শরীর ও মন
লিভার ফেইলিউর চিকিৎসায় স্টেম সেল থেরাপি
অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীল
২০ এপ্রিল ২০২৪, শনিবারগত ১৪ই মার্চ ২০২২ইং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারভেনশনাল হেপাটোলজি বিভাগে
একজন লিভার সিরোসিস রোগীকে অটোলোগাস হেমোপয়েটিক স্টেম সেল ট্রান্সপ্লান্টেশনের মাধ্যমে চিকিৎসা করার মধ্যদিয়ে বিশ্ববিদ্যালটিতে আনুষ্ঠানিকভাবে লিভার রোগীদের চিকিৎসায় স্টেম সেল থেরাপির সূচনা হলো। উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ হেপাটোলজি বিভাগে আনুষ্ঠানিকভাবে এই কার্যক্রমের উদ্বোধন করেন। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারভেনশনাল হেপাটোলজি ডিভিশনের প্রতিষ্ঠাতা প্রধান হিসেবে আমি নিজে ডিভিশনটির কার্যক্রম ও লিভার সিরোসিসের চিকিৎসায় স্টেম সেল থেরাপির ব্যবহার ও এ সম্বন্ধে তাদের অভিজ্ঞতা তুলে ধরি। উল্লেখ্য, আমি ও আমার সঙ্গে একদল লিভার বিশেষজ্ঞ ২০১৮ সাল থেকে বাংলাদেশে লিভার সিরোসিস রোগীদের চিকিৎসায় নিয়মিতভাবে, সাফল্যের সঙ্গে স্টেম সেল থেরাপি প্রয়োগ করে আসছি। এ পর্যন্ত প্রায় দুই শতাধিক লিভার সিরোসিস রোগী স্টেম সেল থেরাপির মাধ্যমে উপকৃত হয়েছেন। জানার প্রয়োজন কখন একজন লিভার রোগীর স্টেম সেল থেরাপির প্রয়োজন কেন হয় এবং এই পদ্ধতির প্রক্রিয়াটি কী?
সাধারণভাবেই লিভারের কার্যকারিতা শেষ হয়ে গেলে রোগী ও তার আত্মীয়স্বজনের মাঝে উদ্ধেগ দেখা দেয়। ভাইরাল হেপাটাইটিসের মতো একিউট কন্ডিশন বা লিভার সিরোসিসের মতো ক্রনিক ব্যাধি এ দুই ধরনের রোগের ক্ষেত্রেই রোগীদের লিভার ফেইলিউর দেখা দিতে পারে। লিভার ফেইলোর হলো লিভারের সবচেয়ে জটিল সমস্যাগুলোর একটি। লিভার ফেইলিউরে মৃত্যুর ঝুঁকি একিউট ও ক্রনিক লিভার রোগের ক্ষেত্রে একেক রকম; কিন্তু কোনো ক্ষেত্রেই তা বিন্দুমাত্র কম আশঙ্কাজনক নয়। একিউট লিভার ফেইলিউরে যেখানে মৃত্যুর ঝুঁকি ষাট শতাংশ বা তার কাছাকাছি, ক্রনিক ফেইলিউরের ক্ষেত্রেও তা পঞ্চাশের আশপাশে।
এখন পর্যন্ত লিভার ফেইলিউরের সবচেয়ে ব্যয়বহুল চিকিৎসা লিভার ট্রান্সপ্লান্টেশন, তবে নানা কারণেই তা অনেক জটিল। একজন রোগীর ট্রান্সপ্লান্টেশন করতে হলে আত্মীয়ের মধ্যে একজন ডোনারের প্রয়োজন হয়, যা জোগাড় করা সব সময় সম্ভব নয়। বিশেষ করে এটি একিউট লিভার ফেইলিউরের ক্ষেত্রে অনেক বেশি প্রযোজ্য, কারণ এক্ষেত্রে সময় পাওয়া যায় খুবই কম। বাংলাদেশে এই মুহূর্তে লিভার ট্রান্সপ্লান্টেশনের বিশেষ কোনো সুবিধা নেই। এমনকি ভারতেও এই চিকিৎসা যথেষ্ট ব্যয়বহুল যা আমাদের মধ্যবিত্তদের নাগালের বাইরে।
লিভার ফেইলিওর হলো লিভার তার সম্পূর্ণ কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলা। তবুও রোগীরা বেঁচে থাকার আশায় থাকে। এ বিষয়গুলো সামনে রেখে ও লিভার ট্রান্সপ্লান্টের মতো ব্যয়বহুল দিক বিবেচনা করে অনেক দিন ধরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে, স্টেম সেল থেরাপি এসব ক্ষেত্রে নতুন সম্ভাবনার সৃষ্টি করেছে। শুধু লিভার ফেইলিউরেই নয়, টাকে চুল গজানো থেকে শুরু করে হাঁটুর ব্যথা আর হার্ট ফেইলিউর, এমন অনেক রোগেই এর যথেষ্ট প্রয়োগ রয়েছে। বাংলাদেশে অবশ্য স্টেম সেল থেরাপির কনসেপ্টটি একবারেই নতুন, বিশেষ করে লিভার ফেইলিউরের চিকিৎসায় তো বটেই।
