ঢাকা, ১১ ডিসেম্বর ২০২৪, বুধবার, ২৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ৮ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিঃ

শরীর ও মন

তাপজনিত অসুস্থতা বা হিটস্ট্রোক কী কেন হয় এবং প্রতিরোধের উপায়

ডা. মো. বখতিয়ার
২৫ এপ্রিল ২০২৪, বৃহস্পতিবার

হিটস্ট্রোক: ইংরেজি পরিভাষায় হিটস্ট্রোক হলো একটি গুরুতর তাপজনিত অসুস্থতা। সাধারণত প্রচণ্ড রোদে বা গরমে শরীরে যে তাপজনিত গুরুতর অসুস্থতা সৃষ্টি হয় এটি আজ বহুল পরিচিত শব্দ হিটস্ট্রোক নামে পরিচিত। বর্তমানে বাংলাদেশে এই হিটস্ট্রোক অসুস্থতায় বহু লোক মৃত্যুবরণ করছে। তাই এই রোগ সম্পর্কে সচেতনতা জরুরি।  হিটস্ট্রোক তাদেরই হওয়ার বেশি সম্ভাবনা থাকে  যাদের   শরীরের তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের (১০৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট) বেশি হয়ে যায়। ত্বক লাল হয়ে যাওয়া, মাথাব্যথা, মাথা ঘোরা এবং বিভ্রান্তি।

প্রধান কিছু লক্ষণ-উপসর্গ: চিরাচরিত  হিটস্ট্রোকে  সাধারণত ঘাম হয় না, তবে পরিশ্রমজনিত  কারণে  শরীর থেকে ঘাম নিঃসৃত হয়।  হিটস্ট্রোক শুরু হঠাৎ করে বা ধীরে ধীরে হতে পারে।  হিটস্ট্রোক  জীবনের জন্য হুমকিস্বরূপ একট পরিস্থিতি, কারণ এরফলে বহুসংখ্যক অঙ্গ বিকল হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।  এই রোগে জটিলতার মধ্যে খিঁচুনি, ডুরেপেশি লোপ (র‌্যাবডোমায়োলাইসিস) ও বৃক্ক বৈকল্য খুবই সাধারণ।
পরিবেশের উচ্চ তাপমাত্রা এবং অথবা শারীরিক পরিশ্রমের কারণে তাপজনিত স্বাস্থ্য সমস্যা ঘটে। এটি সাধারণত চরম পরিবেশে অবস্থান করা ও পরিশ্রমমূলক কাজের জন্য বা দীর্ঘ সময় তাপের সংস্পর্শে থাকার জন্য ঘটে থাকে। তবে কিছু স্বাস্থ্যগত অবস্থাও হিটস্ট্রোক ঝুঁকি বাড়াতে পারে। বংশগত প্রবণতার কারণে কিছু রোগীর, বিশেষ কিছু শিশুর জন্য তুলনামূলকভাবে মৃদু পরিবেশ-পরিস্থিতিতেও আতপাঘাতের ঝুঁকিপ্রবণতা বেশি থাকতে পারে।
নিদর্শন ও লক্ষণ-উপসর্গ: হিটস্ট্রোক সাধারণত ৪০.৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসেরও বেশি তাপমাত্রাবিশিষ্ট অতিজ্বর (হাইপারথার্মিয়া) হিসেবে প্রকাশ পায়। তবে শরীরের তাপমাত্রা অত্যন্ত উচ্চ হলেই যে  হিটস্ট্রোক হয়েছে, এমনটি বলা যায় না।  হিটস্ট্রোকের চিরায়ত রূপটিতে সাধারণত ঘামের অভাব থাকে, তবে পরিশ্রমজনিত হিটে ঘাম উপস্থিত থাকতে পারে।
প্রাথমিক লক্ষণ: উপসর্গগুলোর মধ্যে রয়েছে আচরণগত পরিবর্তন, বিভ্রান্তি, প্রলাপ, মাথা ঘোরা, দুর্বলতা, শরীরের দুলুনি, কথাবার্তা জড়িয়ে আসা, বমি বমি ভাব এবং বমি। পরিশ্রমজনিত আতপাঘাতের কিছু কিছু ক্ষেত্রে খিঁচুনি এবং প্রস্রাব ও মলত্যাগ নিয়ন্ত্রণে অক্ষমতারও প্রতিবেদন পাওয়া গেছে। উপরন্তু পরিশ্রমজনিত আক্রান্ত ব্যক্তিরা অতিরিক্ত ঘামতে পারে। এক্ষেত্রে চিকিৎসা বিলম্বিত হলে রোগীদের অত্যাবশ্যকীয় অঙ্গসমূহের ক্ষতি, চেতনালোপ এবং এমনকি অঙ্গবৈকল্য ঘটতে পারে। অবিলম্বে পর্যাপ্ত চিকিৎসার অভাবে আতপাঘাত মারাত্মক রূপ ধারণ করতে পারে।

