ঢাকা, ২০ এপ্রিল ২০২৪, শনিবার, ৭ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

মত-মতান্তর

সেকালে বিদ্যাসাগর 'চুপ' আর একালে বুদ্ধিজীবীরা 'নীরব' কেন?

ড. মাহফুজ পারভেজ

(১ বছর আগে) ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২২, সোমবার, ৪:২২ অপরাহ্ন

সর্বশেষ আপডেট: ১০:২১ পূর্বাহ্ন

mzamin

১. বাংলা গদ্যের প্রথম সার্থক রূপকার, সমাজ সংস্কারক ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের জন্মবার্ষিকী আজ সোমবার (২৬ সেপ্টেম্বর)। আরও স্পষ্ট করে বললে, শুধু জন্মদিনই নয়, ২০২তম জন্মবার্ষিকীও বটে। ১৮২০ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুর জেলার বীরসিংহ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। মৎ প্রণীত 'দ্বিশত জন্মবর্ষে বিদ্যাসাগর' (ঢাকা: স্টুডেন্ট ওয়েজ, ২০২১) গ্রন্থে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে তাঁর সাহসী অবদানসমূহের পাশে 'চাঁদের কলঙ্কে'র মতো 'ক্ষেত্র বিশেষে চুপ থাকা'র প্রসঙ্গগুলোও আলোচিত হয়েছে। সেকালে বিদ্যাসাগরের মতো 'সরব' বুদ্ধিজীবীর 'চুপ' থাকার সূত্র ধরে 'আজকের বুদ্ধিজীবীরা নীরব কেন', তার সদুত্তর খোঁজার চেষ্টা করা যেতে পারে।

২. জন্মের দ্বি-শতাধিক বর্ষে মতো তাঁর প্রয়াণেরও ১৩২ বছর পেরিয়ে গিয়েছে।  হাজার বছরের বাংলা ও বাঙালির ঐতিহ্যে টানা দুইটি শতাব্দী ধরে সামাজিক-সাংস্কৃতিক চিন্তায় ও মননচর্চায় তাঁর মতো সগৌরবে বিরাজমান ব্যক্তিত্ব বিরল। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর সেই অত্যল্প কীর্তিমান বাঙালির একজন, যিনি রাজনৈতিকভাবে বিভাজিত বঙ্গসমাজে দ্বিশত জন্মবর্ষেও সমুজ্জ্বল এবং ‘বিবিসি’ পরিচালিত সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালির তালিকায় অষ্টম স্থানের অধিকারী। বিদ্যাসাগরকে কেবল বিদ্যা ও দয়ার আধার বলে স্বীকৃতি দেওয়াকে রবীন্দ্রনাথ যথেষ্ট মনে করেন নি। তাঁর মতে বিদ্যাসাগরের ‘প্রধান গৌরব তাঁর অজেয় পৌরুষ ও মনুষ্যত্ব’। আশ্চর্যের বিষয় হলো, সেই বিদ্যাসাগরও ভয়ানক অন্যায় ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে চুপচাপ থেকেছেন, যা তাঁর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যহীন।

৩. ইতিহাসের বিবরণে লিপিবদ্ধ রয়েছে যে, ১৮৫৭ সালের ২৯ মার্চ কলকাতার সন্নিকটস্থ ব্যারাকপুরে মঙ্গল পান্ডে ঔপনিবেশিক শাসকদের উপর গুলি চালালেন, ৬ এপ্রিল ফাঁসি হল তাঁর। বাংলা বা কলকাতায় বিশেষ কোনো প্রতিক্রিয়া না হলেও আগুন জ্বলল অনেক দূরে, মিরাটে, শুরু হল সিপাহি বিদ্রোহ।

বিজ্ঞাপন
সে যুগে রেডিয়ো ছিল না, খবরের কাগজের প্রচারও ছিল সীমিত। কিন্তু এই বিদ্রোহের খবর ছড়িয়ে পড়েছিল সারা বিশ্বে। জার্মানিতে কার্ল মার্ক্স সাগ্রহে বিদ্রোহের গতিপ্রকৃতির উপর নজর রাখছিলেন, লিখছিলেন তা নিয়ে। ৩০ জুন, ১৮৫৭ নিউ ইয়র্ক ডেলি ট্রিবিউন-এ লিখলেন, এই প্রথম ভারতবাসী সম্মিলিত ভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলছে। তিনি বিদ্রোহের নাম দিলেন ভারতের 'প্রথম স্বাধীনতার সংগ্রাম'। বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী ডিজ়রেলি পার্লামেন্টে প্রশ্ন করেছিলেন, ভারতে যা হচ্ছে তা কি ‘মিউটিনি’, না জাতীয় বিপ্লব? তাঁর এই কথা উদ্ধৃত করে ২৮ জুলাই মার্ক্স লিখলেন, এ লড়াই নিছক সেনাবাহিনীর মিউটিনি নয়, এ এক বিদ্রোহ যা শুরু হয়েছে জাতীয় স্তরে। 

