মত-মতান্তর
'বাজলো কি রে ভোরের সানাই নিদ মহলার আঁধারপুরে'
ড. মাহফুজ পারভেজ
(১ বছর আগে) ২৭ আগস্ট ২০২২, শনিবার, ২:২৬ অপরাহ্ন
সর্বশেষ আপডেট: ৯:৩৭ পূর্বাহ্ন

কাজী নজরুল ইসলাম (২৪ মে ১৮৯৯ – ২৯ আগস্ট ১৯৭৬) বিংশ শতাব্দীর প্রধান বাঙালি কবি, সাহিত্যিক ও সঙ্গীতকার। তার মাত্র ২৩ বৎসরের সাহিত্যিক জীবনে সৃষ্টির যে প্রাচুর্য তা তুলনারহিত। সাহিত্যের নানা শাখায় বিচরণ করলেও তার প্রধান পরিচয় তিনি কবি। বাংলা ভাষার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি। বাংলাদেশের জাতীয় কবি। মহত্তম এই কবির ৪৬তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ ১২ ভাদ্র।
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ১৯৭৬ সালের এই দিনে (১৩৮৩ বঙ্গাব্দের ১২ ভাদ্র) ঢাকার তৎকালীন পিজি হাসপাতালে (বর্তমানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়) শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। আজ শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় জাতি স্মরণ করছে তাকে।
অবিভক্ত বাংলার প্রান্তিক ও প্রত্যন্ত জনপদ চুরুলিয়া গ্রামের আক্ষরিক অর্থেই একটি মাটির ঘরে যে শিশুটির জন্ম হয়েছিল; দুঃখ, দারিদ্র্য ও কঠিন জীবনসংগ্রামের মধ্যদিয়ে সাহিত্যসাধনার সকল শাখায় তুঙ্গস্পর্শী সাফল্য ও জনপ্রিয়তা সত্ত্বেও ব্যক্তিগত বেদনার নির্বাক জীবন-যাপন শেষে দুখুমিয়া নামের শিশুটি এখন ঘুমিয়ে আছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে।
আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্ম ছিল একটি নিদ্রিত জাতির মধ্যে মহাজাগরণের ঘূর্ণিঝড়ের মতো প্রবল উত্থানে প্রকম্পিত।
নজরুল নিজের একটি গানে যেন সে আবহের জানান দিচ্ছেন:
"বাজলো কি রে ভোরের সানাই নিদ মহলার আঁধারপুরে,
শুনছি আজান গগন তলে অতীত রাতের মিনার চূড়ে।"
নজরুল বিশেষজ্ঞ ড. রফিকুল ইসলাম ‘সৃষ্টির ভুবনে নজরুল স্বাধীন সম্রাট’ প্রবন্ধে (দেশ, ১২ জুন ১৯৯৯) লিখেছেন:
"ফজরের আজানে 'নিদ্রা অপেক্ষা প্রার্থনা (নামাজ) শ্রেয়' এই কথা বলা হয়ে থাকে অর্থাৎ জাগরণের আহ্বান থাকে। বাঙালি সমাজে নজরুল ইসলামের জন্ম বাঙালি সমাজের জাগরণের সূচক।"
নজরুলের দৃপ্ত মানসিকতার পরিচয় পাওয়া যায় করাচি সেনানিবাসে রচিত ‘বাঁধন হারা’য়:
"আগুন, ঝড়, ঝঞ্ঝা, বৃষ্টি, বিদ্যুৎ, বজ্র, আঘাত, বেদনা— এই অষ্টধাতু দিয়ে আমার জীবন তৈরি হচ্ছে, যা হবে দুর্ভেদ্য, মৃতুঞ্জয়, অবিনাশী। আমার পথ শাশ্বত সত্যের পথ, বিশ্বমানবের জনম জনম ধরে চাওয়া পথ, আমি আমার আমিত্বকে এ পথ থেকে মুখ ফেরাতে দেব না।"
এমনই প্রবল বিদ্রোহ ও তীব্র সাহসে নজরুল ছিন্ন করেন তৎকালীন ব্রিটিশ-ভারতের সাংস্কৃতিক দাসত্ব এবং রাজনৈতিক পরাধীনতার শৃঙ্খল। নিম্নবর্গের মেহনতি মানুষ ও স্বজাতির আত্মজাগরণের মূলস্রোতে তিনি কবিতা, গান, লোকনাট্য, কথাশিল্পকে বেগবতীভাবে প্রবাহিত করে পরিণত হন জাতির স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষার সাহিত্য স্রষ্টায়।
দীর্ঘ জীবনের মাত্র সামান্য কিছু কর্মময় কালেই তিনি তুলনায় ছাড়িয়ে যান আর সবাইকে; পরিণত হন নিজেই নিজের অনন্য উপমায়।