কারণসমূহ: হিটস্ট্রোক তখনই ঘটে যখন শরীরের তাপনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা অতিরিক্ত বিপাকের ফলে উৎপন্ন তাপ, বাহ্যিক পরিবেশে অত্যধিক তাপ অথবা শরীর তাপ হারাতে ব্যর্থ হওয়ার জন্য অনিয়ন্ত্রিত হয়ে যায়। অ্যালকোহল, উদ্দীপনা, কিছু ওষুধ এবং জরাগ্রস্ততা আতপাঘাতকে ত্বরান্বিত করে।
যখন বাইরের পরিবেশের তাপমাত্রা ২১ ডিগ্রি সেলসিয়াস থাকে, তখন সরাসরি সূর্যালোকে দাঁড় করিয়ে রাখা মোটরগাড়ির অভ্যন্তরের তাপমাত্রা দ্রুত ৪৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়ে যেতে পারে। ফলে যেসব অল্পবয়সী শিশু বা অধিক বয়স্ক ব্যক্তি ঐসব মোটরযানে একা বসে থাকে, তাদের আতপাঘাতে আক্রান্ত হওয়ার বিশেষ ঝুঁঁকি থাকে। শিশু এবং অধিক বয়স্কদের মধ্যে আতপাঘাত কয়েক মিনিটের মধ্যে ঘটতে পারে, এমনকি যদি গাড়ির জানালা সামান্য খোলাও থাকে। যেহেতু এই ধরনের ব্যক্তিরা নিজ থেকে গাড়ির দরজা খুলতে পারে না বা বন্ধ গাড়িতে থেকে উচ্চগলায় বাইরের লোকের আছে তাদের অস্বস্তি প্রকাশ করতে পারে না, তাই তাদের দুর্দশা আশপাশের লোকজন অবিলম্বে বুঝতে পারে না।
গাড়িতে বন্দি কুকুরদের  আক্রান্ত হবার ঝুঁকি মানুষের চেয়েও বেশি। কেননা, তারা সারা দেহ ঘামিয়ে নিজেদের শীতল রাখতে পারে না। একারণে গরমের দিনগুলোতে কুকুরদেরকে বাসায় রেখে আসতে ও তাদেরকে প্রচুর পানি পানের সুযোগ দিতে সুপারিশ করা হয়। আর যদি কোনো কুকুরকে সঙ্গে আনতেই হয়, তাহলে সেটিকে কোনো ছায়াযুক্ত স্থানে দড়ি বেঁধে রেখে দিতে হয় ও একটি পূর্ণ করা পানির পাত্র সঙ্গে দিতে হয়।