৪. সিপাহী বিদ্রোহের বিষয়ে তৎকালের চিন্তানায়কদের অধিকাংশই চুপ ছিলেন। পক্ষে-বিপক্ষে কেউ কেউ মুখ খুলেন। বিপক্ষের দল ছিল বেশ ভারী, তাঁদের মধ্যে ছিলেন দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, ঈশ্বর গুপ্ত, যদুনাথ সর্বাধিকারী, রজনীকান্ত গুপ্ত প্রমুখ। বিস্ময় জাগে, বিদ্যাসাগর এই বিদ্রোহ নিয়ে কোথাও কিছু লেখেননি। যে মানুষটি নিজের জীবন তুচ্ছ করে, সংস্কৃত কলেজের চাকরি হেলায় ছেড়ে তৎকালীন বাবু সমাজ ও পণ্ডিতদের বিরুদ্ধে গিয়ে বিধবাবিবাহ আইন পাশ করিয়েছেন এবং বহুবিবাহ রোধ আইন পাশের জন্য লড়ছেন, তিনি এ বিদ্রোহ সম্বন্ধে নীরব। বিদ্যাসাগর বৃটিশ শাসকের স্তাবক ছিলেন না, খেতাবের জন্য লালায়িত ছিলেন না। দেশাত্মবোধ তাঁর কিছু কম ছিল না, তা হলে তিনি চুপ থাকলেন কেন?

৫. বিদ্যাসাগর আলোর পথযাত্রী, তাঁর সংগ্রাম ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে তো বটেই, সব রকম অন্ধকারের বিরুদ্ধে। সিপাহি বিদ্রোহ শুরুর এবং তার অনেক পরেও দেশে জাতীয়তাবাদের উন্মেষ হয়নি। এই বিদ্রোহের তাৎক্ষণিক কারণ ছিল ধর্মীয়, হয়তো সে কারণে বিদ্যাসাগর এ বিদ্রোহ সম্পর্কে নীরব ছিলেন। ভুললে চলবে না, এর ঠিক আগের বছর, ১৮৫৬ সালে পাশ হয়েছে বিধবাবিবাহ বিল, দীর্ঘ লড়াইয়ের পর। এবং তা পাশ করেছে বৃটিশ সরকার। শুধু তা-ই নয়, কুলীন ব্রাহ্মণদের বহুবিবাহ রদের প্রস্তাব দিয়ে বিদ্যাসাগর ১৮৫৭ সালেই পিটিশন জমা দিয়েছেন বৃটিশ সরকারের কাছে। এত কিছুই যদি হয়ে থাকে, তবে বিদ্যাসাগর এই বিদ্রোহের বিরোধিতা করলেন না কেন? 

৬. করেননি, যদিও তিনি বৃটিশের অত্যাচারের ব্যাপারে অবগত ছিলেন পুরো মাত্রায়। তাঁর মতো সমাজসংস্কারকের পক্ষে নীরব থাকাটা রহস্যঘেরা। তিনি ঠিক কাজ করেছিলেন না কি ভুল, সে অন্য প্রশ্ন, অনেক ইতিহাসবিদও এই নীরবতার জন্য পরবর্তী কালে বিদ্যাসাগরের সমালোচনা করেছেন। সে বিতর্ক আজও চলছে। বুদ্ধিজীবীর নীরবতাও অপরাধের তুল্য। কারণ, তাঁর অবস্থান ও যোগ্যতা তাঁকে সামাজিক দায়িত্ব পালনের পথে চালিত করবেই। তিনি মামুলী আমজনতা'র কেউ নন যে, তাঁর চোখ বন্ধ থাকলে কোনো সমালোচনা হবে না।

