শরীর ও মন
ভালবাসাময় বিদায়: প্যালিয়েটিভ কেয়ার
সামিনা হক শাম্মী
(১ বছর আগে) ৮ অক্টোবর ২০২২, শনিবার, ১১:৪৬ পূর্বাহ্ন
পৃথিবীতে জন্ম অবধারিত, ঠিক তেমনি ভাবে মৃত্যুও সুনিশ্চিত। প্রতিটা মানুষের জীবনে একটা নিরাপদ জন্মের প্রস্তুতি যদি আয়োজন পূর্ণ হতে পারে, তাহলে মৃত্যু পথ যাত্রী অথবা দুরারোগ্য ব্যধিতে আক্রান্ত রোগীদের জন্য জীবনের শেষ সময়গুলো কেন হবে কেবল হতাশাপূর্ণ বিভীষিকাময়? ক্যান্সার, এইচআইভি, পারকিন্সন এর মতো অনেক দীর্ঘমেয়াদী রোগ যে কোনো সময় যে কারো হতে পারে, যা কখনো ভালো হবার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। অন্যভাবে বলা যায়, এমন সব রোগীরা প্রকৃতপক্ষে ধীরগতিতে নিশ্চিত মৃত্যুর দিকেই এগিয়ে যান।
একজন সুস্থ মানুষের মৃত্যু ভাবনা যতটা বেদনা দায়ক, একজন দুরারোগ্য রোগ বহনকারী মানুষের মৃত্যুচিন্তা আরও অনেক বেশি যন্ত্রণাদায়ক। রোগসংক্রান্ত শারীরিক যন্ত্রণা তো আছেই, সেই সাথে চিকিৎসা খরচ ও পারিবারিক জীবনভিত্তিক ভবিষ্যৎ চিন্তাগুলোও তাকে মানসিক ও শারীরিকভাবে আরো দুর্বল করে ফেলে। এমন একটা অবস্থায় সেই মৃত্যুপথ যাত্রী মানুষটির প্রতি আমাদের কি কিছুই করার নেই? চিকিৎসাশাস্ত্রের অপারগতা নিশ্চিত হবার সাথে সাথে নিরুপায় চিকিৎসকগনের- ‘আমাদের হাতে আর কিছু করার নেই, এবার বাড়ি নিয়ে যান..’ এমন সব অমানবিক সংলাপ নিয়ে, ‘জীবন-সমাপ্তি’র ঘণ্টা বাজিয়ে- মৃত্যুর অপেক্ষায় প্রহর গুনতে হবে রোগী ও তাঁর পরিজনদের?
এমন একটা ভ্রান্ত চিন্তাধারাকে সঙ্গী করে মানুষকে হাঁটতে হয়েছে দীর্ঘসময় । কিন্ত দেরিতে হলেও সময়ের সাথে বদলেছে দৃষ্টিভঙ্গি। কিছু প্রশস্ত চেতনার মানুষ এগিয়ে এসেছেন এইসব অনিরাময়যোগ্য রোগী ও তাঁদের মৃত্যুপথ যাত্রাটিকে ঘিরে পৃথিবীকে নতুন করে ভাবতে শেখাতে। জানিয়েছেন মৃত্যু তিথির সাম্ভাব্য সময় জেনে ফেলেটা কোন অপরাধ নয়। জীবনের সকল আনন্দ থেকে বঞ্চিত হয়ে, কেবল হাহুতাশ করে অসহায়ত্ব নিয়ে মৃত্যুপ্রহর গুণতে থাকাটা নিশ্চিতভাবে অগ্রহণযোগ্য। তাহলে? এ পর্যায়ে করণীয় যথাযথ দিকনির্দেশনা নিয়ে এসেছে যে সেবা প্রক্রিয়াটি তারই নাম প্যালিয়েটিভ কেয়ার বা প্রশমনসেবা ।
প্যালিয়েটিভ কেয়ার কোনো প্রতিষ্ঠানের নাম নয়।
‘খারাপমৃত্যু’ বনাম ‘ভালোমৃত্যু’
