ঢাকা, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, বৃহস্পতিবার, ১২ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

শেষের পাতা

প্রশ্নে ভুল, বিতর্কের নেপথ্যে কী

পিয়াস সরকার
১৫ নভেম্বর ২০২২, মঙ্গলবার

চলতি বছরের এসএসসি-এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষা নিয়ে বিতর্ক যেন থামছেই না। এসএসসি পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁস নিয়ে সমালোচনা হয়েছে ব্যাপক। আর এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষায় প্রথম দিনে সাম্প্রদায়িক প্রশ্ন করা হয় ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের বাংলা প্রথম পত্রে। একই দিনে কারিগরি বোর্ডের বাংলা প্রথম পত্র পরীক্ষা এক ঘণ্টা চলার পর বন্ধ হয়ে যায়। এরপরের পরীক্ষায় কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের অধীনে লেখককে অবমাননা করে প্রশ্ন করা হয়। এই বিতর্কিত প্রশ্ন নিয়ে সমালোচনা হয়েছে ব্যাপক। দুটি ঘটনা কী কারণে তা নিয়ে তদন্ত কমিটি করেছে সংশ্লিষ্ট দু’টি বোর্ডই।

ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের বাংলা প্রথম পত্রের প্রশ্নে বলা হয়, নেপাল ও গোপাল দুই ভাই। জমি নিয়ে বিরোধ তাদের দীর্ঘদিন। অনেক সালিশ বিচার করেও কেউ তাদের বিরোধ মেটাতে পারেনি। কেউ কাউকে ছাড় দিতে নারাজ।

বিজ্ঞাপন
এখন জমির ভাগ বণ্টন নিয়ে মামলা চলছে আদালতে। ছোট ভাই নেপাল বড় ভাইকে শায়েস্তা করতে আব্দুল নামে এক মুসলমানের কাছে ভিটের জমির এক অংশ বিক্রি করে। আব্দুল সেখানে বাড়ি বানিয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে। কোরবানির ঈদে সে নেপালের বাড়ির সামনে গরু কোরবানি দেয়। এই ঘটনায় নেপালের মন ভেঙে যায়। কিছুদিন পর কাউকে কিছু না বলে জমি-জায়গা ফেলে সপরিবারে ভারতে চলে যায় সে।
এই প্রশ্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পরই ব্যাপক সমালোচনার জন্ম হয়। প্রশ্নপত্রে সাম্প্রদায়িক উস্কানির সঙ্গে জড়িত প্রশ্নকর্তা ঝিনাইদহের মহেশপুর ডিগ্রি কলেজের সহকারী অধ্যাপক প্রশান্ত কুমার পাল। অপরদিকে প্রশ্নপত্র পরিশোধনের দায়িত্বে ছিলেন নড়াইলের সরকারি ভিক্টোরিয়া কলেজের সহযোগী অধ্যাপক সৈয়দ তাজউদ্দীন শাওন, সাতক্ষীরা সরকারি মহিলা কলেজের সহযোগী অধ্যাপক মো. শফিকুর রহমান, নড়াইলের মির্জাপুর ইউনাইটেড কলেজের সহকারী অধ্যাপক শ্যামল কুমার ঘোষ এবং কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা আদর্শ কলেজের সহকারী অধ্যাপক মো. রেজাউল করিম।

