শেষের পাতা
শতাধিক এজেন্টের টাকা লুট করে মাসুদ একাই
শুভ্র দেব
২০ সেপ্টেম্বর ২০২২, মঙ্গলবার
দেখতে হ্যান্ডসাম। পরনে অভিজাত পোশাক। যাতায়াত দামি মোটরসাইকেলে। থাকেন বিলাসবহুল ফ্ল্যাটে। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ফ্ল্যাটটিতে দামি দামি ফার্নিচার। চলাফেরা সমাজের বিত্তবান ও প্রভাবশালীদের সঙ্গে। এসএসসি পর্যন্ত লেখাপড়া করলেও নির্দিষ্ট কোনো পেশা নেই। দিন রাতের বেশির ভাগ সময়ই পাড়া মহল্লার অলিগলিতে ঘুরে বেড়ানোই কাজ। ঘুরে ঘুরে প্রতারণার রেকি করা। বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জের বাসিন্দা মাসুদ দৃশ্যমান কোনো কাজ না করলেও প্রতারণার কাজে পারদর্শী।
ডিবির তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, অভিনব কায়দায় মাসুদ প্রতারণা করে। এর আগে বিকাশ প্রতারণার যত কাহিনী ঘটেছে তার চেয়ে ভিন্ন কৌশলে মাসুদ টাকা লুট করে। তার প্রতারণা ছিল মিরপুরকেন্দ্রিক। দিন রাতের বেশিরভাগ সময় সে মিরপুরের বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে ঘুরে মোবাইল ব্যাংকিং এজেন্টদের দোকান রেকি করতো। দোকানে মালিক ছাড়া আর ক’জন কর্মচারী কাজ করে। তার টার্গেট থাকতো যেসব দোকানে মালিক বা কর্মচারী একাই দোকান চালান। ওইসব দোকান পেলেই তার কাজ শুরু করে দিতো। ক্রেতা সেজেই ওইসব দোকানে গিয়ে গোপন ভিডিও রেকর্ডার দিয়ে কৌশলে ওই এজেন্টের পিন নম্বর সংগ্রহ করে নিতো। লেনদেনের সময় অ্যাকাউন্টে কতো টাকা আছে সেটিও সম্ভব হলে জানার চেষ্টা করতো। তাছাড়া কোন কোম্পানির মোবাইল দিয়ে ওই ব্যক্তি এজেন্ট সিম চালান সেটিও রেকর্ড করতো। মোবাইলে কোনো কভার লাগানো আছে কিনা খেয়াল করতো। পরে ঢাকার গুলিস্তান থেকে কম দামে সেই মডেলের পুরাতন ভাঙাচুরা মোবাইল কিনতো। রেকি করা দোকানের মোবাইলে কভার লাগানো থাকলে কভারও নিতো। তারপর সুযোগ সুবিধামতো আবার ওই দোকানে যেতো। এবার ওই দোকানে থাকা অন্য কোনো পণ্য কেনার জন্য ব্যবসায়ীকে বলতো। ব্যবসায়ী যখন ওই পণ্যটা দেখানোর জন্য অন্যদিকে মনযোগ দিতেন তখনই মাসুদ তার কাছে থাকা মোবাইলটা রেখে দোকানের এজেন্ট ব্যবসার মোবাইলটা তার পকেটে নিতো। যে পণ্যটা ব্যবসায়ীকে দেখানোর কথা বলতো সেটি অনেক সময় কিনতো আবার অনেক সময় পছন্দ হয়নি বা ব্যবসায়ীর দাবিকৃত মূল্যের অনেক কমমূল্য বলে কৌশলে দোকান থেকে বেরিয়ে আসতো।
ডিবি জানায়, দোকান থেকে বেরিয়ে আসার কয়েক মিনিটের মধ্যে মাসুদ আগে থেকে মোবাইল সিম বিক্রেতাদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা একটিভ করা এবং সঙ্গে বিকাশ-নগদ অ্যাকাউন্ট খোলা সিমে টাকা ট্রান্সফার করে নিতো। টাকা ট্রান্সফার করে ওই ব্যবসায়ীর মোবাইল ফেলে দিতো। এমনকি যে সিমে ট্রান্সফার করতো ওই সিম থেকে টাকা নিয়ে ওই সিমও নিজের কাছে রাখতো না। এতে করে তাকে ধরার কৌশল থাকতো না। এভাবে টার্গেট করে শতাধিক ব্যবসায়ীর টাকা