প্যালিয়েটিভ কেয়ার ব্যবস্থাপনায় মৃত্যুকে প্রকৃত প্রস্তাবে একটু ভিন্ন আঙ্গিকে দেখা হয়। মৃত্যু হতে পারে ‘বেদনাদায়ক মৃত্যু’ বা ইংরেজিতে বলাহয় ‘bad death’ আর হতে পারে ‘ভালো মৃত্যু’ বা good death। শব্দ দুটি যদি আপনাকে ভাবনায় ফেলে দেয় অবাক হবার কিছু নেই । মৃত্যুকে আমরা বরাবরই একটা জীবন বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসাবেই দেখে অভ্যস্ত। তাই ‘ভালমৃত্যু’ বা ‘খারাপমৃত্যু’ শব্দগুলো আমাদের চিরচেনা ভাবনাতে একটু জট পাকিয়ে দেবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু কখনও লক্ষ্য করেছেন কি? দীর্ঘসময় রোগে না ভুগে, স্বল্পমেয়াদী কষ্টপ্রাপ্তির মধ্যদিয়ে কেউ মারা গেছে শুনলে কিংবা বয়সান্তে কারো হঠাৎ মৃত্যুর কথা শুনলে; আপনি নিজেও সেই প্রয়াণকে ‘ভালোমৃত্যু’ বা ‘সম্মানজনক মৃত্যু’ বলে আখ্যায়িত করেছেন, পরিজনদেরকে সান্তনা দিয়েছেন। নিজেও স্বস্তি পেয়েছেন। পক্ষান্তরে, দীর্ঘমেয়াদি রোগে ভুগে অসহনীয় শারীরিক যন্ত্রণার মধ্যদিয়ে যে সকল মানুষকে মৃত্যুবরণ করতে দেখেছেন, তাদের ব্যাপারে আফসোসের সাথে; ‘এ বড় যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যু’ বলে মতামত দিয়ে, এমন জীবনাবসান যেন কারো ভাগ্যে না জোটে’ তার জন্য স্বগক্তি করেছেন।
আমাদের সমাজে মৃত্যুকে ভালো ও মন্দের ভিত্তিতে সংজ্ঞায়িত করার এই স্বাভাবিক নিয়মটাকেই; আরও একটু গোছালো ভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে প্যালিয়েটিভ কেয়ারএর দৃষ্টিতে ‘ভালো মৃত্যু’ এবং ‘খারাপ মৃত্যু’ নামে।
সেই বিবেচনায়, প্যালিয়েটিভ কেয়ার ব্যবস্থাপনার দৃষ্টিতে ‘ভালো মৃত্যু’ বলতে বোঝানো হয়েছে; চিকিৎসকের সাহায্যে দীর্ঘমেয়াদি রোগাক্রান্তদের শারীরিক বেদনাকে কমিয়ে আনতে সচেষ্ট থেকে, সামাজিক ইতিবাচক পরিবেশে যথা সম্ভব স্বাভাবিক জীবন যাপনের মধ্য দিয়ে, তুলনামূলকভাবে আধ্যাত্মিক ও মানসিক প্রশান্তির জীবনাবসান। পক্ষান্তরে, যে সকল রোগাক্রান্ত ব্যক্তি অসহনীয় রোগ যন্ত্রণা ও মানসিক বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে জীবনের অন্তিম মুহূর্ত শেষ করে সেই সকল মৃত্যুকে বলা হয় ‘খারাপ মৃত্যু’ অথবা bad death.
প্যালিয়েটিভ কেয়ার কি ও কেন?
