গেল কয়েক সপ্তাহ থেকে পরিযায়ী পাখির দেখা মিলছে দেশের সবচেয়ে বড় হাওর হাকালুকিতে। অতিথি পাখির কলকাকলিতে মুখরিত হয়ে উঠছে হাকালুকি হাওরের প্রতিটি বিল। এমন খবরে এখন পর্যটকেরও ভিড়ে বাড়ছে। তবে অতিথি পাখি আগমনের এমন ভরা মৌসুমে থেমে নেই শিকারির দলও। ওই চক্রটি প্রতিদিন বিষটোপ, জাল ও ফাঁদ দিয়ে নানা কায়দায় অতিথি পাখি শিকারে তৎপর থাকলেও প্রতিরোধে সংশ্লিষ্ট দপ্তরের নেই কোনো নজরদারি। তাদের চরম উদাসীনতায় বাড়ছে অবাধে পাখি নিধন। এমনটি জানাচ্ছেন হাওর পাড়ের বাসিন্দারা। জানা গেছে, একটু উষ্ণতা আর খাবারের নিশ্চয়তায় এবারো অতিথি পাখিরা আসছে উত্তর গোলার্ধের শীতপ্রধান দেশ থেকে। পুরো শীত মৌসুম এরা দাপিয়ে বেড়ায় হাকালুকি হাওরের প্রতিটি বিলে। আর বসন্তের শুরুতেই তাদের অস্থায়ী নিবাস গুটিয়ে নিজ দেশের আপন নীড়ের উদ্দেশ্যে উড়াল দেয়।
এ কয়দিনের জন্য ওরা হাওর পাড়ের হিজল, করচ, বরুণ, আড়াং গাছেই গড়ে তোলে তাদের অস্থায়ী নিবাস। হাকালুকি হাওর পাড়ের বাসিন্দারা জানালেন, ইতিমধ্যেই ছোট ছোট দলে হাওরের পিংলা, চাতলা, চৌকিয়া, হাওরখাল, মালাম, গৌড়কুড়ী, নাগুয়া, তুরল, কালাপানি, ফোয়ালা, বালিজুড়ী, কাংলি ও ফুটবিলে নানা জাতের নানা রঙের অতিথি পাখির দেখা মিলছে। এখন পাখিদের কিচিরমিচির আওয়াজে হাওর পাড়ের চারপাশ মুখরিত হয়ে উঠছে। তবে এদের শিকার করতে স্থানীয় একটি চক্র রয়েছে তৎপর। প্রতিবছরই নানা কারণে অতিথি পাখির সংখ্যা কমে যাচ্ছে। তবে অতিথি পাখি কমে গেলেও বছর জুড়ে বেশকিছু মাছ শিকারি দেশীয় পাখির দেখা মেলে। ৫টি উপজেলা (কুলাউড়া, জুড়ী, বড়লেখা, ফেঞ্চুগঞ্জ ও গোলাপগঞ্জ) জুড়ে ২৩৮টি বিল নিয়ে এ হাওরের আয়তন ২০ হাজার ৪শ’ হেক্টর। পাখি,মাছ ও জলজ জীববৈচিত্র্যের সম্ভাবনাময়ী এই বিশাল আয়তনের হাওর এখন নানা কারণে ধ্বংসের দোরগোড়ায়। হাকালুকি হাওরে পাখি কমার কারণ সম্পর্কে বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা ও পাখি বিশেষজ্ঞ ইনাম আল হক ও পাখি বিশেজ্ঞ ডক্টর পল থমসন বলেন, যখন পাখিরা আসে তখন জলাভূমিতে মাছ ধরা পড়ে। বোরো ধান চাষেরও মৌসুম থাকে। ওই এলাকায় তখন মানুষের আনাগোনা বেড়ে যায়। পাখিরা যখন বুঝে নেয় তাদের আবাসস্থলটি নিরাপদ নয়, তখনই পরবর্তী বছরে ওই জায়গাটিতে