লুট করেছে। তাকে গ্রেপ্তারের পর তার দুটি সিমে ২ লাখ টাকা পাওয়া গেছে। এ রকম শতাধিক সিম তার কাছ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। এসব সিম মাসুদ সিম বিক্রেতাদের কাছ থেকে বেশি দামে সংগ্রহ করতো। কারণ একটিভ করা এসব সিমে বিকাশ, নগদ, রকেটসহ অন্যান্য মোবাইল ব্যাংকিং অ্যাকাউন্ট চালু থাকে। পাশপাশি বিক্রেতারা সিম বিক্রির সময় এসব অ্যাকাউন্টের পাসওয়ার্ডও দিতো।
মিরপুর মডেল থানায় করা মামলার এজাহারে ভুক্তভোগী মো. আসাদুজ্জামান বলেছেন, উত্তর পীরেরবাগ কামালের মোড় এলাকায় ইলেক্ট্রিক সামগ্রী, বিকাশ ইত্যাদির দোকান খুলে তিনি দীর্ঘদিন ধরে ব্যবসা করে আসছেন। প্রতিদিনের মতো ২রা সেপ্টেম্বর তিনি সকাল ৯টার দিকে দোকান খোলেন। ওইদিন সকাল ১০টার দিকে তার দোকানে অজ্ঞাতনামা ৩ ব্যক্তি দোকানে এসে লাইট দেখাতে বলে। তাদের একজনকে ১টি লাইট দেখানোর পরে আরেকজনও লাইট দেখানোর কথা বলে। পরে তিনি ওই ব্যক্তিকেও লাইট দেখান। অজ্ঞাতনামা ক্রেতাদের দুজনই দুটি লাইট তার দোকান থেকে কিনে নিয়ে যায়। তিনি আরও উল্লেখ করেন, লাইট দেখানোর সময় তিনি দোকানের ক্যাশ ছেড়ে অন্যদিকে ব্যস্ত ছিলেন। এই সুযোগে ওই ব্যক্তিরা টেবিলের উপর থেকে বিকাশ ও নগদ মোবাইল ব্যাংকিং কাজে ব্যবহৃত স্যামসাং জে-৭ মোবাইলটি নিয়ে যায়। ওই মোবাইলে বিকাশ ও নগদের এজেন্টের দুটি নম্বর চালু ছিল। তিনি বলেন, অজ্ঞাতনামারা তার ব্যবসায়িক কাজে ব্যবহৃত ফোনটি নিয়ে যাওয়ার সময় তার একই মডেলের আরেকটি মোবাইল রেখে যায়। তার ব্যবসায়িক মোবাইল না পেয়ে ওই ক্রেতাদের বিভিন্ন স্থানে খোঁজাখুঁজি করে। পরে আসাদুজ্জামান বিকাশ ও নগদ অফিসে ফোন করে জানতে পারেন দুটি সিমে থাকা ৭২ হাজার টাকা তুলে নেয়া হয়েছে।
ডিবি’র মিরপুর জোনাল টিমের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার সাইফুল ইসলাম মানবজমিনকে বলেন, মাসুদ দুই বছর আগে থেকে এজেন্টদের সঙ্গে প্রতারণা করছে এমন তথ্য পেয়েছি। শতাধিক সিম পেয়েছি তার কাছে। অনেক সিম নষ্ট করে দিয়েছে। ধারণা করছি মিরপুর এলাকার শতাধিক মোবাইল ব্যাংকিং এজেন্টদের এরকমভাবে প্রতারণা করে ঠকিয়েছে। প্রতারণার টাকায় বিলাস বহুল জীবনযাপন করতো। তিনি বলেন, রেকি করা থেকে শুরু করে সিম ও সেম মডেলের মোবাইল সংগ্রহ করতে ২/১ দিন সময় নিতো। কিন্তু টার্গেট দোকানে গিয়ে পণ্য কেনার নাটক ও মোবাইল পাল্টানো এবং এজেন্টের সিম থেকে টাকা ট্রান্সফারে সময় বেশি নিতো না। দ্রুততম সময়ের ভেতরে কাজ সারতো।
সাইফুল আরও বলেন, মোবাইল ব্যাংকিং ব্যবসা যারা করেন তাদের প্রতি আমাদের অনুরোধ তারা যখন পিন কোড দেন সেটি যেন লুকিয়ে দেন। কোনোভাবে যেন কেউ সেটি দেখতে না পারে। এছাড়া অপরিচিত ক্রেতা দোকানে এলে এবং গতিবিধি সন্দেহজনক মনে হলে সতর্ক থাকতে হবে।
মন্তব্য করুন
শেষের পাতা থেকে আরও পড়ুন

জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]