পৃথিবীতে একটি শিশুর জন্ম বার্তা মানে তাকে সাদরে গ্রহণ করার জন্য বহু প্রস্তুতি আর মায়া ও দায়িত্ব জড়ানো আয়োজন।একজন সন্তানসম্ভবা মায়ের জন্য দশ মাস, দশ দিনের সুদীর্ঘ পথ বেয়ে নিজের ভেতরে নতুন একটি মনুষ্য শরীরকে বেড়ে তোলা, কোনো সহজ কাজ নয়। প্রচুর শারীরিক এবং মানসিক বেদনার মধ্য দিয়ে যেতে হয় তাঁকে। কেবল সন্তান-প্রাপ্তির স্বপ্নই যথেষ্ট নয় এমনসব যন্ত্রণা ভুলিয়ে এতোটাপথপারিদিতে। সত্যি বলতে কি; নিয়মিত চিকিৎসকদের সকল ধরনের চিকিৎসা সেবা এবং আত্মীয় স্বজন, পরিবারের ছোটো-বড় সকল সদস্যবৃন্দ ও পাড়া প্রতিবেশীদের সযত্ন পরামর্শ, চলাফেরা-কাজকর্মে সহযোগিতা, সঠিক খাদ্যাভ্যাস, ঔষধ সেবন, ধর্মীয় আশার বাণী প্রভৃতি সস্নেহ আশ্বাস তাঁর মাতৃত্বের দীর্ঘ চলার আনন্দপথটিকে আন্তরিকতা আর সাহসিকতায় ভরিয়ে দেয়। তাই অনিবার্য অসহনীয় প্রসব বেদনার আতঙ্ক এই দীর্ঘ সময়টিকে সহসাই স্পর্শ করতে পারেনা।অথচ, জন্মের ঠিক বিপরীতেই আছে ‘মৃত্যু’। জীবনের সময়সীমা যখন চিকিৎসক দ্বারা ঘোষণাপ্রাপ্ত অবধারিত ‘মৃত্যু যাত্রা’ , তখন ‘জন্মের বৈপরীত্যে’র মতই মৃত্যু-আয়োজনটিও যেন ‘দায়িত্বগত বৈপরীত্যে’র হাত ধরে হতাশার দিকে এগিয়ে যায়।যার ফলাফলঃ অপার শারীরিক ও মানসিক যন্ত্রনার মধ্য দিয়ে পৃথিবী থেকে সৃষ্টির সর্বশ্রেষ্ঠ একটি প্রাণের বেদনাদায়ক প্রস্থান । ‘মৃত্যু’ তো অবধারিত ‘জন্ম’-এর মতই, তাহলে মৃত্যু কেন হতে পারবে না ভালোবাসাময়?
যেসব মানুষরা অনিরাময়যোগ্য ব্যধিতে ভুগছেন তাদের জন্য প্যালিয়েটিভ কেয়ার স্পেশালাইজড বা বিশেষ একটা মেডিকেল কেয়ার বা সেবা। এই সেবার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে, রোগীদের ‘কোয়ালিটি অফ লাইফ’ অর্থাৎ রোগাক্রান্ত জীবনটাকে আরেকটু উন্নত করার প্রচেষ্টা । কেবল বাংলাদেশ ন্য়, সারা পৃথিবীর জন্যই এমন গোছানোভাবে প্যালিয়েটিভ কেয়ার ধারণাটির প্রকাশনা খুবই সাম্প্রতিক। রোগীর রোগ-যন্ত্রণা কমানো চেষ্টার পাশাপাশি রোগীর, পরিবার ও সম্পৃক্ত পক্ষগুলোর সহযোগিতাপূর্ণ ব্যবহার ও ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি সৃষ্টির মাধ্যমে মৃত্যু পথযাত্রীকে দুঃসহ মৃত্যুর পরিবর্তে যথাসম্ভব স্বাভাবিক যন্ত্রণা প্রশমিত মৃত্যু প্রক্রিয়ায় আনার সচেষ্ট প্রক্রিয়াই প্যালিয়েটিভ কেয়ার ব্যবস্থাপনা। এই পরিপ্রেক্ষিতে এর মূল বক্তব্য হলঃ চিকিৎসক, বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সেবাদানকারী, পরিবারের