তারা আর আসতে চায় না। এ ছাড়া পরিযায়ী পাখি যখন যেখানে আসে সেখানেই প্রজনন, খাবার ও পরিবেশ এমন সার্বিক অবস্থার ওপরই নির্ভর করে। কারণ বিভিন্ন প্রজাতির পাখি বিভিন্ন ধরনের আবাসস্থল করে। তাদের খাবারও ভিন্ন ভিন্ন। এসব কারণেই পাখি বছরে বছরে কমবেশি হয়। অনিরাপদ আবাসস্থল আর খাদ্য সংকট মূলত এ দু’টি বিষয় পাখি কমবেশি হওয়ার অন্যতম কারণ। তারা বলেন, হাকালুকি হাওরের বিলগুলো ভরাট হয়ে যাচ্ছে। মাছ, উদ্ভিদ, জলজপ্রাণি ও জলজ গাছের সংখ্যা কমছে। অরক্ষিত থাকার কারণে হাওরের প্রাকৃতিক সম্পদ লুট হচ্ছে বা এই প্রাকৃতিক সম্পদের যথাযথ ব্যবহার হচ্ছে না। এমন কারণসহ নানা কারণেই হাওরের জীববৈচিত্র্য ও প্রাকৃতিক সম্পদ ধ্বংস হচ্ছে। তারা বলেন, যদি হাওরের সার্বিক উন্নয়নে পরিকল্পিতভাবে সরকার এবং স্থানীয় জনগণ একসঙ্গে কাজ করে তাহলেই কেবল এই প্রাকৃতিক সম্পদের সংরক্ষণ করা সম্ভব। হাওরের সুন্দর পরিবেশ, বন, জলজ ও উভচর প্রাণী, দেশীয় প্রজাতির মাছ, সর্বোপরি জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশ রক্ষা পাবে। এমনটি হলে হাওর পাড়ের স্থানীয় বাসিন্দাদের জীবন জীবিকা রক্ষার পাশাপাশি পর্যটন শিল্প বিকাশের পথকে আরও সুগম করবে। জানা যায়, ৪ঠা ডিসেম্বর হাকালুকি হাওরের জুড়ী উপজেলা অংশের তুরলবিলের পাশের মহিষ রাখাল বেলাগাঁও গ্রামের মুজিবুর রহমানের বাসায় বস্তাবন্দি বেশকিছু পাখি পান স্থানীয় সাংবাদিকরা। জিজ্ঞেস করলে সে জানায়, জায়ফরনগর ইউনিয়নের নয়াগ্রামের নজু মিয়ার ছেলে হোসেন মিয়া বিষটোপ দিয়ে পাখিগুলো ধরে জবাই করে তার বাসায় রাখে। সে জানায়, নাগুরা বিলের ইজারাদার ফয়াজ মিয়া ওইদিন সকালে বেশকিছু জীবিত পাখি শিকারির হাত থেকে উদ্ধার করে বিলে ছেড়ে দেন। ২৬শে নভেম্বর গৌড়কুড়ি বিলে ফাঁদ পেতে ধরা হয় কয়েকটি অতিথি পাখি। স্থানীয়রা জানান, জুড়ী উপজেলা অংশ ছাড়াও হাওরের অন্যান্য বিলেও রাতে ও ভোরে বিষটোপ ও ফাঁদ পেতে ধরা হচ্ছে পাখি। প্রকৃতিপ্রেমী ও পরিবেশবাদীরা বলছেন, বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ বিভাগসহ উপজেলা প্রশাসন, সংশ্লিষ্ট বিভাগ ও স্থানীয় বাসিন্দারা পরিযায়ী পাখি রক্ষায় দ্রুত সক্রিয় ভূমিকা রাখার প্রয়োজন। তা না হলে অতিথি পাখির ঐতিহ্য হারাবে হাকালুকি হাওর।