরূপ নামকরণের উদ্যোক্তা অবশ্যই পাশ্চাত্যের বুদ্ধিজীবীরা । ‘প্রথম বিশ্ব’ হতে পারা তাদের জন্য আনন্দের। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর ‘দ্বিতীয় বিশ্বের’ অস্তিত্ব লোপ পাওয়ায় তৃতীয় বিশ্ব বা প্রথম বিশ্বের ধারণা অবান্তর হয়ে গেছে। কিন্তু ইদানীং লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে, নম্বরের প্রতি লোভ কারো কমেনি। প্রাক্তন এক নম্বর বিশ্ব এবং প্রাক্তন দুই নম্বর বিশ্ব এখন ইউক্রেন নিয়ে প্রদর্শনী ম্যাচ খেলে মুকুটে পালক যুক্ত করতে ব্যস্ত । প্রাক্তন তিন নম্বর বিশ্বের কাছে তেমন কিছু নেই, আছে জাতিসংঘের ভোট। কেউ কেউ ভোট দেয়, আর কেউ কেউ বিরত থেকে ভোটের মূল্য আছে কি নেই, তা পরীক্ষা করে দেখে ।
(গাজী মিজানুর রহমান: লেখক এবং সাবেক সিভিল সার্ভেন্ট)