সদস্যবৃন্দ ও দৈনন্দিন জীবনের সাথে জড়িত পাড়া-প্রতিবেশী, এলাকাভিত্তিক প্রভাব বিস্তারকারী নেতৃত্ব মন্ডলী (যেমনঃ মসজিদের ইমাম, শিক্ষা কর্ম্সমাজ সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি, স্থানীয় পাড়া-প্রতিবেশী প্রমুখ ) সামাজিক সদস্যদের সহায়তায় অনিরাময়যোগ্য রোগীর শারীরিক যন্ত্রণা প্রশমন চিকিৎসার পাশাপাশি; মানসিক,সামাজিক ও আধ্যাত্মিক মননের জায়গাগুলোকেও বিশেষভাবে পরিচর্যা ব্যবস্থার আওতায় আনা হয়। জীবনের প্রতি অনিহার প্রবণতা থেকে রোগীকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা হয়। দীর্ঘমেয়াদি অনিরাময়যোগ্য পথযাত্রায় উদ্ভূত অবশ্যম্ভাবী সমস্যাগুলো মোকাবেলায় সামগ্রিক সহায়তা করে, জীবনের শেষসময়গুলো রোগী ও পরিবারের জন্য যথাসম্ভব কম কষ্টদায়ক ও সহজ করে তোলা হয়। সেই বিবেচনায় এই ব্যবস্থাপনার উদ্দেশ্য থেকেই অনুমান করা যায় যে, এটি একটি সামগ্রিক অ্যাপ্রোচ।
বিদায়ী দৃস্টিভঙ্গি ও সামাজিক চর্চা
‘পরিবারের প্রিয় সদস্যটির রোগ নিরাময়যোগ্যনয়’ এই সংবাদটির ভার রোগীকে ও তার পরিবারকে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা থেকে ছিটকে ফেলার জন্য যথেষ্ট। যার ফলে, দীর্ঘমেয়াদি শারীরিক যন্ত্রণার তীব্রতা বৃদ্ধির দ্বিগুণ গতিতে বেড়ে চলে মানসিক যন্ত্রণার তীব্রতা। এই অসহনীয় অবস্থাটি রোগীকে মৃত্যুর আগেই মানসিক রোগাগ্রস্থ করে মৃত্যুর স্বাদ দিতে শুরু করে। ‘মৃত্যু’ নিয়ে নেতিবাচক ও ভীতিকর সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির অভ্যস্ততার কারণে, নিশ্চিত রোগ অনিরাময়তার খবর পাওয়া মাত্রই রোগী ‘জীবন’কে একটি ‘সমাপ্ত বিদায়ী অধ্যায়’ হিসেবে ভাবতে শুরু করেন। স্বাভাবিক জীবন যাত্রার আনন্দগুলো থেকে নিজেকে সম্পূর্ণভাবে উইথড্র করেন বা গুটিয়ে নেন।
পারিবারিকবন্ধনে বিশ্বাসী বাঙালি পরিবারের জন্য একজন সদস্যের অনিরাময়যোগ্য রোগ মানে- একবিশাল দুঃসহ যুদ্ধ যাত্রা। রোগ নিরাময় অযোগ্য জেনেও মানবিক ভালোবাসাকে পুঁজি করে সদস্যরা যতদিন সম্ভব রোগটি রোগীর কাছ থেকে গোপন রাখাকেই রোগীর জন্য সঠিক মানসিক সহায়তা বলে বিশ্বাস করেন। এবং প্রথাগত চিকিৎসার এক দুয়ার থেকে আরেক দুয়ারে ছুটে বেড়ান। ‘যদি রোগ ভাল হয়’ -এই আশায় নিরাময় চিকিৎসার উদ্দেশ্যে পরিবারের সমস্ত সাধ্য বাজি রেখে মানুষটিকে বাঁচানোর চেষ্টায় বেপরোয়া হয়ে উঠেন।
