মত-মতান্তর
স্যার বললেন হাসপাতালের কেবিনই আমার রেগুলেটরি রিফর্ম কমিশন
কাজল ঘোষ
১০ সেপ্টেম্বর ২০২২, শনিবার
সামরিক জমানা। সময়টা ২০০৮ সাল। ফখরুদ্দীন সরকার তখন নানা ইস্যুতে জেরবার। বিশেষ করে চালের মূল্য নিয়ে। নিয়ন্ত্রণহীন বাজার। কোনো পদক্ষেপই কাজে আসছে না। একদিকে ঘরোয়া রাজনীতির অনুমতি মেলায় মাঠ সরব হচ্ছে। দু’দলই নির্বাচনী খেলার ওয়ার্মআপে তৈরি হচ্ছে। কমিশনের দৌড়ঝাঁপ চলছে সকল দলকে নিয়ে নির্বাচন আয়োজনে। একদিকে ট্রুথ কমিশন আর অন্যদিকে রেগুলেটরি কমিশন কাজ করছে।
অ্যাসাইনমেন্ট সমসাময়িক প্রসঙ্গ নিয়ে ড. আকবর আলি খানের সাক্ষাৎকার নিতে হবে। যেকোনো ইস্যুতেই স্যার সময় দেন, কথা বলেন। ফোন করতেই সময় দিলেন। বললেন, চলে আসেন সিআরপিতে। আমি আবারো জানতে চাইলাম, স্যার, সিআরপি। তিনি ফোনে ভরাট গলায় বললেন, হ্যাঁ, সিআরপি। মিরপুরের সিআরপি। আমি নির্ধারিত সময়ে সকাল দশটায় হাজির। রিসেপশনে স্যারের কাছে যেতে চাই বলতেই বলা হলো, আপনার কথা বলা আছে। চলে যান স্যারের কেবিনে। আমার কৌতূহল বাড়তে থাকে। বলেন কি? স্যার কি অসুস্থ? জ্বি! তিনি এখানেই ভর্তি আছেন বেশ কিছুদিন। আপনি কেবিনে গেলেই দেখতে পাবেন। আমি ভীষণ বিব্রত ও অস্বস্তি নিয়ে এগুচ্ছি, সিঁড়ি ভাঙছি। একটি বিষয় ভাবাচ্ছে আর স্যারের প্রতি শ্রদ্ধায় অবনত হয়ে আসছে মাথা। তিনি আসলেই একজন কাজ পাগল মানুষ, দায়িত্বশীল অবিভাবক। শারীরিক সমস্যা নিয়ে হাসপাতালে অথচ দেশের গুরুত্বপূর্ণ সময়ে তিনি পিছপা হতে পারেন না। স্যারের কেবিনে পৌঁছে দেখি তিনি রাষ্ট্রের বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ ফাইল পরীক্ষা করছেন। সামনেই দু’জন কর্মকর্তা দাঁড়ানো তাদের ডিকটেশন দিচ্ছেন। আমাকে দেখেই ইশারায় একটি টুলে বসতে বললেন। দ্রুতই হাতের কাজ সেরে নার্সকে হুইল চেয়ার আনতে বললেন। নির্দেশনা দিলেন আমাকে তার পেছনে পেছনে হাঁটার।
হাসপাতালের করিডোরে কিছুদূর যেতেই তিনি একটি ফাঁকা জায়গায় হুইল চেয়ার দাঁড় করালেন। আমার জিজ্ঞাসা কি? আমি বললাম, স্যার আমি তো জানিনা আপনি হাসপাতালে? আমরা অন্যদিন বসতে পারতাম। স্যার শান্ত স্বরে বললেন, না, সব কাজই আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। আমার শরীরের বেশকিছু অংশ অবশ (প্যারালাইজড) হয়ে যাচ্ছে তাই আমাকে দিনে একাধিকবার থেরাপি নিতে হবে। আর আপনাকে পরে সময় দেয়া আমার জন্য আরও কঠিন হবে। তখন পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে। এই বলেই স্যার বলতে শুরু করেন, ফখরুদ্দিন সাহেবের সঙ্গে তিনি বর্তমান পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে কী কী পরামর্শ দিয়েছেন তা নিয়ে। প্রায় ঘণ্টাখানেক সময় দিলেন আমাকে। এক সময় থেরাপিস্ট আসে, স্যার আপনার সময় হয়ে গেছে। স্যার কেবিনে ফিরে যান। আমিও পেছনে পেছনে কেবিনে যাই স্যারকে বিদায় জানাতে। বিদায় বেলায় আরও বিস্ময় নিয়ে ফিরি, দেখি ওনার কেবিনে একটি কেবিনেট ভর্তি রাষ্ট্রীয় ফাইল। আমার দিকে তাকিয়ে বিদায় জানাতে জানাতে বললেন, হাসপাতালই এখন আমার রেগুলেটরি রিফর্ম কমিশন। এমন ঘটনা একাধিকবার হয়েছে। তিনি তখন সরকারের কোনো পদে নেই।

ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে খণ্ডকালীন শিক্ষকতায় যুক্ত। আমাকে ইন্টারভিউ দেবেন। মহাখালীতে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে সময় দিলেন। স্যারের কক্ষে ঢুকে দেখি খাতার স্তূপ। নিবিষ্ট মনে খাতা দেখছেন। স্যার, আমি কী পরে অন্যদিন করবো। তিনি চোখ তুলে বললেন, সেদিন আমার ব্যস্ততা আরও বেশি থাকবে। সুতরাং, আপনার অসুবিধা না হলে আমরা এখানেই কথা বলতে পারি। স্যারের চোখ তখন শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার খাতায় আর মননে দেশ ও সমাজ ভাবনা। কর্মবীর এই মানুষটির পরিচয় পাওয়া যায় তার জীবনের পরতে পরতে। তিনি যখন নাটোরের ডিসি তখন কবি জীবনানন্দ দাসের বনলতা সেনকে খুঁজে বেরিয়েছেন। এ বিষয়ে তার রয়েছে একটি গবেষণা গ্রন্থ। সেখানে তিনি যুক্তিসহকারে তুলে ধরেছেন কে এই বনলতা সেন? আসলেই কি বনলতা সেন বলে কেউ ছিল? জীবনানন্দ দাসের দু’দণ্ড শান্তির খোঁজে বনলতা সেনের কাছে ছুটে আসা? ঘণ্টার পর ঘণ্টা এ বিষয়ে স্যারের নানা অনুসন্ধানে প্রাপ্ত তথ্য তিনি ব্যাখ্যা করেছেন। অসাধারণ একটি বই লিখেছেন তিনি এ বিষয়ে।
নতুন আলোকে জীবনানন্দের বনলতা সেন। একজন সাদামাটা কেরানির জীবন তিনি কখনই যাপন করেননি। ছিলেন ডাকসাইটে আমলা। ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়ার নবীনগরের অজ পাড়াগাঁ রসুল্লাবাদ গ্রামে বেড়ে উঠেছেন। সেখানকার দশ মাইল দূরে এক গরু ছাগলের হাটে থাকা পুরোনো বইয়ের দোকানে গিয়ে পড়তেন বই। শেষ পর্যন্ত বই পড়ার নেশায় বুঁদ ছিলেন। তিনি বিদ্যোৎসমাজে গ্রন্থকীট নামেই পরিচিত। আকণ্ঠ পড়তেন তিনি। গুলশানের যে বাসায় তিনি থাকতেন তা বইতেই ঠাসা। বিবিধ বিষয় অনুসন্ধিৎসু আগ্রহ পাওয়া যায় আকবর আলি খানের নানা লেখার মাধ্যমে। আত্মজীবনী ‘পুরানো সেই দিনের কথা’য় সেসব কথা লিখে গেছেন। বহুগুণের আঁধারে তিনি অনন্য। বীর মুক্তিযোদ্ধা। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে তিনি ছিলেন হবিগঞ্জের প্রশাসক। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের প্রশাসনিক কর্মকর্তা থেকে বিদ্রোহ করে দেশের তরে অস্ত্রের ভল্ট খুলে দিয়েছিলেন মুক্তিযোদ্ধাদের, খাদ্যের গুদাম বিলিয়ে দিয়েছিলেন আর ব্যাংক থেকে অর্থ নিয়ে পৌঁছে দিয়েছিলেন প্রবাসী সরকারের কাছে। পাকিস্তান সরকার তার বিচার করে চৌদ্দ বছরের সাজা দিয়েছিল। কিন্তু তিনি ছিলেন অকূতভয়।
ড. আকবর আলি খানের কর্মের মধ্যে নানান বিষয়ে আগ্রহের ছাপ স্পষ্ট। অর্থনীতির মতো জটিল ও দুর্বোধ্য বিষয়কে তিনি কতোই না সহজ করে লিখেছেন। তার প্রকাশিত অর্থনীতি বিষয়ক বইগুলোর শিরোনাম দেখলেই তা স্পষ্ট। পরার্থপরতার অর্থনীতি, আজব ও জবর আজব অর্থনীতি। বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থা নিয়ে লিখেছেন, অবাক বাংলাদেশ: বিচিত্র ছলনা জালে রাজনীতি। বাংলাদেশের ইতিহাস, সমাজ ও সংস্কৃতি ছিল সবসময়ের পছন্দের বিষয়। এ নিয়ে লিখে গেছেন মূল্যবান গ্রন্থ, ডিসকভারি অব বাংলাদেশ। বরাবরই স্পষ্টবক্তা ড. আকবর আলি খান আজীবন সাহস আর দৃঢ়তার সঙ্গে লড়েছেন চলার প্রতিটি ক্ষেত্রে। সত্য কথাটি শেষ পর্যন্ত বলে গেছেন। স্যালুট, স্যারকে। তিনি বেঁচে থাকবেন তার কীর্তি ও কর্মে।