স্টেম সেল থেরাপির জন্য জিসিএসএফ এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ ওষুধ, যা ব্যবহার করা হলে রক্তে স্টেম সেলের
সংখ্যা শতগুণে বেড়ে যায়। ওই স্টেম সেলগুলোই প্রবাহিত রক্তের মাধ্যমে টার্গেট অর্গানে পৌঁছে এটির রি-জেনারেশনে সাহায্য করে।
জিসিএসএফ ব্যবহার করে লিভার ফেইলিউরের এ ধরনের চিকিৎসা বহুল প্রচলিত না হলেও একেবারে নতুন নয়।
নয়াদিল্লির ইনস্টিটিউট অব লিভার অ্যান্ড বিলিয়ারি সায়েন্সেস এবং স্যার গঙ্গারাম হাসপাতালে এভাবে চিকিৎসা
করা হয়ে থাকে এবং সম্প্রতি টাইমস অব ইন্ডিয়ায় এ সম্পর্কে একটি রিপোর্টও প্রকাশিত হয়েছে।
এই চিকিৎসায় রক্ত থেকে জিসিএসএফ প্রয়োগের ফলে বেড়ে যাওয়া স্টেম সেলগুলোকে বিশেষ পদ্ধতিতে আলাদা করে নেয়া হয়, অনেকটা ছেঁকে নেয়ার মতো করে। এরপর আমরা ক্যাথ ল্যাবে এনজিওগ্রামের মাধ্যমে ওই স্টেম সেলগুলো সরাসরি হেপাটিক আর্টারি দিয়ে লিভারে ইংজেক্ট করা হয়।
আমরা একই পদ্ধতিতে লিভার ক্যান্সার চিকিৎসায় এদেশে প্রথমবারের মতো ট্রান্স-আর্টারিয়াল কেমো
এম্বোলাইজেশন বা টেইস চালু করি, যা এই প্রাণঘাতী ক্যান্সারের চিকিৎসায় আধুনিকতম পদ্ধতি।
আমাদের স্টেম সেল থেরাপি চিকিৎসা পদ্ধতির অভিনবত্ব হচ্ছে যে, আমরা ক্যাথ ল্যাবে এনজিওগ্রামের মাধ্যমে
সরাসরি লিভারে স্টেম সেল থেরাপি করছি, যা পৃথিবীতে এই প্রথম। স্টেম সেলগুলো আক্রান্ত অর্গান অর্থাৎ লিভারের যত কাছাকাছি এবং সরাসরি প্রয়োগ করা যাবে, তাতে সাফল্যের সম্ভাবনাও ততই বেশি। আর তাই এদেশে লিভার ফেইলিউরের চিকিৎসায় স্টেম সেল থেরাপি শুধু প্রথমবারের মতো চালু করার জন্যই নয়, বরং লিভারে তা প্রয়োগের অভিনবত্বের জন্যও এদেশের এই কৃতী হেপাটোলজিস্টরা প্রশংসার দাবিদার।
বাংলাদেশে বর্তমানে তিন কোটির ওপর রোগী হেপাটাইটিস বি, সি কিংবা ফ্যাটি লিভারের মতো জটিল লিভারের রোগে আক্রান্ত। পাশাপাশি হেপাটাইটিস এ এবং ই-এর মতো একিউট হেপাটাইটিস ভাইরাসগুলোর প্রকোপও এদেশে যথেষ্টই। প্রকাশিত তথ্য-উপাত্ত অনুযায়ী বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় ২০ হাজার লোক লিভার ফেইলিউর মৃত্যুবরণ করেন। আশার কথা হলো, স্টেমসেল থেরাপি ভবিষ্যতে অনেক অসহায় রোগীকেই মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরিয়ে আনবে।
লেখক: অধ্যাপক ও ডিভিশন প্রধান, ইন্টারভেনশনাল হেপাটোলজি ডিভিশন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় এবং আঞ্চলিক পরামর্শক, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। চেম্বার: ল্যাবএইড স্পেশালাইজড হাসপাতাল,
মিরপুর রোড, ধানমণ্ডি, ঢাকা। হটলাইন- ১০৬০৬।