এমন ভালোবাসা অস্থিরতায়, রোগীর জীবনের যতটুকু সময়সীমা বাকি ছিল, সেই সময়টুকু ফুরিয়ে আসতে থাকে। ফলাফলহীন চিকিৎসার দৌড়ঝাপের তীব্রতায় দৈনন্দিন জীবনের স্বাভাবিক গতি বিক্ষিপ্ত হতে শুরু করে। শারীরিক ও আর্থিক দিক দিয়ে পর্যদূস্ত পরিবারটি একসময় ক্লান্ত হয়ে পরে। সর্বোপরি, ‘রোগ সকল চিকিৎসার উর্দ্ধে’ আরও একবার নিশ্চিত হওয়া মাত্র, ‘কারো আর কিছু করণীয় নেই’ এই মন্ত্রকে সামনে রেখে রোগী ও পরিবারের সদস্যগণকে রোগীর মৃত্যুর অপেক্ষায় প্রহর গুনতে হয়।
‘আর কোন চিকিৎসা নেই’, ‘আর কোনো আশা নেই’- এই অযৌক্তিক দৃষ্টিভঙ্গির ফলে রোগীর যন্ত্রণা প্রশমনে কোন ব্যবস্থা যে থাকতে পারে, এই বিষয়ে কোন মনোভাব মনের মধ্যে কখনোই জায়গা পায়না। রোগ বৃদ্ধি সাথে সাথে রোগীর অসহনীয় যন্ত্রণাকালিন শূশ্রসার সহায়ক পদ্ধতি হিসাবে; দৈনন্দিন জীবনের স্বাভাবিকতা থেকে দূরে রাখতে রোগীকে একটি বিশেষ ঘর, বা ঘরের একটি স্থান নির্ধারণ করে, সেখানে যতটা সম্ভব হাসপাতালের চিকিৎসা পরিবেশ বা সেবা বৈশিষ্ট্যর স্পর্শ নিশ্চিত করাটাকেই রোগীর প্রতি ভালোবাসা ঘেরা দায়িত্বপালনের আত্মতৃপ্তি বোধ করেন। তাকে ঘিরে সবকিছুতেই যেন জীবনাবসনের মলিন স্পর্শের আবদ্ধতা। পরিবারের সদস্যদেরকে নিতান্ত্ প্রয়োজন ছাড়া মানুষটি থেকে দূরে রাখা হয় সচেতনভাবে। সদস্যরা বিশ্বাস করতে শুরু করেন, মৃত্যুপথ যাত্রী মানুষটিকে যত বেশী জীবনচাঞ্চল্য থেকে দূরে রাখা যাবে,ততই তাঁকে মানসিকভাবে সাহায্য করা হবে। মৃত্যু পরবর্তী জীবনের প্রস্তুতিতে নিভৃত ধর্মীয় চর্চার মাধ্যমে রোগীর শুদ্ধি আয়োজনটাই অধিক প্রকট হয়ে ওঠতে শুরু করে। বাচ্চাদেরকে রোগীর কাছ থেকে দূরে রাখা হয় এই ভেবেঃ বাচ্চাদের আনন্দপূর্ন কোলাহল মানুষটিকে বিরক্ত করবে । রোগীর সাথে প্রতিবেশী ও আত্মীয়দের আলাপচারিতার একমাত্র কথোপকথন প্রসঙ্গ তখন রোগ বিষয়ক হতাশা, দুঃখভারাক্রান্ত কন্ঠের শান্তনা বানী ।
পরিবারটিতে যে কোন উৎসবমুখর আনন্দ আয়োজনগুলোর মধ্যে থাকে শোকের স্পর্শ। এসবের আরও একটি কারণ হলো, ঘরে অসুস্থ সদস্য থাকা অবস্থায় যে কোনো স্বাভাবিক আনন্দ-আয়োজন বাঙ্গালি সামাজিকতায় হৃদয়হীনতারপ রিচয়। এমনসব অদ্ভুত দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে জীবনের চালচিত্রের ফলাফল স্বরূপ রোগী ও তাঁর পরিবারবর্গ এক পর্যায়ে মানসিকভাবে ও হাঁপিয়ে ওঠেন। বাস্তবতা হলো; যন্ত্রণা দাবদাহে ‘দ্রুত মৃত্যু আত্মস্থ’ করনের প্রার্থনাই তখন, তাদের জন্য শুভ কামনার রূপ নেয়। নিজেদের আশেপাশে চোখ বুলালেই দেখা যায়, এমন দৃশ্য আমাদের খুব অচেনা নয়। পারিবারিক বন্ধনের মত চমৎকার একটি ঐতিহ্য চর্চা শুধুমাত্র ‘মৃত্যুপথ যাত্রী’-কে নিয়ে জ্ঞানস্বল্পতা’র কারণে আমাদের সমাজে মুখ থুবরে পড়েছে।