এই ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তে কমিটিও গঠন করেছে শিক্ষা বোর্ড। যশোর শিক্ষা বোর্ডের কলেজ পরিদর্শক এম রব্বানীকে তদন্ত কমিটিতে প্রধান করা হয়েছে। একই শিক্ষা বোর্ডের বিদ্যালয় পরিদর্শক ও উপ-কলেজ পরিদর্শককে কমিটির সদস্য করা হয়েছে। তাদের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ পাঠাবে যশোর শিক্ষা বোর্ড। জানা যায়, প্রশ্নের নেপাল ও গোপাল প্রশ্নকর্তা প্রশান্ত কুমারের আত্মীয়। প্রশ্ন নিয়ে তদন্ত চলছে। তদন্ত সূত্রে জানা যায়, প্রশ্ন জানার পর মডারেটরের দায়িত্বে থাকা চার জন এড়িয়ে যান কিংবা দেখেও মন্তব্য করেননি। তবে এই চার শিক্ষকের একজন শিক্ষক মৌখিকভাবে আপত্তি জানিয়েছিলেন। কিন্তু মৌখিক অভিযোগকে আমলে নেননি প্রশ্নকর্তা। 

ঢাকা মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান ও আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় সাব-কমিটির সভাপতি অধ্যাপক তপন কুমার সরকার বলেন, আমাদের প্রশ্নপত্র তৈরির ক্ষেত্রে নির্দেশনা দেয়া থাকে যাতে কোনো ধরনের সাম্প্রদায়িক প্রশ্ন না রাখা হয়। বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে প্রশ্নকর্তা এই প্রশ্ন কেন করলেন? আর প্রশ্ন মডারেটরের দায়িত্বে যারা ছিলেন তারা কেন এড়িয়ে গেলেন। আমরা তদন্ত শেষে বিষয়টি নিয়ে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।

কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের আওতাধীন বাংলা দ্বিতীয় পত্রের প্রশ্নে দেখা যায়, একটি সৃজনশীল প্রশ্নের উদ্দীপকে লেখক আনিসুল হকের নাম উল্লেখ করে বলা হয়েছে, বইমেলায় তাড়াহুড়ো করে বই প্রকাশ করেন তিনি। পাঠকদের কাছে তার লেখা বই খাপছাড়া মনে হয়। ফলে পাঠকদের কাছে তিনি সমাদৃত হন না।

সেই অনুচ্ছেদের নিচে ৫টি প্রশ্ন করা হয়েছে (ক) ‘যশ’ শব্দের অর্থ কী? (খ) ‘লেখা ভালো হইলে সুনাম আপনি আসিবে।’ উক্তিটি ব্যাখ্যা কর। (গ) আনিসুল হক কোন কারণে ব্যর্থ, তা ‘বাঙ্গালার নব্য লেখকদিগের প্রতি নিবেদন’ রচনার আলোকে ব্যাখ্যা কর। (ঘ) সাহিত্যের উন্নতিকল্পে ‘বাঙ্গালার নব্য লেখকদিগের প্রতি নিবেদন’ রচনায় লেখকের পরামর্শ বিশ্লেষণ কর।’ এ ছাড়া একই প্রশ্নে নারীকেও অবজ্ঞা করে প্রশ্ন করা হয়েছে। 

এই প্রশ্ন নিয়েও ব্যাপক সমালোচনার জন্ম হয়েছে। কারিগরি শিক্ষা বোর্ডে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মূলত এই প্রশ্নে প্যারিচাঁদ মিত্র কেন ভালো লেখনীর পরও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বা সমসাময়িক লেখকদের মতো বিখ্যাত হতে পারেননি। কিন্তু এই প্রশ্ন শেষ মুহূর্তে বদলে গিয়ে আনিসুল হকের নাম আসে। কীভাবে আসে এই নাম, প্রশ্নকর্তা কিংবা মডারেটরের হাত ধরে বদলে যায় নাম। এটি নিয়েই অনুসন্ধান করছে তদন্ত কমিটি।