৭. সেকালের মতো একালেও অনেকেই অনেক কিছু দেখেও নীরব আছেন। তাঁরা সব কিছুতেই চোখ বুজে আছেন বা সমর্থন করছেন। তাঁরা চুপ করে আছেন মূলত ক্ষমতাধর শক্তির ভয়ে কিংবা অনুগ্রহ প্রাপ্তির লোভে। কিন্তু অন্যায়, অসঙ্গতি, নির্যাতন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে উপযুক্ত প্রতিবাদ না করলে তা প্রকারান্তরে অপশক্তির সহায়তার নামান্তর। এমন অন্ধ ও বোবা বুদ্ধিজীবীদের ইতিহাস ক্ষমা করে না। বহু কৃতিত্বের পরেও বিদ্যাসাগরকে আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড় করায়।

৮. প্রতিদিন সকলের সামনে উপস্থাপিত প্রচারমাধ্যম জুড়ে থাকা খবরগুলোর অধিকাংশই ক্ষমতা বা ক্ষমতা-ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিদের অন্যায়, দুর্নীতি, অনিয়মকে কেন্দ্র করে। ক্যাসিনো থেকে ইডেন কলেজ, নানা দপ্তর থেকে দলের কার্যক্রমে পাণ্ডাদের দৌরাত্ম্য সর্বজনবিদিত। এসব বিষয় বুদ্ধিজীবীদের নজরের বাইরের কোনও গুপ্ত তৎপরতা নয়। তারপরেও বিদ্বজ্জন বুদ্ধিজীবীরা নীরব কেন? তাঁদের নীরবতার কারণে একালে বুদ্ধিজীবী শব্দটির অর্থের অপকর্ষ ঘটেছে, যা কাম্য ছিল না। বুদ্ধিজীবী বলতে একটা কাল্পনিক বন্ধনী তৈরি হয়েছে, যার মধ্যে আছেন শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক, শিল্পী, সাহিত্যিক, চলচ্চিত্রকার, নাট্যব্যক্তিত্ব, অভিনেতা প্রমুখ। ঢাকার ইতিহাসে বিভিন্ন ইস্যুতে এই শ্রেণির মানুষের রাস্তায় নামার কিংবা বক্তৃতা-বিবৃতি দেওয়ার ঘটনা বার বার ঘটেছে। সেসব প্রতিবাদে 'মানুষের জন্য রাজনীতি' থাকত, কোনও 'রাজনৈতিক পতাকা' থাকত না। বিগত বছরগুলোতে বিচ্ছিন্ন কিছু তৎপরতা ছাড়া সে রকম বড় আকারের কোনও প্রতিবাদ দেখা যায় নি, যা দেখে অন্যায়ের বিরুদ্ধে আশাবাদী হতে পারতো সাধারণ মানুষ। 

৯. বলা হচ্ছে, বুদ্ধিজীবীরা এখন সরকারি অনুগ্রহ লাভের আশায় নিজেদের বিকিয়ে দিয়েছেন। কেউ কেউ সামান্য কিছু প্রাপ্তির বিনিময়ে আত্মবিসর্জন দিচ্ছেন। খুব কম দামে বিক্রি হচ্ছে বুদ্ধিজীবীদের বিবেক। যদিও সবাইকে এক দলে ফেলা ঠিক নয়, তথাপি মূল প্রবণতা এমনই।

১০. সেকালে বিদ্যাসাগর কিংবা তৎকালের অপরাপর বুদ্ধিজীবী রামমোহন প্রমুখ বৃটিশ সরকারের অনুগত ছিলেন। বৃটিশ প্রভুদের খুশি করতে গিয়ে তাদের অন্যায়, অত্যাচারের বিষয়ে চুপ ছিলেন তাঁরা। কিন্তু তাঁরাই আবার বৃটিশদের খুশি করে সতীদাহপ্রথা রদ ও বিধবাবিবাহ চালু করেন। তাঁদের আনুগত্য ও নীরবতা ব্যক্তিগত লাভের আশায় ছিলনা, ছিল তাঁদের সমাজ ও ধর্মীয় সংস্কারের বৃহত্তর স্বার্থে। একালের বুদ্ধিজীবীদের নীরবতার পেছনে তেমন কোনও বৃহত্তর স্বার্থচিন্তা নেই। আছে ক্ষুদ্র স্বার্থ ও ব্যক্তিগত লাভের হিসাবপত্র। পার্থক্যটা এখানেই।

ড. মাহফুজ পারভেজ, অধ্যাপক-বিশ্লেষক।

মত-মতান্তর থেকে আরও পড়ুন

   

মত-মতান্তর সর্বাধিক পঠিত

নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী সবদলই সরকার সমর্থিত / ভোটের মাঠে নেই সরকারি দলের প্রতিদ্বন্দ্বী কোনো বিরোধীদল

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status