বাংলাদেশে পেলিয়েটিভ কেয়ার
২০০৭ সালে বাংলাদেশে প্রথম প্যালিয়েটিভ মেডিসিন চিকিৎসাধারণাটি নিয়ে কাজ শুরু করেন, ডক্টর প্রফেসর মোহাম্মদ নিজাম উদ্দিন আহমেদ যিনি বাংলাদেশের ‘প্যালিয়েটিভ কেয়ার বাবস্থাপনার জনক’ বা ফাদার অফ পালিয়েটিভ কেয়ার রূপে আখ্যায়িত; তিনি সর্বপ্রথম বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ছোট্ট ঘরে প্যালিয়েটিভ মেডিসিন চিকিৎসা ধারণাটি নিয়ে কাজ শুরু করেন। তাঁর অক্লান্ত প্রচেষ্টায়, ২০১১সালে সেই যাত্রাপথের বিস্তৃতিতে তৎকালীন মহামান্য প্রেসিডেন্ট জিল্লুর রহমান ‘সেন্টারফর প্যালিয়েটিভ কেয়ার’ উদ্বোধন করেন। সীমিত পরিসরের সেবা ব্যবস্থাপনায় প্যালিয়েটিভ কেয়ারের কাজ এগিয়ে চলে। সময়ের সাথেসাথে প্যালিয়েটিভ কেয়ার এর গুরুত্ব অনুধাবিত হতে থাকে। তারই ফলশ্রুতিতে ২০১৫ সনে এটিকে স্পেশলটি হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয় এবং ২০১৬ সনে এমবিইন প্যালিয়েটিভ মেডিসিন নামে পাঁচ বছরের রেসিডেন্সি প্রোগ্রাম শুরু করা হয় বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা ২০১৪সালে প্যালিয়েটিভ কেয়ার এর গুরুত্ব অনুধাবন করে, সারা পৃথিবীর রাষ্ট্রগুলোকে, তাদের চিকিৎসা ব্যবস্থায় প্যালিয়েটিভ কেয়ার বিষয়টিকে অন্তর্ভুক্ত করার আহ্বান জানায়। বাংলাদেশও এসময় সেই সনদে স্বাক্ষর করে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে বিজ্ঞান যেমন আমাদেরকে অনেক সুবিধা দিয়েছে, তেমনি আমাদের জীবন থেকে কেড়ে নিয়েছে অনেক ধরনের মানবিক চর্চা। প্যালিয়েটিভ কেয়ারকে সাধারণ ভাষায় তেমনই একটি হারিয়ে যাওয়া মানবিক চর্চার প্রাতিষ্ঠানিক প্রত্যাবর্তন বললে হয়ত বাড়িয়ে বলা হবে না।
পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধনের ঐতিহ্যই হতে পারে প্রশমন সেবার মুল বাহন
প্যালিয়েটিভ কেয়ার চেষ্টা করে, অনিরাময়যোগ্যতার শোকে রোগী যেন মুশরে না পরে, এই সেবায় সর্বাগ্রে নিশ্চিত করতে হয় শারীরিক কস্ট কমানোর প্রক্রিয়াটিকে। যার ব্যবস্থা কেবল মাত্র একজন পালিয়েটিভ প্রশিক্ষন প্রাপ্ত চিকিৎসকই দিতে পারেন। সেই সাথে বিশেষ প্রশিক্ষন প্রাপ্ত সেবাদানকারী কর্মী বাহিনী, রোগীর পরিবার ও সম্পৃক্ত মানুসগুলোর সাহায্যে তাঁর মানসিক আধ্যাত্বিক