৬ই নভেম্বর করা এই প্রশ্নের ভুলে তদন্ত কমিটি গঠন করেছে কারিগরি শিক্ষা বোর্ড। ১০ই নভেম্বর কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের সচিব মোহাম্মদ আবদুল্লাহ আল মাহমুদ জামানকে আহ্বায়ক করে তিন সদস্যবিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন- কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের পরিদর্শক খালেদ হোসেন এবং উপ-পরীক্ষা নিয়ন্ত্রণ (ডিপ্লোমা) মোহাম্মদ শাহিন কাওসার সরকার। তাদের তিন কর্মদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিলের কথা বলা হয়েছে।
এই ঘটনা সামনে আসার পর দুঃখ প্রকাশ করেছেন কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান আলী আকবর খান। তিনি বলেন, আমরা প্রশ্নকর্তাকে খুঁজে বের করে শিগগিরই ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।

প্রশ্ন ফাঁসের বিষয়ে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, শিক্ষাব্যবস্থায় প্রযুক্তিগত ফাঁকফোকর অনেক রয়ে গেছে। উপরন্তু যারা শিক্ষা দেখভালের সঙ্গে সম্পৃক্ত তাদের দেশপ্রেম বা বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য প্রশ্নবিদ্ধ। সবকিছু মিলিয়ে পরীক্ষা পদ্ধতি সেকেলে আমলের। এই পরীক্ষা পদ্ধতিতে শিক্ষার মেধা যাচাই করা সম্ভব নয়। প্রশ্ন দেখভালের দায়িত্বে যারা আছেন তাদের জরুরিভিত্তিতে কঠোর পদক্ষেপ নেয়া উচিত। কারণ এই প্রশ্ন সমাজে প্রভাব ফেলে। এক প্রশ্ন নিয়ে কয়েক বছর ধরে চর্চা করেন শিক্ষার্থীরা।

পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে ‘নৈরাজ্য’ বন্ধ করার আহ্বান জানিয়ে শুক্রবার বিবৃতি দিয়েছেন ২৪ বিশিষ্টজন। বিবৃতিতে বলা হয়, সম্প্রতি মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক ও কারিগরি স্তরের পাবলিক পরীক্ষার সৃজনশীল প্রশ্নপত্রে সাম্প্রদায়িক উস্কানিমূলক, নারীর প্রতি অবমাননাকর এবং একজন লেখকের প্রতি বিদ্বেষপ্রসূত ও অবমাননাকর প্রশ্ন সংযোজনের ঘটনা ঘটেছে। এটি অনাকাক্সিক্ষত ও অনভিপ্রেত, কোনো অবস্থাতেই এসব মেনে নেয়া যায় না।

বিবৃতিতে বলা হয়, সৃজনশীল শিক্ষা পদ্ধতিতে শিক্ষক-শিক্ষার্থী সবাইকে সৃজনশীল হয়ে উঠতে হবে। সম্প্রতি পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ, নারীর প্রতি অবমাননাকর, ব্যক্তির প্রতি বিদ্বেষমূলক প্রশ্নপত্র শিক্ষাব্যবস্থার প্রতিক্রিয়াশীল, সাম্প্রদায়িক ও আধুনিকতাবিরোধী প্রবণতার চিত্র উঠে এসেছে। এ কারণে শুধু প্রশ্নপত্র প্রণয়নকারী ও মডারেশন বোর্ডের সদস্যদের যোগ্যতা ও ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন করার পাশাপাশি সমগ্র শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে ভাবার সময়ও এসেছে। পাশাপাশি মৌলবাদী একটি গোষ্ঠী বিজ্ঞানশিক্ষার পঠনপাঠন থেকে চার্লস ডারউইনের যুগান্তকারী বিবর্তনবাদ তত্ত্ব বাদ দেয়ার যে দাবি তুলেছে, তাও আমাদের বিচলিত করছে। এসব বিষয়ে বাংলাদেশে বিজ্ঞানশিক্ষা ও মুক্তচিন্তার প্রসার বাধাগ্রস্ত করবে এবং দীর্ঘমেয়াদে রাষ্ট্র ও সমাজকে অন্ধকার, সাম্প্রদায়িকতা আর কূপমণ্ডূকতায় ঠেলে দেবে।

শেষের পাতা থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

   

শেষের পাতা সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status