সায়েন্টিফিক ধরন: এই রোগের শারীরবৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা হলো এরূপÑ প্রথমে দেহের উপরে তাপের তীব্র ভার সৃষ্টি হয়, এরপর দেহের তাপনিয়ন্ত্রক কার্যপদ্ধতিগুলো বিকল হয়ে পড়ে। বিশেষ করে  হিটস্ট্রোকের কারণের দেহে প্রদাহজনিত ও রক্ততঞ্চনজনিত প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়, যার কারণে রক্তপ্রবাহ নালীগুলোর অন্তঃআবরণী কলা (ভাস্কুলার এন্ডোথেলিয়াম) ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এরফলে রক্তের অণুচক্রিকাগুলেেিত (প্লাটিলেট) বহুসংখ্যক জটিলতার সৃষ্টি হয়। যেমন অণুচক্রিকার সংখ্যা হ্রাস পায়, সেগুলো জমাটবদ্ধ হতে শুরু করে এবং অস্থিমজ্জা থেকে নিঃসরণ অবদমিত হয়ে যায়।
দেহের ভেতরে  হিটস্ট্রোকের দ্বিতীয় যে একটি ক্রিয়াপথের পক্ষে প্রমাণ ভারী হচ্ছে, সেটি হলো উত্তাপ ও শারীরিক পরিশ্রমের কারণে রক্তাভ্যন্তরে বিষক্রিয়া (এন্ডোটক্সিমিয়া)। যদিও এই ক্রিয়াপদ্ধতিটি সম্পূর্ণ অনুধাবন করা সম্ভব হয়নি, তা সত্ত্বেও এই প্রতিমানে (মডেল) অনুমান করা হয় যে চরম শারীরিক পরিশ্রম ও তাপের কারণে আন্ত্রিক শ্লৈষিক প্রতিবন্ধকটি ক্রিয়া বিঘ্নিত হয় ও সেটি অধিকতর ভেদ্য হয়ে পড়ে, ফলে অন্ত্রে অবস্থিত গ্রাম-ঋণাত্মক ব্যাকটেরিয়াগুলো দ্বারা উৎপাদিত লাইপোপলিস্যাকারাইড অণুগুলো রক্ত সঞ্চালন ব্যবস্থায় প্রবেশ করে। রক্তে লাইপোপলিস্যাকারাইডের উচ্চ ঘনমাত্রা একটি তন্ত্রব্যাপী প্রদাহজনিত প্রতিক্রিয়া সংরক্ষণ (ঝুংঃবসরপ রহভষধসসধঃড়ৎু ৎবংঢ়ড়হংব ংুহফৎড়সব সিস্টেমিক ইনফ্লেমেটরি রেসপন্স সিন্ড্রোম) উসকে দিতে পারে এবং এর পরিণতিতে জীবাণু দূষণ ও এরসঙ্গে সংশ্লিষ্ট অন্যান্য পরিণাম যেমন রক্ত জমাটবাঁধা, বহু-অঙ্গ বৈকল্য, দেহকলার মৃত্যু ও কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের ক্রিয়াবিকার ঘটতে পারে।

রোগ নির্ণয়: হিটস্ট্রোক নির্ণয়ের জন্য সাধারণত নিম্নলিখিত পরীক্ষাগুলো সম্পাদন করা হয় (তবে এই তালিকাটি সম্পূর্ণ নয়):
ক্সপূর্ণ রক্তগণনা পরীক্ষা (কমপ্লিট ব্লাড কাউন্ট, সিবিসি);
ক্সপ্রোথ্রম্বিন সময়/আংশিক থ্রম্বোপ্লাস্টিন সময় (প্রোথ্রম্বিন সময় বা পিটি এবং পার্শিয়াল থ্রম্বোপ্লাস্টিন টাইম বা পিটিটি);
রক্তের গ্যাস পরীক্ষা (ব্লাড গ্যাস টেস্ট);
ক্সপ্রস্রাব পরীক্ষা (ইউরিন টেস্ট)।

প্রতিরোধ: অতিরিক্ত গরম এবং পানিশূন্যতা এড়ানোর জন্য সাবধানতা অবলম্বন করে  (হিটস্ট্রোক) ঝুঁকি হ্রাস করা যেতে পারে। হালকা, ঢিলেঢালা পোশাক পরলে শরীরের ঘাম বাষ্পীভূত হওয়ার সুযোগ পায় এবং এভাবে শরীর শীতল থাকে। হালকা রঙের চ্যাপ্টা বড় টুপি সূর্যের উত্তাপ থেকে মাথা ও ঘাড় উত্তপ্ত হওয়া রোধ করতে সহায়তা করে। গরম আবহাওয়ার সময় কঠোর ব্যায়াম করা পরিত্যাজ্য। পাশাপাশি সূর্যের প্রচণ্ড দাবদাহের সময় শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ বা পর্যাপ্ত বায়ুচলাচলের সুবিধাযুক্ত স্থান ব্যতীত যেকোনো বদ্ধ স্থানে অবস্থান (যেমন মোটরগাড়ির ভেতরে থাকা) এড়িয়ে চলা উচিত।
শরীর দ্রুত ঠাণ্ডা করে এবং সার্বিক যত্নের মাধ্যমে  হিটস্ট্রেকের চিকিৎসা করা হয়। অন্যান্য প্রস্তাবিত চিকিৎসা পদ্ধতিগুলোর মধ্যে রয়েছে ভুক্তভোগী ব্যক্তির দেহে পানি ছিটানো, তাকে পাখা দিয়ে বাতাস করা, বরফশীতল পানিতে নিমজ্জিত রাখা, ইত্যাদি। অবস্থা গুরুতর হলে দ্রুত নিকটস্থ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া ও যথাযথ চিকিৎসা করানো।

লেখক: জনস্বাস্থ্য গবেষক এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক খাজা বদরুদদোজা মডার্ন হাসপাতাল সফিপুর, কালিয়াকৈর, গাজীপুর।
 

শরীর ও মন থেকে আরও পড়ুন

   

শরীর ও মন সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status