ও সামাজিক বেদনাগুলোকে নির্ধারণ করে প্রশমিত করায় সচেষ্ট হন। অন্য ভাবে বলা চলে, অনিরাময়যোগ্য ব্যাধিটির নিরাময়ের ব্যর্থ চেষ্টায় আবেগ তাড়িত হয়ে; অর্থ, শ্রম ও সময়ের অপচয় না করে বরং যৌক্তিকও পরিকল্পিত পদক্ষেপের মাধ্যমে প্রিয় মানুসটির সামগ্রিক কষ্টগুলো কমিয়ে আনতে দরকার একটি পরিকল্পিত প্রশিক্ষণ ওদিকনির্দেশনা।
চিকিৎসা বিষয়ক অংশটুকু পুরনের জন্য চিকিৎসকের প্রয়োজন হলেওপ্যালিয়েটিভ কেয়ারের বাকি তিনটি বিষয়ঃ ‘আধ্যাত্মিক, মানসিক ও সামাজিক’ দিক নিয়ে যে কাজগুলো আছে, সেগুলোর জন্য পরিবার ও সমাজের সদস্যগনের সহযোগিতা অনেক বেশী প্রয়োজনীয়।ভাল-মন্দ রান্নার খানিকটা পাশের বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আনন্দ ভাগাভাগি করার মত হাজারো আবেগি সামাজিক চর্চায়পরিপূর্ণ বাংলাদেশের ‘এলাকাভিত্তিক সংস্কৃতি’। প্যালিয়েটিভ কেয়ারের কার্যকারীতায়বাংলাদেশের প্রথাগত এই সামাজিক ও পারিবারিক বন্ধনটিকে রোগীর সামাগ্রীক মননে সাহস যোগাতে কাজে লাগনো যেতে পারে।
‘মৃত্যু’ মানুষের আধ্যাত্মিক চেতনাতে অনেক প্রভাব ফেলে; কেউ ধর্মীয় চর্চার মধ্যে আত্মার প্রশান্তি খুজেন, আবার কেউ বা সম্পূর্ণ নতুন কোন চেতনায় নিজের মানসিক অবস্থাকে প্রশমিত করতে সমর্থ হয়ে থাকেন। তাই প্যালিয়েটিভ কেয়ার রোগীর আধ্যাত্মিক মননের পরিসরকে বিশেষভাবে পরিপূর্ণ চিকিৎসাব্যবস্থার আওতাভুক্ত কোরেএই বিষয়েও রোগীকে কিভাবে সহায়তা করা যায়, তার ওপর সচেতন ভাবে কাজ করে থাকে।এক কথায় কেবল চিকিৎসক নন বরং সবার সামগ্রিক স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে এটি একটি সম্পূর্ণ চিকিৎসা সেবা।
প্রায়োগিক সমস্যা / চ্যালেঞ্জসমূহ
যুগ যুগ ধরে মৃত্যু পথ যাত্রা নিয়ে প্রচলিত দৃষ্টিভঙ্গি বদলে নতুন করে, নতুন আঙ্গিকে সমাজকে ভাবতে শেখানো কোন সহজ কাজ নয় । এরজন্য প্রয়োজন, প্রশমিত সেবাদান বা প্যালিয়াতিভ কেয়ার সম্পর্কে ছোটো ছোটো এলাকা বা পাড়া ভিত্তিক গন সচেতনতার মাধ্যমে সামজিক জাগরন সৃষ্টি । কেননা, প্যালিয়েটিভ কেয়ারে মনে করা হয়; চিকিৎসকের তদারকিতে সচেষ্ট হয়ে শারীরিক যন্ত্রণাকে প্রশমিত করার কাজটিকরা হলেও, রোগীকে ঘিরে আবর্তিত পরিবারের সদস্যবৃন্দ ও সামাজিক পক্ষগুলোর সামগ্রিক সহায়তায়; রোগীর মানসিক সামাজিক ও আধ্যাত্মিক বা ধর্মীয় চেতনার জায়গাগুলোকে আশ্বস্ত করে তার অন্তিম যাত্রাটিকে সহজও প্রশমমিত করনঅত্যন্ত জরুরি।