ইতিহাস, ঐতিহ্য, বিশ্বাস ও জীবনবোধে নজরুল যতটুকু আমাদের, আর কেউ ততটুকু আমাদের হতে পারেন নি। বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির অন্য সকলের সঙ্গে তুলনামূলক আলোচনায় আমাদের সঙ্গে নজরুলের সর্বাঙ্গীন সম্পর্ক, নিবিড় ঘনিষ্টতা, ঐতিহ্যবাহিত উত্তরাধিকার এবং আত্মা ও শরীরের একাত্মতাই প্রথম এবং প্রধান সত্য।
বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের মহীরুহ-তুল্য কাজী নজরুল ইসলাম প্রেম, বিদ্রোহ, মুক্তি, মানবতার পক্ষে দাঁড়িয়ে জগতের বঞ্চিত, ভাগ্য বিড়ম্বিত, স্বাধীনতাহীন বন্দিদের জাগ্রত করার মন্ত্র উচ্চারণ করেছিলেন। বলেছিলেন, "জাগো অনশন-বন্দি, ওঠ রে যত জগতের বঞ্চিত ভাগ্যহত।"
শতবর্ষ পেরিয়ে আসা কবি কাজী নজরুল ইসলামের চৈতন্য-প্রসারিত গান, কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক তথা সুবিশাল সাহিত্যকর্ম বর্তমান পরিস্থিতিতে শুধু প্রাসঙ্গিকই নয়, নানা কারণে তাৎপর্যবাহী। কেননা, বৈশ্বিক মহামারি করোনার প্রখর প্রতাপে ত্রস্ত পৃথিবীতে থেমে নেই অন্যায়, অবিচার, স্বৈরতা ও অমানবিকতা। ফিলিস্তিন থেকে মিয়ানমার পর্যন্ত পৃথিবীময় শোষণ, নির্যাতন, হত্যা, রক্তপাতে ক্ষত-বিক্ষত-রক্তাক্ত হয়ে করোনা-বিপর্যস্ত পৃথিবীর অগণিত মানুষ এখন অবর্ণনীয় দুর্দশা ও দুর্বিপাকে বিপন্ন। এমতাবস্থায় অন্যায় ও অনাচারের বিরুদ্ধে চিরবিদ্রোহী নজরুলের মানব অধিকারের রণহুঙ্কার বড়ই প্রাসঙ্গিক ও প্রয়োজনীয়।
বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম, যার গান ও কবিতা যুগে যুগে বাঙালির জীবন সংগ্রাম ও স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রেরণার উৎস হয়ে কাজ করেছে, তার বিখ্যাত কবিতাসমূহের একটি 'বিদ্রোহ', যা স্পর্শ করেছে রচনার শতবর্ষের ঐতিহাসিক মাইলফলক। কবিতাটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯২২ সালের ৬ জানুয়ারি 'বিজলী' পত্রিকায়। এরপর কবিতাটি মাসিক 'প্রবাসী' (মাঘ ১৩২৮), মাসিক 'সাধনা' (বৈশাখ ১৩২৯) ও 'ধূমকেতু'তে (২২ আগস্ট ১৯২২) ছাপা হয়। বলা বাহুল্য, অসম্ভব পাঠকপ্রিয়তার কারণেই কবিতাটিকে বিভিন্ন পত্রিকা বিভিন্ন সময়ে উপস্থাপিত করেছিল।
১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ জ্যৈষ্ঠ অবিভক্ত বৃটিশ-বাংলার সর্বপশ্চিম প্রান্তের বর্ধমান জেলার চুরুলিয়ায় জন্ম নিয়ে কাজী নজরুল ইসলাম ১৩৮৩ বঙ্গাব্দের এই দিনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে (সাবেক পিজি হাসপাতাল) শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। সমগ্র বাংলাদেশের এবং বিশ্বব্যাপী বাংলাভাষীদের শ্রদ্ধায় ও ভালোবাসায় কবিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাহিত করা হয়, যেমনটি তিনি নিজেই বলেছিলেন:
"মসজিদেরই পাশে আমায় কবর দিও ভাই।"
ড. মাহফুজ পারভেজ, লেখক ও বিশ্লেষক।
মন্তব্য করুন
মত-মতান্তর থেকে আরও পড়ুন
মত-মতান্তর সর্বাধিক পঠিত

জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]