শারীরিক যন্ত্রণা প্রশমনে রোগীকে প্রয়োজনমতো চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হয়। সে ক্ষেত্রে প্রয়োজন, প্যালিয়েটিভ কেয়ারের প্রাতিষ্ঠানিক সেবামূলক অবকাঠামো। সেদিক থেকে ‘প্যালিয়েটিভ কেয়ার সুবিধা’ প্রয়োজন অনুযায়ী এখনো ভীষণ অপ্রতুল ও প্রাথমিকপর্যায়ে বিচরন করছে। তথাপি কয়েকটি স্থানে এলাকাভিত্তিক পাইলট প্রজেক্ট হিসেবে প্যালিয়েটিভ সেন্টার স্থাপন করে ব্যাপক সাড়া মেলে এবং বাস্তব পেক্ষাপটে এর উপকারিতা অনেকের কাছে উন্মোচিত হয়। নারসিং ডিপ্লোমা, বা ট্রেনিং, গ্রাজুয়েট ও পোস্ট গ্রাজুয়ট শিক্ষাক্রমগুলোতে প্যালিয়েটিভ কেয়ার একটি বিশেষ পাঠ্যক্রম রূপে সংযুক্ত থাকলে চিকিৎসা পর্যায়ে প্যালিয়েটিভ সেবা সহজ হতো। নিকটবর্তী স্বাস্থ্যকেন্দ্রে প্যালিয়েটিভ পরিচর্যা ব্যবস্থাপনার একটি বিভাগ থাকলে সেখান থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চিকিৎসক এবং সেবাদানকারীরা এলাকাভিত্তিক পর্যায়ে সেবা করতে পারবেন। সেই সাথে এলাকা ভিত্তিক প্রশিক্ষন কেন্দ্রও দরকার।
আশায় বাঁধি ঘর
বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত নতুন এই চিন্তা ধারাটি এখনও মূলত জন সচেতনতা তৈরি পর্যায়ে আছে। বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলসহ সকল এলাকায় প্রশমন সেবা সম্পর্কে এবং যত সম্ভব প্রশিক্ষণের মাধ্যমে মানুষের মধ্যে ‘দুঃসহ যন্ত্রনার খারাপ মৃত্যু’ ও ‘প্রশমিত যন্ত্রণারভাল মৃত্যু’ সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা প্রদান করে সামাজিক সচেতনতা তৈরি করা অত্যন্ত জরুরী। ব্যাক্তিগত উদ্যোগে গড়ে ওঠা পাড়ার সমাজ সেবামূলক ছোটো ছোটো সংগঠন বা ক্লাবের যোগ্য ও উৎসাহী সদস্যদের স্বল্পমেয়াদী প্রশিক্ষন দিয়ে নিজ নিজ এলাকায় প্যালিয়েটিভ কেয়ার সংক্রান্ত ধারণাগুলো সম্পর্কে সামাজিক সচেতনতা তৈরি করা দরকার। সচেতনতা নিশ্চিত করতে পারলে থানা স্বাস্থ্যকেন্দ্রটির একটি অংশ জুড়ে প্যালিয়েটিভ কেয়ার বিভাগের সুবিধাপ্রাপ্তির ব্যবস্থার আবেদন করতে পারেন এলাকা জনপ্রতিনিধিরা। এভাবে ধীরে ধীরে এই প্যালিয়েটিভ কেয়ার বাবস্থাপনা সফলভাবে ছড়িয়ে পরবে। প্যালিয়েটিভ কেয়ার সারা বাংলাদেশের সমাজ ও নাগরিকগণের কাছে সহজলভ্য হয়ে উঠে চিকিৎসা বাবস্থ্যার এক নব দিগন্তের সূচনা হবে এই প্রত্যাশা সকলেরই।
লেখক পরিচিতিঃ সহকারী অধ্যাপক, স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়। প্যালিয়াটিভ কেয়ার সোসাইটি বাংলাদেশ-এর সদস্য।